নিউ ইয়র্কে মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে মহাসচিবের পক্ষে এসব সুপারিশ উপস্থাপন করেন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জেফ্রি ফেল্টম্যান।
গত ৬ নভেম্বর মিয়ানমার পরিস্থিতির উপর প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট গ্রহণ করে ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে বিবৃতি দিতে জাতিসংঘ মহাসচিবকে অনুরোধ জানিয়েছিল নিরাপত্তা পরিষদ।
মঙ্গলবারের বৈঠকে মহাসচিবের সেই বিবৃতি তুলে ধরতে গিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে ওই পাঁচ সুপারিশ উপস্থাপন করা হয় বলে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
সুপারিশগুলো হল- কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে ভিত্তি ধরে শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা; বাস্তুচ্যুতদের মূল ভূমিতে বা পছন্দনীয় কাছাকাছি কোনো স্থানে প্রত্যাবাসন করা; জীবন ধারণের মৌলিক সব প্রয়োজন মেটাতে অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; প্রত্যাবাসনের যোগ্যতার ক্ষেত্রে উদার মানদণ্ড নির্ধারণ এবং সকল প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো।
নিরাপত্তা পরিষদের ডিসেম্বর মাসের সভাপতি জাপানের সভাপতিত্বে এ সভায় পরিষদের সদস্য দেশগুলোর বাইরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকেও বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত সম্মতিপত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শিগগিরই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে এবং মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে।
“কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক দুর্দশার যে মূল কারণ, তা দূর করতে এ সংক্রান্ত বহুবিধ বিষয় ও অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো মিয়ানমারকেই সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সহাযোগিতা ও পর্যবেক্ষণ একান্তভাবে প্রয়োজন, আর তা করতে হবে অসহায় রোহিঙ্গাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে।”
ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরে থাকা পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক মঙ্গলবার প্যারিসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’র মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা আগামী ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশে আসছেন আলোচনার জন্য।
রাষ্ট্রদূত মোমেন তার বক্তব্যে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত অসহায় নাগরিকদের মানবিক সহায়তা দেওয়া, সহিংসতার নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন তদন্ত ও বিচার, রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে একত্রে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের পাশাপাশি অন্যদের মধ্যে বৈঠকে বক্তৃতা করেন ‘সংঘাতময় এলাকায় যৌন সহিংসতা বিষয়ক’ জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমীলা প্যাটেন।
সাম্প্রতিক সফরে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলোয় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর রাখাইনে যে ভয়াবহ যৌন সহিংসতা হয়েছে, নির্যাতিত নারী ও শিশুদের কাছ থেকে শোনা সেই নির্যাতনের বর্ণনা তিনি বৈঠকে তুলে ধরেন।
তিনি সহিংসতার শিকার এমন অনেক নারীর উদাহরণ দেন, যাদের কেউ কেউ টানা ৪৫ দিন সেনা ক্যাম্পে ধারাবাহিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
প্যাটেন জানান, অনেক মেয়েকে তার স্বামী অথবা বাবার সামনে ন্গ্ন করে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেক মায়ের সন্তানদের গ্রামের জলকূপে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। শিশুকে কেড়ে নিয়ে শিশুর সামনে মাকে ধর্ষণ করা হয়েছে; এবং ধর্ষণ শেষে শিশুটিকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
এমনই সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা জানিয়ে প্যাটেন দ্রুততম সময়ে এই সহিংসতার সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদকে সর্বক্ষমতা প্রয়োগের আহ্বান জানান।
গত ১৬ নভেম্বর মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটি উন্মুক্ত ভোটের মাধ্যমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। থার্ড কমিটির ওই প্রস্তাব শিগগিরই সাধারণ পরিষদের প্লেনারিতে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে।
এছাড়া গত ৫ ডিসেম্বর জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলে মিয়ানমারের মানবিক পরিস্থিতির উপর একটি বিশেষ বৈঠক হয়; সেখানেও এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।