এবার ডাকসু নির্বাচনের আশায় ছাত্র নেতারা

২৭ বছর ধরে বন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠানে উচ্চ আদালতের রায়ে ছয় মাসের সময় বেঁধে দেওয়ার পর এখন নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকার কথা জানিয়েছেন ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা।

তপন কান্তি রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2018, 04:27 PM
Updated : 17 Jan 2018, 05:33 PM

তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য না দিয়ে হাই কোর্টের রায়ের কপি হাতে আসার পর সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বুধবার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন। এই বিষয় নিয়ে আগাম কোনো বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্য না করাটা ভালো। এখন উত্তম হলো রায়ের কপি পেয়ে কোর্টের নিদের্শনা মোতাবেক কাজ করা।

“ওইটা আসলে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নিব, আইনের শাসন বা কোর্টের নির্দেশনা মেনে কাজ করব।”

ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে বুধবার রায় দেয় হাই কোর্ট। আর ওই নির্বাচনের সময় যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তার দরকার হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয় রায়ে।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছয় বছর আগের একটি রুলের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের বেঞ্চ বুধবার এই রায় দেয়।

দুই যুগ ধরে বন্ধ থাকা ডাকসু নিয়ে আন্দোলন চলার মধ্যে সেটার নির্বাচন আয়োজনে প্রশাসনকে বাধ্য করতে ২০১২ সালে এই রিট আবেদন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থী।

এখন রায় অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক ডাকসু নেতা ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

এত দিন ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিও এসেছে ডাকসুর সাবেক সহ-সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মুখে।

হাই কোর্টের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সিপিবি সভাপতি সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা খুবই দুঃখজনক যে এর জন্য আদালতের রায় পর্যন্ত গড়াতে হল। ডাকসু নির্বাচনের তফসিল অবিলম্বে ঘোষণা করা হোক- এই দাবি জানাচ্ছি।

“একইসঙ্গে ডাকসু নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য যারা কোনো না কোনোভাবে দায়ী তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।”

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরের বছর যাত্রা শুরু করে ডাকসু। প্রথমে পরোক্ষ নির্বাচন হলেও পর শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে ডাকসু নির্বাচন চালু হয়।

ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে ডাকসু এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা ছিলেন সামনের কাতারে। স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। 

প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভোট হয়েছে মাত্র ছয়বার। সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচনের পর ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সে নির্বাচন হয়নি।

এই সময়ে ছাত্র নেতাদের বক্তব্যে ডাকসু সচলের দাবি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে থেকে নানা ধরনের আশ্বাস দেওয়া হলেও কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলো

গতবছর ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, “ডাকসু ইলেকশন ইজ মাস্ট, তা না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে।”

বিগত বছরের শেষে উপাচার্য নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সময় সিনেট পরিপূর্ণ করার দাবি জোরালো হয়, সেখানে ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধির পাশাপাশি ডাকসুর মাধ্যমে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি আনার বিষয়টিও উঠে আসে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে।

এর মধ্যে দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানও উপাচার্যদের মতো ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলে বক্তব্য দেন।

২০১২ সালে রিটকারীদের একজন ছিলেন সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র আলী আসিফ শাওন।

বর্তমানে আমাদের সময় পত্রিকার প্রতিবেদক শাওন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই রিট ২০১২ সালে করেছিলাম এবং আমরা মনে করেছিলাম, এটা হয়ত আলোর মুখ দেখবে না। পাঁচ বছর পর হলেও একটা রায় এসেছে, উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দিতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমি মনে করি, বিভিন্ন সময় ডাকসু দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন সংগ্রাম করেছিল; আমাদের আগে যারা আন্দোলন করেছিল, এখন যারা করছে- এই রায়টা সকলের। এটা একটা প্রাথমিক বিজয়। এই নির্বাচন হোক আর না হোক এটা পরে বিষয় কিন্তু এই আদালতের রায়টাও আমাদের বিজয় হিসাবে মনে করছি।”

আদালতের রায়কে স্বাগত জানানোর কথা বলেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান; নির্বাচন আয়োজন করলে প্রশাসনকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।

ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান বলেছেন, ডাকসু নির্বাচন হলে প্রশাসনকে সব ধরনের সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত তারা

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা আবিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালতের রায়কে স্বাগত জানাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যখনই নির্বাচনের আয়োজন করবে, ছাত্রলীগ অংশগ্রহণ করবে। আর নির্বাচন আয়োজন করার ক্ষেত্রে প্রশাসন যত ধরনের সহযোগিতা চাইবে, সেটা ছাত্রলীগ করবে।”

নির্বাচন আয়োজনের পাশাপাশি তাতে সব ছাত্র সংগঠনের ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ অংশগ্রহণ নিশ্চিতের পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানিয়েছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার সিদ্দিকী।

বিএনপির ছাত্র সংগঠনের নেতা বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান জানাই।বর্তমান ভিসি ও প্রশাসন সে রায় অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবেন, এই প্রত্যাশা করি।

ছাত্রদল নেতারা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের পাশাপাশি সব সংগঠনের তাতে অংশগ্রহণের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

“তবে নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমরা চাই- বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র সংগঠনের স্বর্তঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু, সুন্দর ও স্বাভাবিক নির্বাচন হোক।”

ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই রায় মানতে বাধ্য। আমরা মনে করি, এই রায় একদিকে যেমন জয়, আরেক দিকে থেকে লজ্জাও বটে। নির্বাচনের জন্য হাই কোর্টের দ্বার পর্যন্ত যেতে হয়েছে সেজন্য এটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের জন্য লজ্জার।”

তিনি বলেন, “আশা করি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের সব কার্যাবলী শেষ হবে। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে যে অচলায়তন, মেধাভিত্তিক রাজনীতির বিপরীতে পেশি শক্তির রাজনীতির যে প্রচলন তার অবসান ঘটবে। আর ছাত্ররা তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে।”

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপিলের মাধ্যমে রায় বাস্তবায়নে গড়িমসির চেষ্টা করলে তার রুখে দাঁড়ানোর হুঁশিয়ারি দেন লিটন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপিল করবে কি না এমন প্রশ্নে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, “আমরা নির্বাচন করতে চাই, রায়ের কপি না দেখে অন্য কিছু বলা যাবে না।”