দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যপূরণে সমবায় আন্দোলনের যথাযথ ব্যবহার যে হয়নি তা তুলে ধরে নিবেদিতভাবে এটাকে লালন করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Published : 05 Nov 2016, 03:07 PM
তিনি বলেছেন, “আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা অত্যন্ত খারাপ। সমবায় আন্দোলন গড়ে উঠার পর সংশ্লিষ্টরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে সমবায় সমিতি নিয়ে যেসব অভিযোগ রয়েছে তা আসত না।
“ঠিকভাবে এটাকে ব্যবহার করা হয়নি। যে যেখানে দায়িত্বে থাকেন, সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো একদিনে পেট কেটে সব ডিম বের করার চেষ্টা করবেন না। এটাকে লালন পালন করবেন; সমবায়ের যেন উন্নয়ন হয়, সেজন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করবেন- সেটাই আমরা চাই।”
৪৫তম জাতীয় সমবায় দিবস উপলক্ষে শনিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
‘সমবায়ের দর্শন, টেকসই উন্নয়ন’- এবারের এই প্রতিপাদ্যকে ‘অত্যন্ত সময়োপযোগী’ হিসাবে মন্তব্য করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু সমবায়কে দর্শন হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন উল্লেখ করে তার কন্যা বলেন, “তিনি চেয়েছিলেন, কীভাবে সমবায়কে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন করা যায়। অর্থনীতিকে গতিশীল করা যায়; ধনী ও গরিবের বৈষম্য কমানো যায়।
“আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায় অত্যন্ত বড় ভূমিকা রাখতে পারে এবং সফল হতে পারে।”
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের সভাপতি শেখ নাদির হোসেন লিপু মিল্ক ভিটাসহ সমবায় কার্যক্রমের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
ক্ষুদ্র ঋণের পরিবর্তে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মাইক্রো ক্রেডিট বা ঋণের বোঝা নিয়ে হয় মানুষকে আত্মহত্যা করতে হচ্ছে অথবা পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ঘরবাড়ি জমিজমা বিক্রি করে নিঃস্ব হচ্ছে।
“এভাবে মানুষ যাতে নিঃস্ব না হয়, সেজন্য মাইক্রো ক্রেডিটের পরিবর্তে মাইক্রো সেভিংসে আমরা যাচ্ছি।”
এই প্রসঙ্গে ‘একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প’ এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের স্বনির্ভরতা গড়ার উদাহরণ দেন শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে ‘জাতীয় সমবায় পুরস্কার-২০১৪’ বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। পাঁচ জন সমবায়ী ও পাঁচটি সমবায় সমিতি এই পুরস্কার পেয়েছে। তাদের প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেটের ১০ গ্রাম ওজনের একটি সোনার পদক ও সনদ দেওয়া হয়।
সঞ্চয় ও ঋণদান শ্রেণিতে সবুজমতি ক্রেডিট কো-অপারেটিড লিমিটেডের জন্য সাবের হোসেন চৌধুরী, কৃষিভিত্তিক ও গ্রাম উন্নয়নে রাজশাহীর অগ্রণী সেচ প্রকল্প ও পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির পক্ষে সম্পাদক এনামুল হক, সমবায় শ্রেণিতে টুঙ্গীপাড়া দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মুন্সী রফিকুল ইসলাম দুগ্ধ, মহিলা সমবায় শ্রেণিতে কুড়িগ্রামের উলিপুরের নারী সমবায় সমিতির ছবি রায়, বহুমুখী সমবায় শ্রেণিতে নবদিগন্ত বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি বাহাউদ্দিন বেপারী, মৎস্য সমবায় শ্রেণিতে সিলেটের লালবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের গুলজার আহমেদ জগলু, মুক্তিযোদ্ধা সমবায় শ্রেণিতে চট্টগ্রামের সমন্বিত মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমবায় সমিতি লিমিটেডের পক্ষে মীর আবদুল হান্নান, বিত্তহীন ভূমিহীন সমবায় সমিতি শ্রেণিতে খুলনার কাশিমনগর বিত্তহীন সমবায় সমিতি লিমিটেডের পক্ষে মো. ইউনুস আলী, যুব পেশাভিত্তিক শ্রেণিতে চট্টগ্রামের বিষ্ণুদে আদর্শ সমবায় সমিতির সভাপতি আবু নঈম পাটোয়ারী দুলাল, খুলনার কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহন সমবায় শ্রেণিতে মোবারকগঞ্জ চিনিকল কর্মচারী সঞ্চয় ও সরবরাহ সমবায় সমিতি লিমিটেডের পক্ষে সম্পাদক গোলাম রসুল প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেন।
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি ঘোষণার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কপরেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না, আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না। জমি নিয়ে যাবেন, তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কোঅপারেটিভ হবে; প্রত্যেক গ্রামে এই কোঅপারেটিভে, জমির মালিকের জমি থাকবে।’
“উনি একটা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন একটা অপপ্রচার শুরু করেছিল যে, সমস্ত জমির মালিকানা নিয়ে যাবে।”
সংবিধানের মূল চার নীতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের এই সমাজতান্ত্রিক ধারণাটা, বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেমন ছিল, তার থেকে একটু ব্যতিক্রমী ছিল। উৎপাদিত ফসলের ভাগ জমির মালিকরা পাবে; যারা শ্রম দেবে, তারা পাবে। আর সমবায়ের একটা অংশ পাবে।”
সমবায়ে সমন্বিত উদ্যোগের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের উন্নয়ন করতে গেলে আমরা যা-ই করি, একটা সম্মিলিত উদ্যোগ থাকতে হবে। আইল হওয়ার ফলে বিশাল একটা জায়গা অনুৎপাদিত থাকে। সেটা যেন না থাকে সে লক্ষ্য নিয়েই তিনি (বঙ্গবন্ধু) কাজ করেছিলেন।
“আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছি। তারপরও আমাদের বহুদূর যেতে হবে। দেশের উন্নয়ন করতে হবে।”
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার লাইন উদ্ধৃত করে তার কন্যা বলেন জাতির পিতা বলেছিলেন, “বাংলাদেশেরএকটি মানুষও না খেয়ে থাকবেন না। আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে। উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।
“এই প্ররিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা, সমবায়ের পথ সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষক সমন্বিতভাবে উৎপাদন ও যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে।”
দেশে একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যত্রতত্র, যেখানে সেখানে কৃষি জমি নষ্ট করে… হয়তো টাকা আছে, ওই টাকা দিয়ে একটা জমি কিনে ফেলল আর ইন্ড্রাস্ট্রি করে ফেলল। আর ইন্ড্রাস্টি করার পরই আমাদের উপর চাপ.. এখানে গ্যাসের লাইন দেন, এখানে বিদ্যুতের লাইন দেন।
“সে কারণে আমরা পরিকল্পিতভাবে... আমাদের চাষের জমি আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। ১৬ কোটি মানষের খাদ্য আমাকে দিতে হবে। সেই সাথে আমাদের উৎপাদনমুখী কার্যক্রম করতে হবে আর উৎপাদনে যেতে হবে। আমরা পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন করতে চাই।”
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব প্রশান্ত কুমার রায়ের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক মো. মফিজুলইসলাম।