বিচারপতি জয়নুলকে নিয়ে চিঠি দাপ্তরিক, আদালতের মতামত নয়: হাই কোর্ট

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে তদন্ত ‘আটকাতে’ দুর্নীতি দমন কমিশনে আপিল বিভাগ প্রশাসনের চিঠি কোনোভাবেই সুপ্রিম কোর্টের মতামত নয় এবং তা সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে বলে এক রায়ে জানিয়েছে হাই কোর্ট।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2017, 11:05 AM
Updated : 14 Nov 2017, 01:19 PM

গত মার্চে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারের পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ ‘সমীচীন হবে না’ ।

বিষয়টি নজরে আনা হলে অক্টোবরে রুল জারি করেছিল হাই কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের দেওয়া ওই চিঠি কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছিল রুলে।

এ বিষয়ে শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার সাতটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে রুলের নিষ্পত্তি করে দিয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, কেবল দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রপতি ছাড়া যে কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগের তদন্ত চলতে পারে। সুতরাং বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের চিঠিতে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে।

তবে সাত বছরেও দুদকের ওই অনুসন্ধান শেষ না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে রায়ে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের বিরুদ্ধে তদন্তের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে, যাতে আদালতের মর্যাদাহানী না হয় বা অকারণে কাউকে হয়রানির শিকার হতে না হয়।

বিচারপতি এস সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকার সময় এই চিঠিটি দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পদত্যাগী বিচারপতি সিনহা এই চিঠি নিয়েও সমালোচনায় পড়েছিলেন।

এই আবেদনের শুনানিতে আদালত জানতে চেয়েছিল- সুপ্রিম কোর্টের এই চিঠির বিচার করার এখতিয়ার হাই কোর্টের আছে কি না। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছে, ওই রুল যথার্থ (ম্যানটেইনেবল)।

রুল শুনানির জন্য অ্যামিচি কিউরি হিসেবে আদালত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, এ এম আমিন উদ্দিন ও প্রবীর নিয়োগীকে নিয়োগ দিয়েছিল। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন; আর দুদকের পক্ষে ছিলেন খুরশীদ আলম খান।

রায়ের পর খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ের সাতটি পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, চিঠিটা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। এ চিঠি দেওয়া হয়নি। এটাকে কোনো ক্রমেই সুপ্রিম কোর্টের চিঠি বলা যাবে না। আমরা বলতে পারি চিঠিটি অবৈধ।” 

আর জয়নুল আবেদীনের আইনজীবী ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন বলেন, “হাই কোর্টের এ রায় ইতিবাচক।”

পর্যবেক্ষণ

১. যেহেতু আপিল বিভাগ প্রশাসন তাদের দাপ্তরিক ক্ষমতাবলে ওই চিঠি দিয়েছে, সেহেতু তা নিয়ে বিচারিক পর্যালোচনার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। সুতরাং হাই কোর্টের রুল ‘ম্যানটেইনেবল’।  

২. ওই চিঠি দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করেছে, যা ওই কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। 

৩. আপিল বিভাগের প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে পাঠানো ওই চিঠি শুধুই দাপ্তরিক যোগাযোগের জন্য। সুতরাং তা সুপ্রিম কোর্টের মতামত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।

৪. ওই চিঠি জনগণের কাছে সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। 

৫. ওই চিঠিতে এমন একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে যে, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকরা ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত থেকে দায়মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু বস্তুত, দায়িত্বরত একজন রাষ্ট্রপতি ছাড়া আার কেউ ওইরকম দায়মুক্তি পেতে পারেন না।      

৬. অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন যে অনুসন্ধান চালাচ্ছে তা সন্তোষজনক নয় এই কারণে যে, দীর্ঘ সাত বছরেও তারা তাদের অনুসন্ধান শেষ করতে পারেনি।

৭. সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত বা অনুসন্ধান চালানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্তৃপক্ষকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে বিচার বিভাগের মর্যাদা, বিচারদণ্ড, বা জনগণের আস্থায় কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে, কেউ যাতে অকারণে হয়রানির শিকার না হন।

মামলার পূর্বাপর

জয়নুল আবেদীন ১৯৯১ সালে হাই কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান, পরে ২০০৯ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসরে যান। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের সন্দেহে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে তাকে নোটিস দেয় দুদক।

দুদকের দেওয়া ওই নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ২০১০ সালের ২৫ জুলাই হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন। তার শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের হাই কোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দিয়েছিল।

এর সাত বছর পর পুনরায় এই বিচারপতির বিরুদ্ধে বিদেশে ‘অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে’ উল্লেখ করে তার বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে এই বছরের ২ মার্চ চিঠি দেয় দুদক।

এর জবাবে ২৮ মার্চ আপিল বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, “সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না বলে সুপ্রিম কোর্ট মনে করে।”

কোনো বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসদাচরণ, দুর্নীতি বা অন্য কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া তার প্রাথমিক তদন্ত বা অনুসন্ধান না করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের ওই চিঠিতে।

এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে সংসদে ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের প্রসঙ্গটিও আসে।

প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ওই চিঠি দেওয়ার মাধ্যমে বিচারপতি এস কে সিনহা ‘ন্যায় বিচারের প্রতিবন্ধকতা’ তৈরি করেছেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. বদিউজ্জামান তফাদার ওই চিঠি আদালতের নজরে আনার পর ৯ অক্টোবর রুল দেয় হাই কোর্ট। গ্রেপ্তারের আশঙ্কা প্রকাশ করে হাই কোর্ট থেকে আগাম জামিন নেন বিচারপতি জয়নুল আবেদীন।

রিট আবেদনের শুনানিতে উঠে আসে, চিঠি চালাচালির পর সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি জয়নুল আবেদীন সম্পর্কে তথ্য দুদককে দিয়েছে।

রায়ে বলা হয়েছে, যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট তথ্য দিয়েছে এবং দুদকের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই হাই কোর্ট পর্যক্ষেণসহ রুল নিষ্পত্তি করে দিচ্ছে।