একাত্তরের বদরপ্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধের দণ্ড কার্যকরের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়েছে; লাল সালুতে মুড়ে তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কারাগারে।
Published : 01 Oct 2015, 02:11 PM
সর্বোচ্চ আদালত এ দুই যুদ্ধাপরাধীর আপিল মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক তাদের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেন।
সম্প্রতি পুনর্গঠিত একমাত্র ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান হিসাবে রয়েছেন বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক। অন্য দুন হলেন- বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম, বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী।
ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক পরোয়ানায় সই করার পর জ্যেষ্ঠ আইন গবেষণা কর্মকর্তা পারভেজ আহমেদের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনালের কয়েকজন কর্মী মাইক্রোবাসে করে তা পৌঁছে দেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, জেল সুপারের কাছে।
এই পরোয়ানার অনুলিপি পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেও। এর মধ্য দিয়ে শুরু হল দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া।
৬৭ বছর বয়সী মুজাহিদ বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন, আর ৬৬ বছর বয়সী সালাউদ্দিন কাদের আছেন কাশিমপুর কারাগারে।
ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমাদের দায়িত্ব ছিল আপিল বিভাগের রায় পাওয়ার পর ডেথ ওয়ারেন্টের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। ট্রাইব্যুনালের আদেশে আমরা তা করেছি। ডেথ ওয়ারেন্ট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপারের কাছে পাঠানো হয়েছে; তিনিই পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।”
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার মো. জাহাঙ্গীর কবির বিকালে কারাফটকে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা দুটি মৃত্যু পরোয়ানা পেয়েছি। একটি পরোয়ানা মুজাহিদকে পড়ে শোনানো হয়েছে। সাকা চৌধুরীর পরোয়ানা কাশিমপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
রাত ৯টার দিকে গাজীপুরের সুরক্ষিত ওই কারাগারে পরোয়ানা পৌঁছায় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান কাশিমপুরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এর তত্ত্বাবধায়ক সুব্রত কুমার বালা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, “আইন অনুযায়ী যেভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা, আমরা সেভাবেই হব।”
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সর্বোচ্চ আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবেন ১৫ দিনের মধ্যে। আসামিপক্ষের রায়ের কপি পাওয়া অথবা আসামিকে রায় শোনানোর মধ্যে যেটি আগে হবে, তখন থেকেই শুরু হবে এই দিন গণনা।
নিয়ম অনুযায়ী, মৃত্যু পরোয়ানার ভিত্তিতেই সরকারের তত্ত্বাবধানে কারা কর্তৃপক্ষ সাজা কার্যকরের প্রস্তুতি নেবে। তবে রিভিউ আবেদন হলে তার নিষ্পত্তি হওয়ার আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।
সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের আপিল মামলায় অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে দুই জনের মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের ইস্যু কপি পেয়েছি। রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করা হবে বলে লিখিতভাবে অবহিত করে রাষ্ট্রপক্ষকে (চিফ প্রসিকিউটর) নোটিস পাঠানো হয়েছে।”
রিভিউ খারিজ হলে আসামিরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন। তাদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাতের সুযোগ করে দেবে কারা কর্তৃপক্ষ।
রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের মীমাংসা হলে সে অনুযায়ী সরকার পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে পাঠানো হবে এবং কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করবে।
আপিল শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ গত ১৬ জুন একাত্তরের বদর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিলের রায় ঘোষণা করে।
একই বেঞ্চ মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আপিলের রায় ঘোষণা করে গত ২৯ জুলাই। দুই রায়েই ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার দণ্ড বহাল থাকে।
বিচারকদের স্বাক্ষরের পর সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা বুধবার মুজাহিদের ১৯১ এবং সাকা চৌধুরীর ২১৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে।
রায় প্রকাশের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটল।”
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে।
সর্বোচ্চ আদালেতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় চলতি বছর ১১ এপ্রিল দ্বিতীয় যুদ্ধাপরাধী হিসাবে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনালে মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
এ দুটি দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে যেসব অনুসরণ করে আসা প্রক্রিয়া এবং তাদের রিভিউ খারিজ করে সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায় মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীর ক্ষেত্রে নজির হিসেবে থাকছে।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে শেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন যে কোনো আসামি। কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামান সেই সুযোগ নেননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে আসামি প্রাণভিক্ষার জন্য কত সময় পাবেন এবং কতদিনের মধ্যে তার নিষ্পত্তি হবে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেওয়া না থাকায় কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা তৈরি হয়।
কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছিল, যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে আসামি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন।
তবে প্রাণভিক্ষার জন্য কারাবিধিতে বেঁধে দেওয়া ৭ থেকে ২১ দিনের সময়সীমা এ মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আসামি প্রাণভিক্ষা চাইলে তার নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।
কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তিনি প্রাণভিক্ষার সুযোগ নেননি। এ কারণে রিভিউ খারিজের দিনই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।
কিন্তু কামারুজ্জামান সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য কয়েক দফা সময় নিলে জটিলতা দেখা দেয়।অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সে সময় বলেছিলেন, ওই সুযোগ নেবেন কি না- তা জানাতে কামারুজ্জামান ‘যৌক্তিক সময়’ পাবেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, একটি ‘মার্সি পিটিশন’ লিখতে যে সময় লাগে এক্ষেত্রে সেটাই ‘যৌক্তিক সময়’ বলে তিনি মনে করেন।
রিভিউ খারিজের পাঁচ দিনের মাথায় ১১ এপ্রিল বিকালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে চাননি।
ওই সন্ধ্যায় আবারও কামারুজ্জামানের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে দেওয়া হয়। রাত ১০টার পর দ্বিতীয় যুদ্ধাপরাধী হিসাবে এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।