শীতল বাসে ভাড়ায় উত্তাপ

ভাড়া কত হবে, নেই নীতিমালা। বিআরটিএ বলছে, কেউ তো অভিযোগ করে না।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2023, 07:33 PM
Updated : 2 March 2023, 07:33 PM

ঢাকা থেকে রংপুরের রুটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভাড়া কত? জবাব এক পাওয়া কঠিন।

দূরত্ব এক হলেও এই রুটে কোম্পানিভেদে ভাড়ায় পার্থক্য অনেক। তিনশ কিলোমিটার দূরত্বে হানিফ ও এস আর পরিবহন ভাড়া নিচ্ছে দেড় হাজার টাকা করে। আগমনী এক্সপ্রেসে ভাড়া ১ হাজার ৩০০ টাকা, আবার শাহ আলী পরিবহনে ১ হাজার ২০০ টাকা।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ক্ষেত্রে দেশের প্রতিটি রুটেই এক চিত্র। এর কারণ একাধিক। প্রথমত, কোম্পানি ভেদে বাসের মানে পার্থক্য; দ্বিতীয়ত, ভাড়া কত হবে, সে বিষয়ে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর নীতিমালা না থাকা।

সাধারণভাবে নন-এসি বাসের তুলনায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভাড়া বেশিরভাগ রুটেই প্রায় দ্বিগুণ।

বিআরটিএ যে বাস ভাড়া নির্ধারণ করে, তাতে বাদ পড়ে যায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসগুলো। ফলে কত টাকা ভাড়া আদায় করা হবে, সেটি কোম্পানির ইচ্ছাধীন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সড়ক পরিবহন আইনে রয়েছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভাড়া নিয়ে কোনো অভিযোগ পেলে বিআরটিএ যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবে। তবে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, এখনও এনিয়ে অভিযোগই করেনি কেউ। ফলে তারা উদ্যোগ নেয়নি।

পরিবহন মালিকদের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ১৯৮৪ সালে ‘আর অ্যান্ড কোং’ নামে একটি কোম্পানি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রুটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চালু করে। ১৯৯০ সালে গ্রিনলাইন পরিবহন এবং ১৯৯২ সালে সোহাগ পরিবহন তাদের বহরে এসব বাস যুক্ত করে।

বর্তমানে শ্যামলী, হানিফ, সোহাগ, গ্রিনলাইন, এনা, দেশ ট্রাভেলস, টিআর ট্রাভেলস, সৌদিয়া, সেন্টমার্টিনসহ বিভিন্ন কোম্পানিই দিচ্ছে এই সেবা। বিআরটিসির বহরেও আছে এমন বাস।

তবে সারাদেশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের সংখ্যার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি বিআরটিএ থেকে। পরিবহন মালিকরা সঠিকভাবে বলতে পারছেন না, তবে সংখ্যাটি হাজারের কাছাকাছি বলে ধারণা তাদের।

ভাড়া নির্ধারণ ‘কঠিন’

বিআরটিএর সবশেষ তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে কিলোমিটার প্রতি ২ টাকা ৪৫ পয়সা। আর দূরপাল্লায় ২ টাকা ১৫ পয়সা।

তবে এই ভাড়া ৫২ আসনের হিসাবে। আসন কম হলে ভাড়া বাড়বে আনুপাতিক হারে।

তবে এই সরল হিসাব খাটে না শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে। ফলে ভাড়া সেখানে একেক কোম্পানির একক রকম।

ঢাকার থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৩৮৬ কিলোমিটার। নন-এসি বাসের ভাড়া টোলসহ ১ হাজার ১০০ টাকা।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে এনা পরিবহনের হুন্দাই বিজনেস ক্লাসে (২৮ আসন) ভাড়া ২ হাজার টাকা। একই কোম্পানির ইকোনমি ক্লাসে (৩৬ আসন) ভাড়া ১ হাজার ৩০০ টাকা।

সোহাগ পরিবহনের স্ক্যানিয়া দ্বিতল বাসে (আসন ৪৫টি) গুনতে হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকা, এক তলা বাসে (৩১ আসন) ভাড়া আবার ২ হাজার টাকা।

হানিফ পরিবহনের ভলভোতে (৩৪ আসন) চড়লে দিতে হয় দুই হাজার, সৌদিয়া পরিবহনের (৩২ আসন) দেড় হাজার এবং রয়েল পরিবহনের স্লিপারে (৩২ আসন) এক হাজার ৮০০ টাকা।পরিবহন মালিকদের দাবি, এসব বাসে একই ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া কঠিন।

বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এসব বাস একেকটা একেক রকম। হুন্দাই, ভলভো, স্ক্যানিয়া, মার্সিডিজ, হিনো আরএমটু, মান কোম্পানির বাস আছে।

“হিনো, মিৎসুবিশি, ইসুজু, আশোক লেল্যান্ড, টাটা কোম্পানির বাসের চেসিস আমদানি করে বাংলাদেশে গাড়ির কাঠামো তৈরি হয়। এগুলোকে বাংলা এসি বলা হয়। এসব বাসের আকার এক হলেও ভেতরে সিটিং ক্যাপাসিটি আলাদা।”

“কোনো বাসের (সিট বিন্যাস) টু প্লাস টু, কোনো বাসের টু প্লাস ওয়ান। এ অবস্থায় যে পরিবহন যেমন ফ্যাসিলিটি দিচ্ছে, সে তেমন ভাড়া নিচ্ছে। এ অবস্থায় সব গাড়ির জন্য এক ভাড়া করা সম্ভব না,” বলেন রমেশ।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের যে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা যৌক্তিক কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “অযৌক্তিক ভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই। ধরুন একটি বাসের যৌক্তিক ভাড়া ১৫০০ টাকা। আপনি নিচ্ছেন ১৮০০ টাকা। যাত্রী তো একবার উঠলে আবার দ্বিতীয় দিন উঠবে না।”

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহও বাসের দামের দিকটি দেখান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো বাসের দাম ৫০ লাখ টাকা, আবার কোনোটির দাম আড়াই কোটি টাকা। সেবার মানেও পার্থক্য আছে। ফলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া সম্ভব না।

“এটা করা সম্ভব না, এটা করতে পারে না। গাড়ির সিটেরও ব্যাপার আছে। যেমন আমার হুন্দাই গাড়িতে ২৮ সিট, আবার ৪০ সিটেরও আছে। এখানে দুটি বাসের ভাড়া এক কীভাবে হবে?”

বাস যেখানে বিভিন্ন, সেখানে ভাড়ার হার এক করাটা যৌক্তিক হবে না বলে মনে করেন এনায়েত উল্লাহ।

তিনি বলেন, “নির্ধারণ করতে গেলে মালিকরা আর লাক্সারিয়াস বাস আনবে না। পৃথিবীর কোথাও এটা হয় না। যে যত আধুনিক আরামদায়ক গাড়ি দেবে, সে তেমন ভাড়া নেবে। প্রতিযোগিতার বাজারে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার কোনো উপায় নাই।”

আইনের সীমাবদ্ধতা

২০১৮ সালের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, বিআরটিএ গণপরিবহণের জন্য ভাড়ার হার ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ বা পুনঃনির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল ও বিশেষ সুবিধা সম্বলিত গণপরিবহনের ভাড়া বিআরটিএ নির্ধারণ করতে পারবে না।

তবে আইনে এটাও বলা আছে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেলে কর্তৃপক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল ও বিশেষ সুবিধাসম্বলিত গণপরিবহনের ভাড়া যুক্তিসঙ্গতভাবে নির্ধারণের ব্যবস্থা করতে পারবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএর পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইনের কারণেই বিআরটিএ এসব বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে পারে না। আর এ ধরনের কোনো অভিযোগ বিআরটিএতে কেউ করেনি।

“আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় ওই বিষয়টাতে আমরা হাত দিই না। ভাড়া যে অতিরিক্ত নিচ্ছে, সেটারও তো কোনো মানমাত্রা নেই। কেউ অভিযোগও করছে না। একটি সুনির্দিষ্ট গ্রুপ থেকে যদি কোনো প্রস্তাব থাকে আর মন্ত্রণালয় যদি আমাদের বলে তাহলে আমরা সেটা নিয়ে কাজ করতে পারি।”

যাত্রীদের আপত্তি কি আসলেই নেই?

ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের কোনো আপত্তি না থাকার কথা বাস মালিক কিংবা বিআরটিএ বললেও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে তেমনটা দেখা যায়নি।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাবিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দূরত্ব অনুযায়ী রংপুরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভাড়া বেশি।

“ঢাকা থেকে রংপুরের নন এসি বাসের ভাড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। এসি হলেই তা ১২০০ থেকে ১৫০০ হয়ে যায়। তার মানে একেবারে দ্বিগুণ। এটা কি বেশি নয়?”

মোস্তফা মাহমুদ নামে আরেক যাত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বগুড়ায় এসি বাসের ভাড়া নন এসির সঙ্গে তুলনা করলে দ্বিগুণেরও বেশি। এখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করে, যা যাত্রীদের জন্য বার্ডেন।”