তারা বলছেন, হুমকি পেলেও পুলিশের সাহায্য নিতে রাজি নন তারা।
গত ছয় মাসের ব্যবধানে চার ব্লগার হত্যার শিকার হয়েছেন, যাদের সবাইকে খুন করা হয়েছে একই কায়দায়। এসব ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে নানা তদন্ত চললেও কোনো হত্যার রহস্যই উন্মোচন করতে পারেননি তারা, জড়িতদেরও শনাক্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
সর্বশেষ গত শুক্রবার ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে হত্যার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে সিলেট থেকে পাঠানো একটি চিঠিতে বেশ কয়েকজন ব্লগারকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
যদিও কথিত ওই সংগঠন ও হুমকির বিষয়ে পুলিশ কিছু জানাতে পারেননি।
হুমকি পাওয়া মাহমুদুল হক মুন্সির সঙ্গে শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সর্বশেষ ২০ জনের হিট লিস্ট যখন বের হলো তখন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমার কাছে কয়েকজন ব্লগারের ঠিকানা চেয়েছিলেন। আমি যখন সে সব ব্লগারদের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম, তারা কেউই পুলিশের সাহায্য নিতে রাজি হয়নি।”
কেউই এখন আর পুলিশকে বিশ্বাস বা তাদের উপর আস্থা রাখতে পারছে না বলেও জানান তিনি।
নিজেরও পুলিশের উপর খুব বেশি আস্থা নেই জানিয়ে মাহমুদুল হক বলেন, “পুলিশের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা ধর্মান্ধ। আসলে একটা ফোর্সে বিভিন্ন মানসিকতার মানুষ রয়েছে।”
একই সুর ছিলো ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক আরিফ জেবতিকেরও। তিনিও জানালেন, পুলিশের কাছে নিরাপত্তার আশা তার নেই।
“এ হত্যাকাণ্ডের জন্য যারা দায়ী তাদের গ্রেপ্তার করতে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। এ অবস্থায় ঠিক আস্থা বলবো না, আসলে পুলিশের কাছে কোন প্রত্যাশাই নেই।”
আরিফ জেবতিক বলেন, “পুলিশের পক্ষ থেকে ফোন করে খোঁজ খবর নিয়েছে, আমিও ভদ্রতা করে কথা বলেছি। আমি বিশ্বাস করি পুলিশ চাইলেই যে কোন অপরাধীকে ধরতে পারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশ কোন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করবে এমন আশা আমার নেই। এ কারণে আস্থার বিষয়টিও আসছে না।”
পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতার মধ্যেই গত গত ৯ অগাস্ট বাহিনীর প্রধান এ কে এম শহীদুল হক ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো কোনো লেখা না লেখার পরামর্শ দেন ব্লগারদের।
সেই সঙ্গে কারও লেখা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো হলে সে ক্ষেত্রেও পুলিশকে তা জানানোর পরামর্শ দেন তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও প্রায় একই সুরে কথা বলেন পরদিন।
তিনি বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে ব্লগে বা অন্য কোনো মাধ্যমে লেখালেখি করলে তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পুলিশের প্রতি কোনো আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সরাসরি ‘নেই’ বলে জবাব দেন ‘স্ববাক পাখি’ নামে একজন ব্লগার।
তিনি বলেন, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি যেভাবে কথা বলছেন তাতে আস্থা থাকার কোন কারণ নেই। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ফান্ডামেন্টালিস্টে ভরা। তাই কোন ভাবেই তাদের নিরাপদ ভাবছি না।”
আর আস্থাহীনতার জন্য আগে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা দায়ী বলে মনে করছেন ব্লগার নির্ঝর মজুমদার।
“পূর্বে তাদের ধারাবাহিক ব্যর্থতা, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এবং সরকারের রাজনৈতিক অবস্থানের নানান পরিবর্তনের সাথে তাদের আচরণের পরিবর্তন বেশ বড় একটি কারণ।”
দুটি ঘটনা উল্লেখ করে নির্ঝর মজুমদার বলেন, “২০১৩ সালে একইভাবে তারা ব্লগারদের অনেককে নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে বা যোগাযোগ স্থাপন করেছিল এবং তার পরেই চার ব্লগারের আটক আমরা দেখি।”
“দ্বিতীয় ব্যাপারটি হলো তাদের সাংঘর্ষিক এবং আংশিক ভাষণ। অভিজিৎ রায় হত্যা মামলাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে রাফিদা আহমেদ বন্যার বন্ধুদের উপরে সন্দেহ এবং হত্যাকারী শনাক্তকরণের ব্যপারে একটি সাংঘর্ষিক ভাষণ দেওয়া হয়েছিল।”
ধারাবাহিক গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং আগের মামলায় নির্দিষ্ট কোনো তথ্য না পাওয়ার কারণকে অনাস্থা তৈরির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।
নিজের আস্থাহীনতার কথা উল্লেখ করে আরিফুর রহমান বলেন, “এদের ট্র্যাক রেকর্ড এতোই খারাপ যে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিবাদে লোক দেখানো নিরাপত্তার ভান করা আরো সন্দেহের বিষয়।”
“এই আস্থাহীনতার জন্য অনেকগুলি বিষয় জড়িত। প্রথমেই ২৫৬ (ক) ধারা, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা এবং ব্লগারদের উপর করা মামলাগুলি দায়ী।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “এছাড়াও সম্প্রতি সরকারি আইনশৃঙ্খলা কমিটি, পুলিশের আইজি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকলে মিলে ব্লগারদের সীমা লঙ্ঘন না করতে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। যে দেশে সীমা লঙ্ঘনের কোন সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই এবং আইনের অপপ্রয়োগের যথেচ্ছ নজির বিদ্যমান, সেখানে এসব আস্থা আসতে অনেক দেরি হবে।”