ডাকসু নির্বাচন সবাই চায়, তবুও হচ্ছে না

সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমনকি রাষ্ট্র ও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে চাওয়া হলেও গত ২৭ বছরেও হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন।

উম্মে হাবিবাও তারেক হাসান নির্ঝরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2017, 06:44 PM
Updated : 9 Dec 2017, 09:04 PM

সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে। এরপর দেশে গণতন্ত্র ফেরার পর ছয়টি সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু ডাকসু থেকে গেছে অধরা।

এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের মধ্যে সিনেট, সিন্ডিকেটের নির্বাচন এবং শিক্ষক সমিতির নির্বাচন নিয়মিত হলেও শিক্ষার্থীদের ফোরামের নির্বাচনটি হয়নি একবারও।

ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় সিনেটে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব থাকছে না বলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের মতামত দেওয়ার আনুষ্ঠানিক কোনো সুযোগ থাকছে না।

এছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রেও তা যে অন্তরায়, সে কথা বলে আসছেন সাবেক ছাত্রনেতাসহ দেশের রাজনীতিকরা।

গত ৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য মো. আবদুল হামিদ ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে জোরালোভাবে বলেছিলেন, “ডাকসু ইলেকশন ইজ আ মাস্ট। ডাকসু নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।”

এরপর শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি জোরালো করলেও কোনো কাজ হয়নি।

কেন হচ্ছে না ডাকসু নির্বাচন- এই প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে না হওয়ায় এখন ‘না হওয়ার পরিবেশ দাঁড়িয়ে গেছে’। 

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২৭ বছর ধরে ডাকসুর নির্বাচন হয়নি, নির্বাচন না হতে হতে নির্বাচন না হওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে।”

“বিভিন্ন সময় বিভিন্নজন দায়িত্বে ছিলেন, বিভিন্ন কারণে তারা ডাকসু নির্বাচন দিতে পারেননি। আর ২৭ বছরে যে ঝঞ্ঝাট তৈরি হয়েছে, সেই পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসতে সময় লাগবে,” বলেন কয়েক মাস আগে উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়া অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।

ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশনে বসা শিক্ষার্থী ওয়ালিদ আশরাফের অনশন ভাঙানোর সময়ও উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ডাকসু নির্বাচন করব, তবে এজন্য সময় লাগবে “

ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ২৫ নভেম্বর থেকে অনশন করছিলেন ওয়ালিদ আশরাফ নামে এক শিক্ষার্থী, শনিবার দুপুরে ডাকসু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে তাকে অনশন ভাঙান উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান

শিক্ষার্থীদের এই নির্বাচনের গুরুত্ব স্বীকার করেই তিনি বলেন, “ডাকসুর মাত্র পাঁচজন প্রতিনিধি সিনেটে অংশগ্রহণ করে, তবে এই সংখ্যাটাও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। তারা যাতে সিনেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে সেজন্য ডাকসু নির্বাচন জরুরি।”

১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার মূল কেন্দ্র সিনেটের ১০৫ জন সদস্যের মধ্যে ৫ জন শিক্ষার্থী থাকবে, যাদের পাঠাবে ডাকসু।

২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় খণ্ডিত সিনেট নিয়েই সভা বসছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই নানা সিদ্ধান্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরুর পর ১৯২৪ সালে ডাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমদিকে ডাকসু মনোনীত হত। ১৯৫৩ সালে সর্বপ্রথম ডাকসু নির্বাচন হয়। তবে তখন হল সংসদে নির্বাচিতরা ডাকসু নির্বাচন করতেন। ফলে সরাসরি ভোটে ডাকসু হত না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭২ সালে প্রথম সরাসরি ভোটে ডাকসু নির্বাচিত হয়। ভিপি হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জিএস হন মাহবুব জামান। ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও ফল ঘোষণার আগে তা পণ্ড হয়ে যায়।

এরপর বিরতি দিয়ে পাঁচবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আমানউল্লাহ আমান ভিপি ও খায়রুল কবির খোকন জিএস নির্বাচিত হন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ডাকসু তথা ছাত্র নেতৃত্বের।

এরপর আর ডাকসু নির্বাচন হয়নি।

ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ঐতিহ্যের মধ্যে এটি একটা। এর মাধ্যমেই ছাত্রদের যথার্থ প্রতিনিধিরা নানা বিষয়ে কথা বলতে পারেন এবং এই ধরনের ছাত্র সংসদের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে, সুস্থ রাজনীতির একটা সুযোগ হয়।”

কে কী বলছেন

ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হলে সবাই বলেন, তারা এই নির্বাচন চান।

সরকার সমর্থক ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সেই প্রথম থেকেই বলে আসছি আমরা ডাকসু নির্বাচন চাই। আমরা চাই শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি ডাকসুর দায়িত্বে আসুক।”

প্রশাসন যখনই নির্বাচন দেবে, তখনই ছাত্রলীগ তাতে অংশ নেবে, বলেন তিনি।

গত ১০ অগাস্ট ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে মধুর ক্যান্টিনের সামনে উন্মুক্ত আলোচনার ডাক দিয়েছিল একদল শিক্ষার্থী। সেই আলোচনায় নিজেরা অংশ না নেওয়ার পাশাপাশি অংশ নিতে আসা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দিয়েছিল ছাত্রলীগ।

সহাবস্থান নেই দাবি করে আসা ছাত্রদলের বক্তব্যের বিষয়ে আবিদ বলেন, “তারা যদি ডাকসু নির্বাচনে আসতে চায় আমরা স্বাগত জানাব। তবে অছাত্র ও বহিরাগত কেউ যদি ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করতে আসে, তাহলে আমরা তা প্রতিরোধ করব।”

ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হলে তাতে অংশ নেবেন কি না- জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের সভাপতি মেহেদী তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফর ডটকমকে বলেন, “ডাকসু নির্বাচনকে আমরা সবসময় স্বাগত জানাই এবং নির্বাচন হলে অবশ্যই অংশগ্রহণ করব।”

ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলো

তিনি বলেন, “অতীতে দেখা যেত সরকার সমর্থকরা ডাকসু নির্বাচন চাইত এবং বিরোধীপক্ষের বাধার কারণে নির্বাচন হতো না। তবে এখন ঘটনা উল্টো।

“ক্যাম্পাসে আমাদের ন্যূনতম সহাবস্থান না থাকলেও আমরা ডাকসুর দাবিতে আলোচনায় অংশ নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সরকার সমর্থকদের বাধার কারণে সে আলোচনায় আমরা অংশ নিতে পারিনি।”

ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার জন্য প্রশাসনকেই দায়ী করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্যোগ নেই বলেই ডাকসু নির্বাচন হচ্ছেনা। আর ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার পেছনে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রও কাজ করে। স্টুডেন্টরা যাতে কথা বলতে না পারে তাই রাজনৈতিক দলগুলো চক্রান্ত করে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে উপাচার্য আসেন এবং এভাবেই তারা ডাকসু নির্বাচন হতে দেয় না।”

ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছেন, বড় দুই দলের ‘দলবাজির’ কারণে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন হচ্ছে না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি তুহিন কান্তি দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু রাষ্ট্রের ক্ষমতার মূল কাঠামোর সাথে ডাকসুর সম্পর্ক রয়েছে, সেজন্য তারা চান না যে ছাত্রদের এই গণতান্ত্রিক দাবি পূরণের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা চর্চার পথে বেকায়দার সৃষ্টি করতে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ‘ক্ষমতাসীনদের দখলে রয়েছে’ দাবি করে তিনি বলেন, “ডাকসু নির্বাচন দিলে তাদেরও ক্ষমতা চর্চার সুযোগ থাকবে না। এটাও ডাকসু নির্বাচন না দেওয়ার পেছনে একটি কারণ।”

ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ২০১২ সালে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন যারা, তাদের একজন ১৯৮৯-৯০ সালে ডাকসুর ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "নির্বাচন কেন হচ্ছে না, তা বলতে পারবে কেবল বর্তমান ও সাবেক সরকার দল। আমি নিজে উচ্চ আদালতে ডাকসু নির্বাচনের জন্য রিট করেছি, কিন্তু সেটির জবাব এখনও পাইনি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আইন উপদেষ্টা আব্দুল হালিম চাকলাদারে সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ‘এই বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন’ বলে ফোন কেটে দেন।

রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রিটের শুনানির জন্য কয়েকবার তারিখ নির্ধারণ করেছি, কিন্তু প্রতিপক্ষ আইনজীবীদের অসহযোগিতার জন্য এখনো শুনানি সম্পন্ন হয়নি। এখনও রিটটি কোর্টে আছে, যে কোনো দিন শুনানি হতে পারে।”

ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান বলছেন, ক্যাম্পাসে সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নেই বলে এই নির্বাচন হচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নেই বলে ডাকসুর নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন এই পর্যন্ত সর্বশেষ ভিপি, বর্তমানে বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান।

ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সাবেক ভিপি, বর্তমানে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “এটা হচ্ছে না মূলত দুটি দলের দলবাজির কারণে এবং তাদের ‘ক্যাডার-কালচারের’ কারণে।

“নির্বাচন হলে ক্যাডারদের পেশিশক্তি ও আধিপত্য কমে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই শক্তির উপর নির্ভর করেই তাদের প্রশাসন চালায়, তাই তারা নির্বাচন দিতে চায় না।”

প্রায় একই কথা বলেন ডাকসুর একমাত্র নারী ভিপি মাহফুজা খানম।

স্বাধীনতার আগে ডাকসু ভিপির দায়িত্বপালনকারী মাহফুজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার বলেন, রাজনৈতিক দল বলেন বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনই বলেন- তারা এটিকে বন্ধ করে রেখেছে।

“কারণ এতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে না। প্রশাসনও প্রচ্ছন্নভাবে এই দলেরই লোকজন, তারাও এটিকে মেনে নিয়েছে।”