স্বাধীনতা পদক না পেয়ে ক্ষুব্ধ নির্মলেন্দু গুণ

সত্তরের উত্তাল সময়ে যার কবিতা ছড়িয়েছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা সেই কবি নির্মলেন্দু গুণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্বাধীনতা পদক না পাওয়ায়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2016, 11:44 AM
Updated : 20 March 2016, 06:48 AM

ফেইসবুকে এক স্ট্যাটাসে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিবেচনা বোধ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার ‘আমাকে স্বাধীনতা পদক দিন’ শিরোনামে এক পোস্টে কবি লিখেছেন, “আমার একদা সহপাঠিনী, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার দৃষ্টে আমি প্রথম কিছুকাল অবাক হয়েছিলাম- কিন্তু আজকাল খুবই বিরক্ত বোধ করছি। অসম্মানিত বোধ করছি। ক্ষুব্ধ বোধ করছি।”

ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে একই ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন শেখ হাসিনা ও নির্মলেন্দু গুণ।

ফেইসবুক স্ট্যাটাসের বিষয়ে জানতে চাইলে কবি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমিই ক্ষোভ থেকে ওই স্ট্যাটাস দিয়েছি।”

সেখানে তিনি লিখেছেন, “আমাকে উপেক্ষা করার বা কবি হিসেবে সামান্য ভাবার সাহস যার হয়, তাকে উপেক্ষা করার শক্তি আমার ভিতরে অনেক আগে থেকেই ছিল, এখনও রয়েছে।

“পারলে ভুল সংশোধন করুন। অথবা পরে এক সময় আমাকে এই পদকটি দেয়া যাবে, এই ধারণা চিরতরে পরিত্যাগ করুন।”

একুশে ও স্বাধীনতা পদকের কথা বলতে গিয়ে ইতিহাস থেকে কয়েকটি ঘটনাও তুলে ধরেছেন নির্মলেন্দু গুণ।

তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের ‘প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক’ জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে একুশে পদক প্রবর্তন করেন। বঙ্গভবনে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে প্রথমবারের মতো একুশে পদক প্রদান করা হয়। পরে কবি জসীম উদদীন ও বেগম সুফিয়া কামাল একুশে পদকে ভূষিত হন।

“অজানা কারণে আমি ঐ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। কিন্তু তৎকালীন কেবিনেট সচিব শফিউল আজম একুশে পদকের মানপত্রটি ইংরেজিতে পাঠ করার প্রতিবাদ জানালে আমাকে বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে বের করে দেয়া হয়। তাই পুরো অনুষ্ঠানটি আমার দেখার সুযোগ হয়নি, যদিও আমার নিমন্ত্রণ পুরো অনুষ্ঠানের জন্যই বৈধ ছিল।

“সম্ভবত পরের বছর (১৯৭৭) স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে জেনারেল জিয়া একুশে পদকের পাশাপাশি স্বাধীনতা পদক চালু করেন। জিয়ার সবই খারাপ বিবেচনায় জেনারেল জিয়ার বাকি অনেক কিছু পরিত্যাগ করলেও তার প্রবর্তিত একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক প্রদান প্রথাটি শেখ হাসিনা ত্যাগ করেননি। এই পুরস্কার দুটি চালু রাখা হয়।”

২০০০ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করেছিল জানিয়ে গুণ বলেছেন, “কিন্তু সেই পদক তিনি নিজ হস্তে আমাকে প্রদান করে যেতে পারেননি। তখন নিয়ম ছিল প্রাপকের নাম ঘোষণার পরের বছর পুরস্কার দেওয়া। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে বেগম খালেদা জিয়া হাসিমুখে আমাকে একুশে পদক প্রদান করেন।”

তারপর ১৫ বছর কেটে গেছে; যার মধ্যে আট বছর সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এতদিনেও স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত না করায় নির্মলেন্দু গুণের এই ক্ষোভ।

“শেখ হাসিনা স্বাধীনতা পদকের মুলোটি আমার নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। কিন্তু কিছুতেই সেটি আমাকে দিচ্ছেন না।

“উনার যোগ্য ব্যক্তির তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হতে হতে আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্ত সেই তালিকায় আমার স্থান হচ্ছে না।”

কবি নির্মলেন্দু গুণের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক কবিতাই বাংলার মানুষের মুখে মুখে ঘুরে চর্চিত। বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সে সময় তার লেখা ‘হুলিয়া’ দারুণ জনপ্রিয় হয়।ওই কবিতায় ‘আইয়ুব খান এখন কোথায়? শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?’ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকেই ফুটিয়ে তোলেন কবি।

পরে ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’,  ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা- এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’, ‘আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি’ প্রভৃতি শিরোনামে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ককে নিয়ে কবিতা লিখেছেন গুণ।

গত বছর আর্টস ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নির্মলেন্দু গুণ ‘ছাত্রজীবনের বন্ধু’ শেখ হাসিনার সঙ্গে মান-অভিমানের প্রসঙ্গেও বলেছিলেন।

এ বছর স্বাধীনতা পদকের জন্য যে ১৪ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে তাদের মধ্যে সরকারের দুই মন্ত্রী- আবুল মাল আবদুল মুহিত ও ইমাজ উদ্দিন প্রমানিক রয়েছেন।

একাত্তরে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করার স্বীকৃতি হিসেবে এই পদক পাচ্ছেন মুহিত। আর ইমাজ উদ্দিনকে দেওয়া হচ্ছে ১৯৭১ সালে ভারতের মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প, অপারেশন ক্যাম্প ও শরণার্থী ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি হিসেবে।

এছাড়া পাটের জীন রহস্য আবিষ্কার করে সাড়া ফেলে দেওয়া বিজ্ঞানী প্রয়াত মাকসুদুল আলম, রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবক মৌলভী আচমত আলী খান, অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম বীরউত্তম, একাত্তরে রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পুলিশ সদস্যদের সংগঠিত করতে নেতৃত্ব দেওয়া শহিদ শাহ্ আব্দুল মজিদ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে নেতৃত্বদানের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শাহাদতবরণকারী রাঙামাটির তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এম আবদুল আলী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান স্বহস্তে লেখক প্রয়াত এ কে এম আবদুর রউফ, একাত্তরে দিল্লিতে বাংলাদেশের প্রথম মিশন স্থাপনকারী কে এম শিহাব উদ্দিন, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মরহুম রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এবং শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ রফি খান (এম আর খান) এবার পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন।