বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী কমোডর গোলাম রব্বানী হত্যা মামলায় দুই আসামিকে ‘কম সাজা’ দেওয়া হলেও বিচারিক আদালত এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেনি বলে হাই কোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে এসেছে।
Published : 05 Oct 2016, 07:26 PM
২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরীর বেঞ্চে ওই রায় দেয়। সোমবার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয় বলে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল গাজী মো. মামুনুর রশীদ জানান।
২০০৪ সালের ১১ এপ্রিল মাইক্রোবাসে করে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হন চট্টগ্রামের কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রোসেসিং জোনের (কেইপিজেড) তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর গোলাম রব্বানী। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ দিন পর তার মৃত্যু হয়।
জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের এডিসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করা নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা রব্বানী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও নৌ-পরিবহন বিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জেল হত্যা মামলায় তিনি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য দেন।
ওই হত্যা মামলার রায়ে ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মোহাম্মদ সেলিম, মোহাম্মদ হাশেম ও আব্দুল মালেক সোহেল নামের তিন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু বাকি দুই আসামি কেইপিজেডের সাবেক মহাব্যবস্থাপক আবু নাসের চৌধুরী ও সাবেক প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরীকে দেওয়া হয় পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জারিমানা, অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড।
ওই আদালতের বিচারক এম হাসান ইমাম রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, তদন্তে অনেক ‘দুর্বলতা ও ফাঁকফোকর’ ছিল। তদন্ত কর্মকর্তা অভিযুক্তদের কারও ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ জবানবন্দি নেননি। রব্বানীর পরিবারের কোনো সদস্যকেও সাক্ষী করেননি।
আপিল শুনানির পর হাই কোর্ট আবু নাসের চৌধুরী ও হুমায়ুন কবিরের সাজা বাড়িয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
এছাড়া নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া তিন আসামির মধ্যে মো. হাশেম ও সোহেল হাই কোর্টে খালাস পান; মো. সেলিমের যাবজ্জীবন বহাল থাকে।
হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, “আমাদের এই মত যে, গোলাম রব্বানী হত্যায় ফৌজদারি ষড়যন্ত্র সংগঠনে দণ্ডবিধির ১২০বি/৩০২ অনুসারে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারক সঠিক ও আইনসঙ্গতভাবে আবু নাসের চৌধুরী ও হুমায়ুন কবির চৌধুরীকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তথাপি বিচারক তাদেরকে লঘু সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে ভুল (এরর) করেছেন।
“ওই অপরাধে দণ্ডবিধির ১২০বি অনুসারে সর্বোচ্চ সাজা বা যাবজ্জীবনের বিধান থাকলেও বিচারক তাদেরকে পাঁচ বছরের অপর্যাপ্ত সাজা দিয়েছেন। সামান্য সাজা প্রদানের বিষয়ে রায়ে বিস্তারিত কিছুই আলোচনা করা হয়নি।”
হাই কোর্ট বলেছে, “মামলার প্রমাণাদি, প্রকৃত অবস্থা, পারিপাশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের এই মত যে, বিচারিক আদালতের সাজা বদলানো উচিত এবং বাড়ানো উচিত।”
এ মামলার এজাহারভুক্ত দুই আসামি মানসুর আলম ও সাইফুল ওরফে বিলাই সাইফুলকে নিম্ন আদালতের রায়ে খালাস দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে সাইফুল বিচার চলাকালে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে যান।
এ বিষয়ে হাই কোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “যদিও পালিয়ে যাওয়া কার অপরাধের প্রমাণ হতে পারে না, তবু প্রসিকিউকিউশনের মামলায় তার অপরাধী হওয়ার ক্ষেত্রে শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল বেআইনিভাবে সাইফুল ওরফে বিলাই সাইফুলকে খালাস দিয়েছে।”
সাইফুলের বিষয়ে নতুন রায় দিতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশনা দিয়েছে হাই কোর্ট।
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল গাজী মামুন জানান, বাদীপক্ষ সাইফুলের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করলেও মানসুর আলমের বিরুদ্ধে তা করা হয়নি।
গাজী মামুনুর বলেন, এ মামলার আসামিদের মধ্যে হাশেমের আপিল অন্যদের অনেক আগে হাই কোর্টের শুনানিতে আসে এবং ২০০৮ সালে তিনি খালাস পেয়ে যান। অথব বাকিদের আপিলের রায় হয় ২০১৪ সালে।
হাই কোর্টে হাশেমের রায়ের পর আপিল বিভাগেও গিয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ। সেখানেও তার খালাসের রায় বহাল থাকে।
অন্য আসামিদের তুলনায় ‘অস্বাভাবিক’ দ্রুততায় হাশেমের বিচার নিষ্পত্তিকে আদালতের ‘প্রথা ও বিধি বিরুদ্ধ’ বলেছে হাই কোর্ট।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, “ওই আপিল ও রায়ের অস্বাভাবিক এই শুনানির রিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।”
সোহেলকে খালাসের যুক্তিতে হাই কোর্ট বলেছে, “তার বিরুদ্ধে আমরা কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাইনি। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে অন্য ফৌজদারি মামলা থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন, যেটা সঠিক হয়নি।… তিনি খালাস পাওয়ার যোগ্য।”
এই রায়ের অনুলিপি পাওয়ার আট সপ্তাহের মধ্যে হুমায়ুন কবির, আবু নাসের চৌধুরী ও মো. সেলিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে দণ্ড ভোগ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছেভ
একই সময়ের মধ্যে সাইফুলকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশনা দিয়ে হাই কোর্ট বলেছে, তার জামিন বিবেচনার পূর্ণ স্বাধীনতা বিচারিক আদালতের রয়েছে।