“সব নদী থেকে সাকার মাছ সরিয়ে ফেলার মত সক্ষমতা সরকারের নেই। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন হতে হবে,” বলেন মন্ত্রী।
Published : 24 Jul 2023, 01:45 PM
পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা সাকার মাছকে বিনাশ করতে ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
এই মাছ মানুষ ও জলাশয়ের জন্য ক্ষতিকর জানিয়ে তিনি বলেছেন, সব নদী থেকে সাকার মাছ সরিয়ে ফেলার মত সক্ষমতা সরকারের নেই। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন হতে হবে।
জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের কর্মসূচি জানাতে সোমবার মৎস্য ভবনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী। এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।
দেশে সাকার মাছের বিস্তার নিয়ে এক প্রশ্নে রেজাউল করিম বলেন, “সাকার মাছ আমরা কেউ আমদানি করিনি। আমাদের দেশ নদীমাতৃক। নদীর সংযোগ কিন্তু সমুদ্র থেকে, অন্যান্য সমুদ্র ও নদীর মোহনায়। বিভিন্নভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত মাছও চলে আসে।”
সাকার মাছের বৃদ্ধি খুব দ্রুত হয় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “এটাকে আমরা নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ দিচ্ছি এটি খাবারের জন্য, মানুষের জন্য, জলাশয়ের জন্য ক্ষতিকর।
“বিভিন্ন জায়গায় কিন্তু আমরা ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছি যাতে এই মাছগুলোকে বিনাশ করা যায়। আমাদের সরাসরি ওই রকম সক্ষমতা নেই প্রতিটি নদীতে জাল দিয়ে অথবা মেশিন দিয়ে সাকার মাছকে পৃথক করে ফেলতে পারব।”
সাকার মাছ নিয়ে মানুষকে যত বেশি সচেতন করা যাবে, তত বেশি সফলতা আসবে বলে মনে করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি এ বিষয়ে আরও ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সাকার মাছকে কীভাবে বিনাশ করা যায় সেই পদক্ষেপে যাব।”
কী এই সাকার ফিশ
ইংরেজি নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ, কোনো কোনো দেশে একে কমন প্লেকো বলে। বৈজ্ঞানিক নাম Hypostomus plecostomus।
গায়ে কালোর উপর সোনালি ডোরা কাটা। অমসৃণ শরীর। পিঠের উপরে ও শরীরের দুপাশে বড় কাটার মত ধারালো পাখনা আছে। মুখে আছে ধারালো দাঁত।
তবে এটি শিকারি মাছ নয়। মুখ দিয়ে শুষে খাবার খায়। মুখের আকারে জলহস্তীর সাথে মিল আছে। সে কারণে নামের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘সাকার মাউথ’। আর শিং-মাগুরের মত একই পরিবারের বলে একে বলা হয় সাকার মাউথ ক্যাটফিশ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট বলছে, এ মাছের অনেকগুলো প্রজাতি থাকলেও বাংলাদেশে ছোট আকারের দুই-তিনটি প্রজাতি আছে। এদের খাদ্য মূলত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ। পানি ছাড়াই ২৪ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে এ মাছ।
কোনো দেশেই খাওয়ার মাছ হিসেবে সাকার ফিশের সুনাম নেই। ডোরা কাটা চেহারা আর টিকে থাকার ক্ষমতার কারণে এটি অ্যাকুরিয়ামের মাছ হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। মাছের বর্জ্য ও অন্যান্য ময়লা খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলে বলেও অনেকে অ্যাকুরিয়ামে এ মাছ রাখেন।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ধারণা, বাংলাদেশে কোনো এক সময় হয়ত অ্যাকুরিয়ামে রাখার জন্য এ মাছ আনা হয়েছিল, পরে ধীরে ধীরে মুক্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ মাছের বংশবৃদ্ধির হার খুব বেশি। কম অক্সিজেনেও বাঁচতে পারে। শিকারী মাছ না হলেও সাকার ফিশ জলাশয়ের শ্যাওলা জাতীয় খাবার খেয়ে ফেলে।
এরা সংখ্যায় বেড়ে গেলে তা বাস্তুসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং অন্য মাছের খাবারের সঙ্কট দেখা দেয়। তাতে সব প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন পড়তে পারে।
পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ‘সাকার মাউথ ক্যাটফিশ’ অর্থাৎ সাকার মাছকে গত ২৫ জানুয়ারি দেশে নিষিদ্ধ করে সরকার। এর ফলে দেশে এই মাছের আমদানি, প্রজনন, চাষ, পরিবহন, বিক্রি, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ, মজুদ, লালনপালনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা মাছের খাবারে খারাপ জিনিস মেশায়। তাদের ব্যাপারে অনেক জায়গায় মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থা করেছি, খামারিদের সচেতন করেছি।
“স্থানীয় পর্যায়ে ফিশারিজ অফিসাররা হঠাৎ ভিজিট করছেন। যেখানে এ রকম অবস্থা দেখা যাচ্ছে সেখানেই পদক্ষেপ নিচ্ছি। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন তাদের আরো তৎপর হওয়া দরকার।”
মন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ প্রান্তে যেসব নদী আছে, সেখানে যখন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখা হয়, ভারতের জলবায়ু ও নদীর প্রবাহ দীর্ঘ হওয়ার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিন্তু একই অবস্থা না। আমাদের প্রান্তসীমায় তাদের (ভারত) নদী ও আমাদের নদীতে সমন্বিতভাবে যাতে একই কর্মসূচি নেওয়া যায় সেটা আমরা ওয়াকিংগ্রুপে আলোচনা করব।”
শিগরিগরই বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ বৈঠকে বসবে বলে জানান তিনি।
রেজাউল করিম বলেন, “মানুষের মধ্যে মাছের পুষ্টি পৌঁছে দেওয়া আমাদের লক্ষ্য। এরপর যতটুকু উদ্বৃত্ত থাকে তা রপ্তানি করতে চাই। নিরাপদ মাছের বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করতে চাই। বছর শেষে আমরা প্রতিবেদন প্রকাশ করি, কোন অঞ্চলের মাছে নিরাপদ উপাদানের ঘাটতি আছে।”
‘নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট বাংলাদেশ’- প্রতিপাদ্য নিয়ে সোমবার থেকে আগামী ৩০ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন করবে সরকার। এজন্য সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী জানান, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মঙ্গলবার জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধন করবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হচ্ছে ‘সাকার ফিশ’
সংবাদ সম্মেলনে তথ্য দেওয়া হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। মাছের উৎপাদন বাড়ায় মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬০ গ্রাম থেকে বেড়ে ৬৭ দশমিক ৮০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে।
মন্ত্রী জানান, দেশের মোট জিডিপির ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২২ দশমিক ১৪ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান। দেশের ১৪ লাখ নারীসহ এক কোটি ৯৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্যখাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছ উৎপাদনে পঞ্চম, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে আছে।
জাটকা সংরক্ষেণের সময় চার মাস নিবন্ধিত জেলেদের মাসে ৪০ কেজি করে চাল এবং ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে এই মাছ ধরা বন্ধ থাকার ২২ দিন একেক জেলে পরিবারকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়।
এছাড়া সাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময় নিবন্ধিত জেলেদের মাসে ৪০ কেজি করে ভিজিএফের চাল দেওয়া হয় বলে জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী।
জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে সোমবার সকালে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে একটি শোভাযাত্রা হয়েছে।