দ্বিতীয় ক্যাটাগরির এই ঘূর্ণিঝড় শনিবার দুপুর থেকে বিকালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করবে বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন।
ঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে উপকূলীয় এলাকা থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বন্ধ করা হয়েছে সব ধরনের নৌ চলাচল।
শুক্রবার আবহাওয়ার সর্বশেষ বিশেষ বুলেটিনে চট্টগ্রাম, পায়রা ও মংলা সমুদ্র বন্দরকে ৭ নম্বর ‘বিপদ সংকেত’ দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কক্সবাজারকে দেখাতে বলা হয়েছে ৬ নম্বর ‘বিপদ সংকেত’।
“বিপদ সংকেতের মানে হচ্ছে, বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতার এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়েছে। ঝড়ে সময় বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার থাকবে।”
আবহাওয়ার বুলেটিনে জানানো হয়, রাত ৯টায় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৬৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৩৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম, পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম এবং মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
সে সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝড়োহাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, “আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখে দেখেছি, ঘূর্ণিঝড়টি এখন ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করছে।”
এই ঝড় আরও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে শনিবার দুপুর বা বিকালে বরিশাল-চট্টগ্রাম অঞ্চলের ওপর দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে আবহাওয়াবিদদের ধারণা।
তবে তার আগে সকাল থেকেই ঊপকূলীয় এলাকায় দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে বলে আবহাওয়ার বুলেটিনে বলা হয়েছে।
এই ঝড়ের প্রভাবে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে বলে আবহাওয়াবিদ সামছুদ্দিন জানিয়েছেন।
গভীর নিম্নচাপ থেকে বুধবার গভীররাতে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছে, যাতে তারা স্বল্প সময়ের নির্দেশে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারে।
কোন সংকেতের কী মানে
# ওয়েদার ডটকম জানিয়েছে, রোয়ানু হয়তো প্রলয়ঙ্করী হয়ে ওঠার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে না, তবে প্রচুর বৃষ্টি ঝরিয়ে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে পাহাড়ি ঢল, আকষ্মিক বন্যা ও ভূমিধসের কারণ ঘটাতে পারে।
# ওই সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ৯৭ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ১২১ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
# আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ওই শক্তির ঘূর্ণিঝড়কে দ্বিতীয় ক্যাটাগরির সাইক্লোন বলা হয়। ঝড়ো হাওয়ার গতিবেগ ঘণ্টায় ১১১ থেকে ১৩০ কিলোমিটার হলে তাকে ধরা হয় তৃতীয় ক্যাটাগরির সাইক্লোন হিসেবে।
# ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, সেই ঝড়ে বাতাসের ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। পঞ্চম ক্যাটাগরির ওই সাইক্লোনকে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে প্রতিকূল আবহাওয়ায় শুক্রবার বিকাল থেকে সারা দেশে নৌ চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। ছবিটি সদরঘাট থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার
রোয়ানুর প্রভাবে ভারতের ওড়িশা ও অন্ধ্র উপকূলে প্রবল বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে। বৃষ্টির কারণে ব্যাপক ভূমিধস ও পাহাড়ি ঢলের খবর পাওয়া গেছে শ্রীলঙ্কা থেকে।
শুক্রবার সকাল থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলো থেকে। জলোচ্ছ্বাস আর ভূমিধসের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরও।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ জানান, উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর জেলা এবং সংলগ্ন দ্বীপ ও চরগুলোতে ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। সে সময় ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার বেগে বয়ে যেতে পারে ঝড়ো হাওয়া।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।
অতি ভারি বর্ষণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসেরও শঙ্কা রয়েছে বলে পূর্বাভাসে সতর্ক করা হয়েছে।
# খারাপ আবহাওয়ার কারণে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের মালামাল খালাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
# চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও সতর্কতামূলক সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে।
# প্রতিকূল আবহাওয়ায় সব ধরনের নৌ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্তৃপক্ষ।
জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, “এ নিয়ে বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আশা করি, ঝড়ো আবহাওয়ায় জানমালের ক্ষতি হবে না বাংলাদেশে। সরকারও ইতোমধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল জানিয়েছেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় ‘সব ধরনের প্রস্তুতি’ রাখা হচ্ছে।
>> ১৮ জেলার সাড়ে ২১ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ৩৮৫১টি আশ্রয়কেন্দ্রে। প্রচার করা হচ্ছে সতর্কবার্তা।
>> দুর্যোগ মোকাবেলার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে উপকূলীয় জেলাগুলোয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
>> উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটির (সিপিপি)৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রোভার স্কাউট ও আনসার ভিডিপির কর্মীরা কাজ করছেন একসঙ্গে।
>> জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ের দুর্যোগ মোকাবেলা সংক্রান্ত কমিটিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে কর্মকর্তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
>> উপকূলীয় এলাকার বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের শুকনো খাবার ও খাবার পানি প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে।