শুরু হচ্ছে বইমেলা, বাড়তি দাম রেখে প্রকাশকরাও চিন্তায়

কাগজের উচ্চ মূল্যে বইয়ের দামও বাড়াতে হয়েছে প্রকাশকদের, এখন তারা বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায়।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2023, 07:26 PM
Updated : 31 Jan 2023, 07:26 PM

কাগজের দাম বেশ বেড়েছে, তার ফলে বইয়ের দামও বাড়াতে হয়েছে প্রকাশকদের। আর তা করার পর এখন তাদের দুশ্চিন্তা বিক্রি নিয়ে।

বুধবার শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা, আর এই মেলায়ই বছরের বড় বিক্রিটা করে থাকেন প্রকাশকরা। অপেক্ষায় থাকেন মেলার জন্য। এবার সেই অপেক্ষার সঙ্গে দুর্ভাবনাও যুক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি ও পুথিনিলয় প্রকাশনীর মালিক শ্যামল পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার বইয়ের দাম একটু বেশি রাখা হচ্ছে। ফলে বই বিক্রি নিয়ে কিছুটা শঙ্কা তো রয়েছেই।”

মহামারীর পর ইউক্রেইন যুদ্ধের আঁচ কাগজের দামেও পড়েছে। ডলার সংকটে বিদেশ থেকে কাগজ ও কাঁচামাল (পালপ) আমদানি কমে গেছে বলে বাজারে কাগজের তীব্র সংকট থাকায় বইয়ের দামও বাড়াতে হয় প্রকাশকদের।

গত বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহায়ক বইয়ের দাম সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর শ্যামল পাল বলেছিলেন, “কাগজের দাম তিন গুণ বেড়েছে, আমাদের প্রকাশকদের তো বেঁচে থাকতে হবে।”

প্রকাশকরা যেমন বইমেলার দিকে চেয়ে থাকেন, তেমনি পাঠকদেরও আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে একুশের মাসব্যাপী বইমেলা। আর মেলাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন বই প্রকাশের হিড়িক পড়ে।

সেই বইয়ের বিক্রি নিয়ে প্রকাশকরা শঙ্কিত হলেও তেমনটা মনে করেন না বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বইয়ের দাম একটু বাড়লেও বিক্রিতে তেমন প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। যারা বই কেনার, তারা ঠিকই কিনবেন।”

তবে কাগজের দামের বিষয়টি নিয়ে সরকারের ‘ভাবা উচিৎ’ বলে মনে করেন তিনি। তার মন্তব্য, কারণ প্রকাশনা শিল্পের সাথে মননশীল জাতি গঠনের বিষয়টি জড়িত।

Also Read: কাগজের বাজারের আগুন এবার বইয়ের বাজারে

করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর এবারই ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনই বইমেলা শুরু হচ্ছে। বুধবার বিকাল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাসব্যাপী এ মেলা উদ্বোধন করবেন। এবারের মেলার স্লোগান- ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’।

এবারের মেলায় ৬০১টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে; বড় বিতর্কের পর স্টল বরাদ্দ পাচ্ছে না আদর্শ প্রকাশন।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায় মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে; ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে ৯০১টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১১২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৬৫টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৮৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৩৬টি ইউনিট দেওয়া হয়েছে; থাকছে ৩৮টি প্যাভিলিয়ন।

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত দুই বছর মেলার আয়োজন করা হয়েছিল কিছুটা পিছিয়ে। মেলার স্টলগুলোও রাখা হয়েছিল অনেকটা দূরত্ব রেখে।

তবে এবারের মেলায় সেই স্টল বিন্যাসে পরিবর্তন এসেছে। যাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল।

তিনি বলেন, “বিগত কয়েক বছর অনেক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল স্টলগুলো। এবার স্টলগুলো প্রায় সবই কাছাকাছি করা হয়েছে। মেলার একপ্রান্তে প্রবেশ করলে অন্য প্রান্ত দেখতে পাবেন। এক স্টল থেকে অন্য স্টলে যাওয়াটা সহজ হবে। সব মিলিয়ে এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে।”

তবে স্টলগুলো কাছাকাছি হওয়ায় ছুটির দিনে মানুষের ভিড় সামলানো কঠিন হবে বলে মনে করছেন রামেন্দু মজুমদার। তিনি বলেন, “প্রতি বছরই ছুটির দিন, বিশেষ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি, পহেলা ফাল্গুনে প্রচুর লোক সমাগম হয়। এবার তো স্টলগুলো কাছাকাছি করা হয়েছে, তাই মানুষের চাপ বেশি হলে কিছুটা বিড়ম্বনা হবে।”

তবে স্টল খুঁজে পেতে সহজ হবে জানিয়ে রামেন্দু মজুমদার বলেন, “যেহেতু সবগুলো প্রকাশনীই কাছাকাছি দুরত্বে থাকবে, তাই স্টল খুঁজে পেতে বেশি বিড়ম্বনা পোহাতে হবে না। প্রতি বছরই বইপ্রেমীরা মেলায় এসে স্টল খুঁজে পেতে বিড়ম্বনায় পড়েন। এবার মেলা পরিচালনা কমিটির সভায় বলা হয়েছে তথ্যকেন্দ্রগুলো যেন অনেক বেশি সক্রিয় থাকে। লোকজন যেন সহজেই বিভিন্ন তথ্য জানতে পারে।”

সরেজমিনে বইমেলার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের দম ফেলারও যেন ফুরসৎ নেই। প্রায় সব স্টলেই চলছে রঙ-তুলির কাজ।

বিগত বছরগুলোর মতো ‘পাঠক সমাবেশ’ এবারও প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পেয়েছে। এর কাজ প্রায় শেষ। ফলে মেলার প্রথম দিন থেকেই তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা জানান।

বইমেলায় লেখকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র লিটলম্যাগ চত্বর। এবার লিটলম্যাগ চত্বরকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উত্তর প্রান্তে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাশেই গ্রন্থ উন্মোচন মঞ্চ থাকায় লিটলম্যাগ চত্বরটির প্রতি মেলা পরিচালনা কমিটি ‘অবহেলা করেছে’ বলে মনে করছেন লিটলম্যাগ কর্মীরা।

থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা ক্ষ্যাপার নির্বাহী সম্পাদক অপু মেহেদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছর বইমেলার মাঝখানটাতে ছিল লিটলম্যাগ চত্বর। এবার সেটি মেলার একটা প্রান্তে নেওয়া হয়েছে। তার পাশেই সারাক্ষণ গ্রন্থ উন্মোচন মঞ্চের মাইক বাজবে। ফলে লিটলম্যাগ চত্বরের আড্ডার যে আমেজ, সেটি এবার থাকবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। এবার লিটলম্যাগ চত্বরকে মেলা কমিটি অবহেলা করেছে।”

এবার ১৫৩টিসহ ৫টি উন্মুক্ত স্থানে লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি গেইট দিয়ে প্রবেশ করলে মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে পাওয়া যাবে লিটলম্যাগ চত্বর।

বইমেলায় শিশুচত্বরটি এবার বাংলা একাডেমির মন্দিরের পাশের গেইট দিয়ে প্রবেশের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে।

বাংলা একাডেমি ও অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থা ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। বাংলা একাডেমির ৩টি প্যাভিলিয়ন ও শিশুকিশোর উপযোগী প্রকাশনার বিপণনের জন্য একটি স্টল থাকবে।

মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা স্বাগত বক্তব্য দেবেন। এছাড়া সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বক্তব্য দেবেন।সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির সাতটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ প্রদান করবেন তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে।

মেলার সূচিসহ অন্যান্য

  • বইমেলা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকতে পারবেন না। ছুটির দিনে মেলা সকাল ১১টা থেকে শুরু হবে।

  • ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকাল ৮টায় খুলবে মেলার দুয়ার, খোলা থাকবে রাত ৯টা পর্যন্ত।

  • প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে। প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে।

  • অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকবে। এছাড়া নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে।

বইমেলার আঙ্গিকগত ও বিন্যাসে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে জানিয়ে বাংলা একাডেমি বলছে, মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে গতবারের মূল প্রবেশপথ এবার একটু সরিয়ে বাংলা একাডেমির মূল প্রবেশপথের উল্টো দিকে অর্থাৎ মন্দির-গেইটটি মূল প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আর গত বছরের প্রবেশপথটি বাহির-পথ হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। এছাড়া টিএসসি, দোয়েল চত্বর ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অংশে আরও তিনটি প্রবেশ ও বাহির-পথ থাকবে।

গতবারের ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের স্থানটিকেও এবারের মেলার একটি অংশ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। সেখানে নামাজের স্থান, ওয়াশরুমসহ অন্যান্য পরিষেবা থাকবে।

খাবারের স্টলগুলোকে এবার এমনভাবে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে, তা বইমেলায় আগত পাঠকের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাবে না বলে দাবি করছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ।

বইমেলার প্রবেশ ও বাইর পথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলা এলাকাজুড়ে তিন শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বইমেলা পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত থাকবে।

মেলাপ্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় (সমগ্র মেলাপ্রাঙ্গণ ও দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি হয়ে শাহবাগ, মৎস্য ভবন, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত এবং দোয়েল চত্বর থেকে শহীদ মিনার হয়ে টিএসসি, দোয়েল চত্বর থেকে চাঁনখারপুল, টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত) নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে। মেলার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও নিয়মিত ধূলা নিবারণের জন্য পানি ছিটানো এবং প্রতিদিন মশক নিধনের সার্বিক ব্যবস্থা থাকবে।

মেলার যত পুরস্কার

২০২২ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণগত মানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থের মধ্য থেকে এবার দেওয়া হবে ‘চিত্তরঞ্ছন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’। ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য দেওয়া হবে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’।

২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।

এছাড়া ২০২৩ সালে অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।

সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন যারা

২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীতরা হলেন- কবিতায় ফারুক মাহমুদ ও তারিক সুজাত, কথাসাহিত্যে তাপস মজুমদার ও পারভেজ হোসেন, প্রবন্ধ/গবেষণায় মাসুদুজ্জামান, অনুবাদে আলম খোরশেদ, নাটকে মিলন কান্তি দে ও ফরিদ আহমদ দুলাল, শিশুসাহিত্যে ধ্রুব এষ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় মুহাম্মদ শামসুল হক, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় সুভাষ সিংহ রায়, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশ বিজ্ঞানে মোকারম হোসেন, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনীতে ইকতিয়ার চৌধুরী, ফোকলোরে আবদুল খালেক ও মুহম্মদ আবদুল জলিল।

নানা আলোচনা-সমালোচনা

বরাবরের মতো একুশে বইমেলা বাংলা একাডেমি আয়োজন করলেও এবারের ব্যানার ও আমন্ত্রণপত্রে আয়োজক হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নাম দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর।

তার ওই নির্দেশনায় পর বাংলা একাডেমির স্বায়ত্বশাসন নিয়ে প্রশ্ন তোলেছেন অনেকেই। একাডেমি পর্ষদ দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান, সেখানে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই জানিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে লেখকদের থেকেও।

পরে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘মেলা আয়োজন আগের মতোই হবে’।

তবে বইমেলার মূল ব্যানারে মন্ত্রণালয়ের নাম বা লোগো ব্যবহার না করা হলেও বাংলাদেশ সরকারের লোগো ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এনিয়ে সোমবার বইমেলার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “বাংলা একাডেমির যে আইনটি গেজেট আকারে রয়েছে, সেখানেও সরকারের লোগো রয়েছে৷ এছাড়া একাডেমির অনেক কার্যক্রমে কখনও সরকারের লোগো ব্যবহার হয়েছে, আবার কখনও হয়নি। বইমেলা পরিচালিনা কমিটি সবদিক বিবেচনা করেই সরকারের লোগো ব্যবহার করছে। এতে বাংলা একাডেমির স্বায়ত্বশাসন নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনো কারণ নেই।”

Also Read: একুশে বইমেলার আয়োজক কে? দ্বন্দ্বে সংস্কৃতি সচিব ও বাংলা একাডেমি

এদিকে ফাহাম আব্দুস সালামের ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটি প্রকাশের জন্য এবার স্টল বরাদ্দ পায়নি আদর্শ প্রকাশনী, যা নিয়ে একাডেমির সমালোচনা চলছে।

বইটি নিয়ে আপত্তির বিষয়ে বাংলা একাডেমি বলছে, “আদর্শ-এর বিতর্কিত বইটির ১৫ পৃষ্ঠায় বাঙালি জাতিসত্তা; ১৬ পৃষ্ঠায় বিচার বিভাগ, মাননীয় বিচারপতিগণ, বাংলাদেশের সংবিধান, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় সদস্যবৃন্দ; ২০ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ৭১ পৃষ্ঠায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অশ্লীল, রুচিগর্হিত, কটাক্ষমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। উপর্যুক্ত বক্তব্য বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত মত-প্রকাশের স্বাধীনতা, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বাক ও ভাব-প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থি।”

গত ২৪ জানুয়ারি বাংলা একাডেমিকে দেওয়া এক চিঠিতে আদর্শ জানিয়েছে, “বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় যে বইটি নিয়ে আপত্তি রয়েছে, সেই বইটি মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রি থেকে বিরত থাকব এবং বইমেলার নীতিমালা অনুসরণ করব।”

কিন্তু ২৯ জানুয়ারি বিকালে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সভায় আগের সিদ্ধান্ত বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়; যা রাতেই চিঠির মাধ্যমে আদর্শকে জানানো হয়েছে।

নীতিমালা মানতে চাওয়ার পরও আদর্শকে কেন স্টল দেওয়া হল না- সেই প্রশ্নে কবি নূরুল হুদার উত্তর আসে, “আদর্শ প্রকাশিত একটি বই নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। তার প্রেক্ষিতে মেলা পরিচালনা কমিটি আদর্শকে স্টল না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটি পরিচালনা কমিটির সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে।”

যেভাবে এল বইমেলা

স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেইটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন মুক্তধারা প্রকাশনীর মালিক চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭৭ সালে তার সঙ্গে যোগ দেন আরও অনেকে।

পরে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী একাডেমিকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এরপরের বছরই বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়।

মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ১৯৮৩ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের সেই বইমেলাই এখন বাঙালির মননের মেলায় পরিণত হল।