বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মোড়ে মোড়ে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করছে রাজধানীবাসী; একেবারেই হাতে গোনা গণপরিবহন চলছে সড়কে।
পাঠাও ও বাহনের মতো অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবাগুলো সাময়িকভাবে বন্ধের নোটিস আগেই গ্রাহকদের জানানো হয়েছিল।
ফলে রায় ঘিরে উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে রাস্তায় নামা অফিসগামী যাত্রী ও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পোহাতে হয়েছে দুর্ভোগ।
ব্যাংক কর্মকর্তা সায়েদুল ইসলাম উত্তরায় সকাল ১০টার অফিস ধরতে ভোর সাড়ে ৬টায় রামপুরা ব্রিজ এলাকা থেকে রওনা হয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গণপরিবহন সঙ্কট হতে পারে, এজন্য অনেক আগেই বাসা থেকে বের হয়েছি। অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। টঙ্গীগামী বাসের অপেক্ষায় আছি, কিন্তু বাসের দেখা নেই।
“বুধবার রাতে যে বাসগুলো রামপুরা টিভি সেন্টার এলাকায় ছিল, সে বাসগুলোর কর্মীরা বলছে, তারা কুড়িল অবধি যাবে। যেগুলো যাচ্ছে টঙ্গী, সেগুলোতেও তিলধারণের ঠাঁই নেই।”
মিরপুর যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় রামপুরা উলন রোডে দাঁড়িয়ে ছিলেন শরীফুল ইসলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও যানবাহন না পেয়ে বাসায় ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছেন বলে জানালেন তিনি।
“মালিবাগ থেকে ছেড়ে আসা নূর-এ-মক্কা বাসের অপেক্ষা করছি। দু-তিনটি বাস বিপরীত দিকে যেতে দেখলাম। কিন্তু সেগুলো আবার ফিরে মিরপুর যাবে কিনা বুঝতে পারছি না।”
উল্টোপথে বাড্ডা থেকে মতিঝিল যাচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান স্বপন।
তিনি বলেন, “বেশ খানিকটা সময় অপেক্ষা করে তবে বাসের দেখা পেয়েছি। সুপ্রভাত পরিবহনের একটা বাস মধ্য বাড্ডাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। ভাগ্যিস খালি বাস পেয়েছি।”
সকাল ৭টায় চৌধুরীপাড়া এলাকায় কথা হয় শতাব্দী পরিবহনের চালকের সহকারী হাশেমের সঙ্গে।
মালিবাগ রেলগেইট এলাকায় বাসের অপেক্ষা করছিলেন অনেকে। উত্তরাগামী তুরাগ, অনাবিল, সালসাবিল ও রাইদা পরিবহনের যে বাসগুলো আসছিল, সবগুলো ছিল যাত্রীতে পূর্ণ। সুপ্রভাত পরিবহন গুলিস্তান থেকেই দরজা বন্ধ করে আসছিল।
মালিবাগ থেকে বারিধারায় অফিসগামী একটি উন্নয়ন-গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রাবেয়া খাতুন বললেন, নারী যাত্রীরা বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
“পুরুষরাও না হয় ঠেলা-ধাক্কা মেরে বাসে উঠে গেল। কিন্তু নারীরা তো পারছেন না। খুব বাজে অবস্থা! অফিস ধরতে হলে রিকশা নেব। কিন্তু রিকশাওয়ালারাও যেতে চাইছে না। রাজি হলেও দ্বিগুণ ভাড়া হাঁকছে।”
খিলগাঁও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে যাবেন সৌমিত্র। অনেক অপেক্ষার পর তুরাগ পরিবহনের বাসে উঠতে পেরে তিনি বেশ আনন্দিত।
“এই সকালেই যে বাস একটু ফাঁকা পাব, তা ভাবতে পারিনি। যাক, বাঁচা গেল।”
তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পাশের আরেক যাত্রী মোস্তফা হোসাইন জানান, তিনি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাবেন। নতুনবাজার এলাকায় তিনি প্রায় এক ঘন্টা ধরে বাসের অপেক্ষা করেছিলেন।
নগরীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় কথা হয়, যাত্রী ইশরাত জাহান ইভা ও ঈসমাইল হোসেন জনির সঙ্গে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমবিএ শেষ পর্বের পরীক্ষা দিতে তারা যাবেন সায়েন্স ল্যাব এলাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। বাসের অপেক্ষায় থেকে তারা অবশেষে রিকশাযোগে রওনা হন।
ইভা বলেন, “বাসের অপেক্ষায় থাকলেও আজকে আর পরীক্ষা হলে যেতে হবে না। ভাড়া বেশি চাইছে, তবুও রিকশাই নিলাম। পরীক্ষা ১০টায়, কিন্তু আড়াই ঘণ্টা আগেই রওনা হলাম। বলা তো যায় না, পথে কোনো গণ্ডগোল বাঁধে কি না।”
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকেও গুলিস্তানের গোলাপশাহ্ মাজার ও সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গুলিস্তান থেকে নরসিংদীগামী মেঘালয় ও বিআরটিসি পরিবহন, দক্ষিণবঙ্গগামী টুঙ্গিপাড়া পরিবহন, মধুমতি পরিবহন, ইমাদ এন্টারপ্রাইজ, বান্দুরা, মুন্সীগঞ্জ ও মাওয়াগামী বিভিন্ন পরিবহনের বাস একেবারেই কম।
মাওয়াগামী যাত্রী জুয়েল বলেন, “অন্যদিন এ সময় কত বাস থাকে। আজকে বাসই নাই। কিভাবে আজকে বাড়ি যাব, জানি না।”
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও গুলিস্তানের বাস ডিপো থেকে দূরপাল্লার কয়েকটি বাস ছেড়ে গেলেও যাত্রী ছিল অনেক কম। লক্ষ্মীপুরগামী জোনাকী পরিবহনের চালক আকবর মিয়া বলেন, “অন্যদিনের চাইয়া আজকে যাত্রী ম্যালা কম। বিষ্যুদবার যাত্রী অনেক থাকে। আইজকে হরতাল বইল্যা যাত্রীরাও মনে হয়, বাসা থিকা বাইর হয় নাই। আজকে লস খামু।”
সিলেটগামী মিতালী পরিবহনের চালকের সহকারী জানান, দেড় ঘণ্টা ডাকাডাকির পর মাত্র ১৫ জন যাত্রী নিয়ে তারা সায়েদাবাদ কাউন্টার ছেড়ে যাচ্ছেন।
আগারগাঁও থেকে মিরপুর-২ নম্বর যাওয়ার ৬০ ফিট সড়কে অন্যদিন বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘসময়ের জন্য গাড়ি যানজটে আটকা থাকলেও এদিন সেই চিত্র দেখা যায়নি।
আগারগাঁও থেকে শ্যামলী যাওয়ার পথে রেডিও সিগনাল এলাকায় তিনমুখী গাড়ির চাপে অন্যদিন যানজট হলেও এদিন গাড়ির সংখ্যা ছিল অনেক কম।
মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ চলতে থাকায় আগারগাঁও সিগনালে মিরপুর, খামারবাড়ি, শ্যামলী ও মহাখালীগামী গাড়িগুলোর চিরাচরিত দীর্ঘ অপেক্ষাও ছিল না এদিন, গাড়ির সংখ্যা কম থাকায় নির্বিঘ্নেই চলাচল করছিল গাড়িগুলো।
সকালের দিকে নগরীর নিউমার্কেট এলাকা ও সায়েন্স ল্যাব এলাকার চিত্র ছিল থমথমে। দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে খুলেনি। ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেট ও চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের কটি দোকান খুললেও সকালে ক্রেতা ছিল অনেক কম।
সকালে শহরের একেবারে উত্তর প্রান্ত উত্তরা মডেল টাউন থেকে রাজধানীমুখী যানবাহনের যে রকম চাপ থাকে সপ্তাহের শেষ দিন হিসাবে বৃহস্পতিবার তেমন চাপই ছিল না।
বিমানবন্দর, খিলক্ষেত ও কাকলীসহ এই পথটির অন্যান্য ব্যাসস্ট্যান্ডে তেমন যাত্রীর চাপও দেখা যায় নাই। তবে এ সড়কে যানবাহন ছিল কম।
ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কও অন্যান্য দিনের তুলনায় ফাঁকা ছিল। রাস্তায় কম সংখ্যক গাড়ি চলতে দেখা গেছে। মহাখালী আমতলী ট্রাফিক সিগনালে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয়নি কোনো যানবাহনকে।
আমতলীতে বাস থেকে নেমে চাকরিজীবী আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এসেছি টঙ্গী থেকে। অন্যদিন এ সময় প্রচুর জ্যাম থাকে রাস্তায়, আজ সে তুলনায় ফাঁকা ছিল রাস্তা, গাড়ির সংখ্যাও কম ছিল।”
হাইকোর্ট মোড় এলাকা থেকে মগবাজার ফ্লাইওভার হয়ে বনানী ও গুলশানের রাস্তায় সকাল সাড়ে ৮টার সময় পথে কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল ছিল না, খুব কম যানবাহন দেখা গেছে। মানুষের চলাচলও সীমিত আকারে নজরে পড়েছে। মোড়ে মোড়ে পুলিশের নজরদারিও চোখে পড়েছে।
সকাল ১০টায় সায়েন্স ল্যাব এলাকায় যানবাহন তুলনামূলক কম দেখা গেছে; কলেজ স্ট্রিটে পুলিশের কড়াকড়ি পাহারা ছিল।
নগরীর যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান ও নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাবটরি, মহাখালী এলাকার সড়কে অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
শ্যামলী থেকে মহাখালী-গুলশান রুটে বাস-প্রাইভেট কার চলাচল অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ কম। তবে অটোরিকশা চলেছে স্বাভাবিকভাবেই।
আদাবর ৯ নম্বর রোড নিবাসী মুসাব্বির আহমেদ নিজের গাড়িতে মতিঝিলের অফিসে গেলেও বৃহস্পতিবার নিজের গাড়ি বের না করে অটোরিকশায় যাচ্ছেন তিনি।
মুসাব্বির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার রিস্ক নিতে চাচ্ছি না।”
এদিকে ঢাকা সিলেট মহাসড়ক হয়ে কোনো গণপরিবহন ঢাকায় ঢুকছে না। ঢাকায় বাস আসা পুরোপুরি বন্ধ আছে। জরুরি প্রয়োজনে কেউ ছোট যানবাহনে লোকজন ঢাকার দিকে আসার চেষ্টা করলেও ঢাকা সিলেট মহাসড়কের বাঁশেরপুল পুলিশ চেকপোস্টে যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছে পুলিশ।
তবে ঢাকা থেকে দূরপাল্লার কিছু বাস যেতে দেখা গেছে। যানবাহন না পেয়ে অনেকে অটোরিকশা, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান এবং ট্রাক্টরে করেও লোকজনকে আসতে দেখা গেছে।
নারায়ণগঞ্জের ভুলতা পুর্বাচল ৩০০ ফুট সড়ক হয়ে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত বিআরটিসির আর্টিকুলেটেড বাস চলাচল করছে। তবে তাতে যাত্রী অনেক কম।
পুর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের কাঞ্চন সেতু, বালু ব্রিজ এবং বসুন্ধরা এলাকায় পুলিশ বিভিন্ন যানবাহন তল্লাশি চালাচ্ছে।