কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি: শেখ হাসিনা

টানা নয় বছর বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়ে আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বর্ষপূর্তিতে জাতির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2018, 01:32 PM
Updated : 12 Jan 2018, 04:09 PM

তিনি বলেছেন, “২০১৪ সালে আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আজকের এই দিনে আমি তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলাম। আজ বছরপূর্তিতে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হাজির হয়েছি।”

দশম সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের চার বছর পূর্তিতে শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন সরকার প্রধান।

তার এই ভাষণ জাতীয় সম্প্রচার মাধ‌্যমে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে প্রচার করা হয়।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিন মেয়াদে ১৪ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে গেলে শেখ হাসিনা হন বিরোধদলীয় নেতা।

এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয় পায় আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় মহাজোট সরকার।

বিএনপির বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন; তাতে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

সরকারের বর্ষপূর্তিতে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার উপর যে বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছিলেন, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছি আপনাদের মর্যাদা রক্ষা করার। কতটুকু সফল বা ব্যর্থ হয়েছি সে বিচার আপনারাই করবেন।”

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোগিতাকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করাই তারর ‘একমাত্র ব্রত’।

“বাংলার মানুষ যেন অন্ন পায়, বস্ত্র পায়, উন্নত জীবনের অধিকারী হয়- জাতির পিতার এই উক্তি সর্বদা আমার হৃদয়ে অনুরণিত হয়। তাই সর্বদা আমার একটাই প্রচেষ্টা- কীভাবে বাংলাদেশের মানুষের জীবনকে অর্থবহ করব, স্বচ্ছল ও সুন্দর করে গড়ে তুলব।”

এই ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান মেনে, অর্থাৎ তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই চলতি বছর শেষে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে। তার আগে ২০১৩ সালের মতই মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করা হবে।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব দল সেই নির্বাচনে অংশ নেবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

প্রধানমন্ত্রীর ২৬ মিনিটের এই ভাষণের প্রায় অর্ধেক সময় জুড়ে ছিল গত নয় বছরে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং সাফল্যের বিবরণ। বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নাশকতার বিবরণও তিনি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। 

ভাষণে তিনি বলেন, ২০০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেছিল বলেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রয়েছে।

“নয় বছর একটানা জনসেবার সুযোগ পেয়েছি বলেই বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে।”

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ‘দিন বদলের সনদ’ ঘোষণা করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অভিযাত্রার কথা যেমন তিনি বলেন, তেমনি যুদ্ধাপরাধের বিচার ও রায় কার্যকর, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর এবং বিডিআর হত্যার বিচাররে কথা মনে করিয়ে দেন।

জঙ্গি দমন অভিযানে ‘বলিষ্ঠ’ ভূমিকা রাখায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী।

উন্নয়নের বিবরণ

# দেশে ১৩ কোটি মোবাইল সিম ব্যবহৃত হচ্ছে। আট কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল স্থাপনের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ বৃদ্ধি করা হয়েছে।  প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার হয়েছে। সেখানে মানুষ ২০০ ধরনের সেবা পাচ্ছে।

# বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা পেয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০০৫ সালের ৫৪৩ ডলার থেকে বেড়ে ১ হাজার ৬১০ ডলার হয়েছে। দারিদ্র্যের হার  ২০০৫-০৬ অর্থবছরের ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২২ শতাংশে।

# ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপির  আকার ছিল ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা; ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।  ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

# ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বিএনপির সময়ে মূল্যস্ফীতি যেখানে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল, তত্ত্বাবধায়কের ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যা ১২ দশমিক ৩ শতাংশে উঠেছিল, তা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৭ সালের শেষে এসে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ হয়েছে।

# বিদেশি বিনিয়োগ ২০০৫-০৬ অর্থবছরের শূন্য দশমিক ৭৪৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

# ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার যেখানে ছিল ৬১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা; এবার তা বেড়ে প্রায় ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা হয়েছে। একইভাবে এডিপির আকার ১৯ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।

# রপ্তানি আয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরের ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৪ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে পৌঁছেছে ৩৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে।

# ২০১৭ সালে বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ১০ লাখ ৮ হাজার ১৩০ জনের। প্রবাসীরা ১৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন।

#গত ৯ বছরে ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৬৫টি কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে। ১ হাজার ৪৫৮টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ৫০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম পেয়েছে।

# সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি বই বিতরণ করা হয়েছে এবার।

# স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সারাদেশে সাড়ে ১৮ হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র করা হয়েছে। ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে।

# আওয়ামী লীগ গত নয় বছরে ১১৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ১৬ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে। দেশের ৮৩ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।

# এ সরকারের সময়েই খাদ্য উৎপাদন ৪ কোটি মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ।

# মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭২ বছর।  সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা ১২৩ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।

# সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলে সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পাশাপাশি  কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে।

#পদ্মা সেতুর কাজ অর্ধেকের বেশি সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকায় মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। শিগগিরই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করা হবে।

# সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার হতদরিদ্র ৩৫ লাখ মানুষকে বয়স্কভাতা দিচ্ছে। বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্ত, দুস্থ্য নারী ভাতা উপকারভোগীর সংখ্যা এখন ১২ লাখ ৬৫ হাজার। আট লাখ ২৫ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে। শিক্ষা ভাতা পাচ্ছে ৮০ হাজার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী।

# সারাদেশে ২ কোটি ২৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ জন কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। প্রায় ৯৮ লাখ কৃষক ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খুলে ভর্তুকির টাকা পাচ্ছেন।

# আওয়ামী লীগের সময়ে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংসা অর্জন করেছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ বৈষম্য নিরসনে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে।

শেখ হাসিনা বলেন, “সারা বিশ্ব আজ বাংলাদেশকে সম্মানের চোখে দেখে। যে বাংলাদেশকে এক সময় করুণার চোখে দেখত, সাহায্যের জন্য হাত বাড়ানোয় করুণার পাত্র মনে করত; আজ সে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বসভায় সম্মানিত।”