বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত ‘আটকাতে’ সেই চিঠি নিয়ে প্রশ্ন হাই কোর্টের

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে তদন্ত ‘আটকাতে’ দুর্নীতি দমন কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া চিঠি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Oct 2017, 12:55 PM
Updated : 19 Oct 2017, 04:10 PM

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের দেওয়া ওই চিঠি কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, জানতে চেয়ে সোমবার রুল দেয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

ওই চিঠিতে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ ‘সমীচীন হবে না’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল, যা নিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনামুখর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।

দুদকে গত ২৮ মার্চ পাঠানো সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তীর চিঠিটি আইনজীবী মো. বদিউজ্জামান তফাদার আদালতের নজরে আনার পর এই রুল দেওয়া হয়।

আদালতে এ বিষয়ে শুনানিতে বদিউজ্জামানের সঙ্গে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানও ছিলেন।

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার, দুদকের চেয়ারম্যান ও বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে ১০ দিনের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এই রুলের শুনানির জন্য অ্যামিচি কিউরি হিসেবে আদালত তিন আইনজীবীকে নিয়োগ দিয়েছে। তারা হলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, এ এম আমিন উদ্দিন ও প্রবীর নিয়োগী।

আগামী ১৯ অক্টোবর এই বিষয় পরবর্তী শুনানি হবে।

জয়নুল আবেদীন ১৯৯১ সালে হাই কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২০০৯ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসরে যান তিনি।

এই নোটিসের পর চিঠি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনার মধ্যে গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় গত ১০ জুলাই হাই কোর্টে গিয়ে আগাম জামিন নেন বিচারপতি জয়নুল আবেদীন।

জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের সন্দেহে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে তাকে নোটিস দেয় দুদক। ওই নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ২০১০ সালের ২৫ জুলাই হাই কোর্টে একটি রিট আবেদনও করেছিলেন।

তার শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের হাই কোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দিয়েছিল।

এর সাত বছর পর পুনরায় এই বিচারপতির বিরুদ্ধে বিদেশে ‘অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে’ উল্লেখ করে তার বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে গত ২ মার্চ চিঠি দেয় দুদক।

ফিরতি চিঠিতে সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত সমীচীন হবে না বলার পর ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে প্রধান বিচারপতির সমালোচনামুখর আওয়ামী লীগ নেতারা এই বিষয়টিও তোলেন।

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংসদে বলেছিলেন, “প্রধান বিচারপতি সিনহার আদেশে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অবৈধভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত না করার জন্য হাস্যকর কারণ তুলে বলেছিলেন।

“এটি করার মাধ্যমে বিচারপতি সিনহা ন্যায় বিচারের প্রতিবন্ধকতা বা বাধা হিসেবে পরিচিত অপরাধ করেছেন, যা দণ্ডবিধির অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি সুপ্রিম কোর্টের নাম শুধু ব্যবহারই করেননি, তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্যাড ব্যবহার করেছেন, যদিও এটা ছিল তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।”

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েলে আহমেদ বলেছিলেন, “বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করা যাবে না, কী বিস্ময়কর!”

সুপ্রিম কোর্টের চিঠিতে যা ছিল

বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দাখিল করা সম্পদ বিবরণীর সুষ্ঠু যাচাই ও অনুসন্ধানের কথা উল্লেখ করে তার চাকরির (বিচারপতি হিসেবে) মেয়াদ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র (যোগদানপত্র, অবসর গ্রহণের তারিখ সম্বলিত কাগজপত্র) ও চাকরি সূত্রে বিভিন্ন (বেতন, ভাতা, অবসর সুবিধা ইত্যাদি) খাতে গৃহীত অর্থের বিবরণী (অর্থ বছর হিসেবে) চেয়ে ২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে চিঠি দিয়েছিল দুদক।

এর জবাবে ২৮ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, “উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রের প্রেক্ষিতে নির্দেশিত হয়ে জানানো যাচ্ছে যে, মাননীয় বিচারপতি জনাব জয়নুল আবেদীন দীর্ঘকাল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

“দায়িত্ব পালনকালীন তিনি অনেক মামলার রায় প্রদান করেন। অনেক ফৌজদারি মামলায় তার প্রদত্ত রায়ে অনেক আসামির ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মাননীয় বিচারপতি কর্তৃক প্রদত্ত রায় সকলের উপর বাধ্যকর।

“এহেন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তার প্রদত্ত রায়সমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে বিভ্রান্তির উদ্রেক ঘটবে। বর্ণিত অবস্থায়, সাবেক মাননীয় বিচারপতি জনাব জয়নুল আবেদীন-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না মর্মে সুপ্রিম কোর্ট মনে করে।”