বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় হাই কোর্টের রায়ের পর সাজা বহাল থাকাদের পরিবারে যেমন কান্নার রোল পড়েছে, তেমনি আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে খালাসপ্রাপ্তদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।
Published : 27 Nov 2017, 06:07 PM
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলার আপিলের রায় শুনতে সোমবার হাই কোর্টে উপস্থিত ছিলেন ৮৫০ আসামির অনেকের পরিবারের সদস্যরা।
স্বজনদের নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অপেক্ষার অবসান ঘটে বিকালে তিন বিচারকের বেঞ্চের রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
রায়ে পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের সময় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে হাই কোর্ট।
জজ আদালতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৫২ জনের মধ্যে আটজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং চারজনকে হাই কোর্ট খালাস দিয়েছে। সব মিলিয়ে এ মামলার অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন মোট ২৮৮ জন।
খালাস পাওয়াদের একজন নায়েক সুবেদার আলী আকবর; বিদ্রোহের মাত্র চার মাস আগে পিলখানায় বদলি হয়ে এসেছিলেন তিনি।
হাই কোর্টে সাজা ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রী রেহানা আক্তার। ফাঁসি থেকে খালাস পাওয়ার বিষয় জানার পর হঠাৎ হাসির ঝিলিক দেখা যায় তার মুখে।
খবরটি পরিবারের অন্য সদস্যদের মোবাইলে জানানো শুরু করেন কুমিল্লার দেবিদ্বারের বাসিন্দা রেহানা; একজনকে মোবাইলে বলছিলেন, “আম্মু, তোমার আব্বু খালাস পেয়েছে।”
জানতে চাইলে রেহানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ছোট মেয়ে রুবিনা আক্তার শম্পাকে তার বাবার খালাসের খবরটি দিচ্ছিলেন তিনি।
আলী আকবর ও রেহানার মেজ মেয়ে শম্পা ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে পড়েন। অন্য দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে, আর ছোট মেয়ে পড়েন দশম শ্রেণিতে।
রেহানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ন্যায়বিচার পেয়েছি। কিন্তু আইনি লড়াই শেষ করলে তো কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। তারপরও খুশি, এতদিন রায় পক্ষে পেয়েছি।”
রেহানা বলেন, তার স্বামী অবসরে ঠিক আগে সদর দপ্তরে বদলি হয়ে এসেছিলেন, তার চার মাস পরেই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে এবং তাতে তিনিও ফেঁসে যান।
ফাঁসি থেকে খালাস পেয়েছেন সদর ব্যাটালিয়নের বিল্লাল হোসেন খান, ঘটনার পর থেকে যিনি কারাগারে আছেন। সদর ব্যাটালিয়ানের এমটি শাখায় কাজ করতেন বিল্লাল।
তার বড় মেয়ের জামাই সালাউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি।”
রেহানা ও সালাউদ্দিনের খুশির মধ্যে আদালত প্রাঙ্গণে বিলাপ করে কাঁদছিলেন বকুল বেগম; তার ছেলে সিগন্যালম্যান আবুল বাশারের ফাঁসির সাজা বহাল রেখেছে হাই কোর্ট।
রায় শুনতে ধামরাই থেকে আসা এই নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ন্যায়বিচার পাই নাই। আমরা আপিল করব। আমার ছেলের কোনো দোষ না থাকার পরও তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।”
বকুলের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে বাশার ছেলেদের মধ্যে বড়।
বকুল বলেন, বিদ্রোহের ওই ঘটনার পর তাদের পরিবার প্রায় ‘শেষ’।
রায়ের পর হাই কোর্ট প্রাঙ্গণে হাউ মাউ করে কাঁদছিলেন ফাঁসি বহাল থাকা সুবেদার মেজর জাকির হোসেন জামালের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস।
তিনি আকুতি করতে থাকেন, ‘মাগো, বাবা কইয়া কার কাছ যাইয়াম গো।’
রায়ের আগে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষার সময় জিন্নাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, তার বাবার কর্মস্থল ছিল খাগড়াছড়ি, তিনি এলপিআরে ছিলেন। তার মা নার্গিস ফাতেমা পিলখানায় বিডিআর হাসপাতালে নার্স ছিলেন। পিলখানাতেই ছিল তাদের বাসা। তার বাবা বিদ্রোহের সময় ওই বাসায়ই ছিলেন।
জান্নাত বলেন, “আমার বাবা সাভারে একটি জমি কেনার কাজে গিয়েছিল। সেদিন সে ঘটনাস্থলে ছিল না। তাকে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছিল।”
পিলখানার গোলাগুলিতে জান্নাতের মা নার্গিস মারা যান, তার লাশ পাওয়া যায়নি।
জান্নাতের দুই চাচাও ছিলেন বিডিআরে। সিপাহি আলামিন নাইক্ষ্যংছড়ি ১৫ নাম্বার ব্যাটালিয়নে ছিলেন। ফয়সাল ছিলেন ১০ নাম্বার ব্যাটালিয়নে সুনামগঞ্জে। তারা প্যারেডে অংশ নিতে পিলখানায় এসেছিলেন। তাদের দুজনেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
যাবজ্জীবন থেকে খালাস পাওয়াদের একজন সিপাহী আতিকুর রহমান; রায় শুনতে আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন তার বড় ভাই কামরুল হাসান।
রায়ের পর কামরুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘ নয় বছর অপেক্ষার পর আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। ওই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছি। তারপরও আমর আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করি।”
ঘটনার পর থেকে কারাগারে আছেন নওগাঁর মহাদেবপুরের আতিকুর। বিদ্রোহের এক বছর আগে জন্ম হয়েছিল তার একমাত্র মেয়ে নাসার, যে এখন শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পা দিয়েছে।
কামরুল বলেন, “তার (আতিকুর) নামে বিস্ফোরক মামলা আছে। সেটা নিষ্পত্তি হলে তাকে মুক্ত করতে পারব বলে আশা করি।”