শনিবার বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে নিজের প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
হাসপাতালটির পরিচালক ডা. এম এ কাশেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা নিয়ে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। সম্প্রতি দেশে ও দেশের বাইরে তার দুই-তিনটি অস্ত্রোপচারও হয়েছিল।”
এম আর খানের মরদেহ আপাতত সেন্ট্রাল হাসপাতালের মরচুয়ারিতে রাখা হবে বলে জানান তিনি। এই হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন প্রয়াত এই চিকিৎসক।
রোববার সকালে সেন্ট্রাল হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে জানাজার পর মরদেহ সাতক্ষীরা নেওয়া হবে বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
খ্যাতনামা এই শিশু বিশেষজ্ঞের বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম আগেই মারা গেছেন। তাদের একমাত্র মেয়ে দৌলতুন্নেসা ম্যান্ডি।
স্বাধীনতা ও একুশে পদকজয়ী এই চিকিৎসকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক জানিয়েছেন। শোক প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনও (বিএমএ) প্রবীণ এই চিকিৎসকের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এম আর খানের মরদেহ রোববার বেলা ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে।
তার আগে সকাল সাড়ে ১০টায় এম আর খান প্রতিষ্ঠিত গ্রিন রোডের ‘সেন্ট্রাল হাসপাতালে’ তাকে নেওয়া হবে। সেখানে জানাজার পর সাড়ে ১১টায় দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হবে মরদেহ।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মিরপুরে এম আর খান প্রতিষ্ঠিত শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এ তার মরদেহ নেওয়া হবে। সেখানেও জানাজা পড়া হবে। এরপর উত্তরায় এই চিকিৎসক প্রতিষ্ঠিত উইমেন্স মেডিকেল কলেজে তার মৃতদেহ নেওয়া হবে।
রোববারই তার মরদেহ সাতক্ষীরায় গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হবে। এই জাতীয় অধ্যাপকের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সেখানেই তাকে সমাহিত করা হবে।
অধ্যাপক এম আর খান তার কর্মবহুল জীবনে চিকিৎসাসহ জাতীয়ভিত্তিক বহু প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সংগঠন প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, মিরপুরের ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড হসপিটাল, সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল যশোর অন্যতম।
তার মৃত্যুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শিশু বিশেষজ্ঞ ও মিরপুর ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের পরিচালক ডা. এখলাসুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এম আর খান ছিলেন বাংলাদেশে শিশু বিভাগের প্রথম অধ্যাপক।
“এমন কোনো শিশু বিশেষজ্ঞ নেই যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্যারের ছাত্র ছিলেন না। তাকে বলা হয়, ‘ফাদার অব পেডিয়াট্রিশিয়ান অ্যান্ড ইনস্টিটিউশন’।”
চিকিৎসায় অবদানের জন্য এ বছর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন এম আর খান। গত ২৪ মার্চ এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্বাধীনতা পদক পরিয়ে দেন।
১৯২৮ সালের ১ অগাস্ট সাতক্ষীরা শহরতলীর রসুলপুর গ্রামে জন্ম মোহাম্মদ রফি খানের, কর্মজীবনে তিনি এম আর খান নামেই বেশি পরিচিতি ছিলেন।
তিনি চিকিৎসার পাশাপাশি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া প্রায় সব সম্পত্তিই দান করেছেন সাতক্ষীরা জেলার মানুষের জন্য।
আব্দুল বারী খান ও জায়েরা খানমের চার ছেলের মধ্যে মেজ এম আর খান সাতক্ষীরা সদরের প্রাণনাথ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় (পিএন স্কুল) থেকে ১৯৪৩ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন।
সেখান থেকে ১৯৪৫ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন তিনি; এরপর কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে এমবিবিএস পাস করে সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন।
১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি দূর সম্পর্কের আত্মীয় আনোয়ারা বেগম আনুর সঙ্গে এম আর খানের বিয়ে হয়। পরের বছর উচ্চ শিক্ষার জন্য সস্ত্রীক বিদেশে পাড়ি জমান তিনি।
বিদেশে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট ও এডিনবরা গ্রুপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দেশে ফিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগ দেন এম আর খান। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যোগ দিয়ে পরের বছর অধ্যাপক হন।
১৯৭১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ-আইপিজিএমআরের (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম-পরিচালকের দায়িত্ব পান।
ডা. খান ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালকের পদে যোগ দেন। শিশুদের জন্য বিশেষায়িত এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ওই বছরই আবার আইপিজিএমআরের শিশু বিভাগে যোগ দেন তিনি।
দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক এম আর খান অবসর নেন। তবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যান তিনি।
এম আর খান শিশুরোগ চিকিৎসা ও সমাজ সেবার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
১৯৮৭ সালে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে প্রকাশিত প্রকাশনায় তার জীবনপঞ্জি অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৯১ সালে ম্যানিলাভিত্তিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অ্যাসোসিয়েশন অব পেডিয়াট্রিকস থেকে পদক পান তিনি।
১৯৯২ সালে তিনি শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতি সংসদ কর্তৃক স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন।
তিনি দেশ-বিদেশে উল্লেখযোগ্য মেডিকেল কলেজের উচ্চতর ডিগ্রি/সম্মান দেওয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন। বাংলাদেশে শিশু স্বাস্থ্যের ওপর এফসিপিএস, ডিসিএইচ ও এমসিপিএস (MCPS) ডিগ্রি পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
ধানমণ্ডির ৩ নম্বর সড়কে নিজের বাসভবনে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিবেদিতা মেডিকেল ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ লিমিটেড।
বিভিন্ন শিশু বিষয়ক সংগঠন, সংস্থা ও হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি তিনি নিজ উদ্যোগে দেশের শিশুদের কল্যাণে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। নিজের এলাকার দরিদ্র ও অসহায় মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নীরবে কাজ করে যান তিনি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে এম আর খানের ৩৭টি গবেষণাধর্মী রচনা প্রকাশিত হয়েছে। শিশুরোগ চিকিৎসা সংক্রান্ত সাতটি বই লিখেছেন, যেগুলো দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত।
এক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “তিনি সারাজীবন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বহু সংস্কারমূলক ও জনহিতকর কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। বিশেষত শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে তার অবদান জাতি চিরকাল মনে রাখবে।”