“ঈদে কিছু যাত্রী হয়। এবারও আমরা সেই আশায় প্রস্তুতি নিয়েছি,” বলেন একটি লঞ্চের পরিচালক ইসরাফিল সায়িফ।
Published : 28 Mar 2025, 12:20 AM
প্রায় ১৫ বছর ধরে সদরঘাটে কুলির কাজ করেন কাশেম মিয়া। পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলগামী লঞ্চের যাত্রী কমে যাওয়ায় কয়েক বছর হল সকাল ১০টার পরে ফল মার্কেটে কাজ করছেন তিনি।
কাশেম বলছিলেন, “যাত্রী না থাকলে ঘাটে থাইকা লাভ কী। সংসার চালানোর জন্য লঞ্চের টাইম ছাড়া অন্য সময় ফল মার্কেটে কাজ করি।”
ঈদুল ফিতর ঘিরে টানা নয় দিন ছুটি শুরুর আগে সড়ক, রেল ও নৌপথে ঈদযাত্রা শুরু হয়ে গেছে।
কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলগামী লঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী কমার কারণে ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে চিরচেনা সেই ভিড় নেই। বন্ধ হয়ে গেছে অগ্রিম টিকিট কাউন্টার।
যাত্রীদের মালামাল উঠানো ও নামানোর জন্য টার্মিনালের পাঁচ শতাধিক কুলির বেশিরভাগকেই কাজের অভাবে বেকার হয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে।
যদিও এই কুলিরা হলুদ রঙের টি-শার্ট পরে দুদিন আগে থেকেই যাত্রীর অপেক্ষায় আছেন।
এছাড়া ঘাটে যাত্রীদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ও নৌপুলিশদেরও যাত্রীর বাড়তি চাপ না থাকায় তেমন কোনো অভিযোগ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে না বলেছেন দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা।
২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলগামী লঞ্চের যাত্রী কমলেও ঈদের সময় বাসের ভাড়া বৃদ্ধি ও স্বস্তির যাত্রার জন্য অনেকে সড়ক পথ ছেড়ে নৌপথ বেছে নেন। সে কারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছুটা যাত্রীর চাপ বেশি, যে কারণে বাড়তি প্রস্তুতি নিয়েছেন লঞ্চ মালিকেরা।
এছাড়া দীর্ঘ ছুটি থাকার কারণে বাড়ি ফেরার অনেক সময় পাওয়ায় এক সঙ্গে যাত্রীদের চাপ পড়ছে না বলেছেন লঞ্চের কর্মচারীরা।
এক সময় ঈদে বাড়ি ফেরার লঞ্চে ধরার জন্য দুপুরের আগে থেকেই ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রীরা সদরঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করতেন। তখন গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত তীব্র যানজট লেগে থাকতো। অনেক যাত্রীকে সঠিক সময়ে লঞ্চে উঠার জন্য হাঁটতেও দেখা যেত। রোজার শুরু থেকেই সরগরম থাকতো টার্মিনালের কাউন্টারগুলো। কর্মচারীদের দম ফেলার সুযোগ থাকতো না।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর শুধুমাত্র চাঁদপুরগামী লঞ্চ সকাল থেকে নিয়মিত বিরতিতে ছেড়ে যায়। বরিশালগামী কয়েকটি লঞ্চও সকালে ছাড়ে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের অন্য রুটের লঞ্চ সাধারণত বিকাল ৫টার পর থেকে সদরঘাট ছেড়ে যেতে শুরু করে।
তবে বৃহস্পতিবার বিকালে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল গিয়ে চিরচেনা সেই চিত্র চোখে পড়েনি। পন্টুনে বাঁধা সারি সারি লঞ্চ। চাঁদপুরগামী লঞ্চগুলোতে যাত্রীর কিছুটা চাপ থাকলেও বরিশাল-ঝালকাঠি-ভোলা-বরগুনা রুটের লঞ্চগুলো অনেকটাই ফাঁকা। যাত্রীদের টিকিট কেনার হিড়িক নেই।
বিকালে যাত্রী কম থাকলেও সন্ধায় কিছুটা যাত্রীর চাপ বাড়তে দেখা যায় সদরঘাটে। তবে লঞ্চের তুলনায় যাত্রী সংখ্যা একেবারেই কম বলে মনে করে লঞ্চের কর্মচারীরা।
লঞ্চ কর্মচারীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, ভাণ্ডারিয়া ও ঝালকাঠিগামী লঞ্চযাত্রী কমে গেলেও চাঁদপুর, ভোলার চরফ্যাশন, লালমোহন ও বরগুনা রুটের লঞ্চে যাত্রী তেমন কমেনি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিটিসি) কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কয়েক বছর আগে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীর ৩৫ শতাংশ নৌপথে যেতেন। পদ্মা সেতু চালু ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটায় এখন তা প্রায় ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। তখন ঢাকা থেকে ৪৩টি নৌপথে ২২৫টির মত লঞ্চ চলাচল করত। এখন লঞ্চের সংখ্যা ১৯০। যাত্রী সংকটে কমেছে নৌপথও। এখন রুট ৩৫টি। প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৬৫টি লঞ্চ চলে বিভিন্ন পথে।
কয়েকটি লঞ্চের ব্যবস্থাপক ও তত্ত্বাবধায়কদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা থেকে বরিশালগামী লঞ্চের ডেকের ভাড়া ৩০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং ডাবল কেবিনের ভাড়া এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু ঈদের সময় ডেকের ভাড়া ৪০০, সিঙ্গেল কেবিন এক হাজার ২০০ ও ডাবল কেবিনের ভাড়া দুই হাজার ৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
চাঁদপুর রুটের এমভি সম্রাট ৭ এর তত্ত্বাবধায়ক মো. সালাহউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লঞ্চের যাত্রী কমেছে বরিশালে, আমাদের যাত্রী কমেনি। আমাদের যাত্রার সময়ও কম। তিন থেকে চার ঘন্টায় চাঁদপুরে যাওয়া যায়। যার কারণে সারা দিন ধরেই আমাদের যাত্রী নেওয়া আনা হয়। সেজন্য আমাদের পন্টুনে তেমন যাত্রী দেখা যায় না।”
ভোলাগামী কর্ণফুলী ১০ এর কর্মী মাহতাব মিয়া বলেন, “পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আরও কয়েকটি ব্রিজ হয়েছে। যারা দিনে দিনে বাড়ি চলে যাওয়ার চিন্তা করেন তারা ৫/৬ ঘন্টায় বাড়ি চলে যেতে পারেন।
“আমাদের যাত্রীদের মধ্যে এখন যারা রিলাক্সে যেতে চান তারা লঞ্চে কেবিনে যান। আর বাসে ভাড়া বেশি হওয়ার কারণে নিন্ম আয়ের সবাই ডেকে মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে ভোলা চলে যেতে পারে। যে কারণে আমাদের যাত্রী খুব বেশি কমেনি।”
ঈদের ছুটিতে ভোলা যাচ্ছেন ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে একটি হোটেলের কর্মী লায়েক মিয়া।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সবসময় লঞ্চে যাই। বাসে অনেক টাকা ভাড়া।
“যেই টাকা বেতন পাইছি, বাস ভাড়া দিয়ে শেষ করলে কি হবে? লঞ্চে আরামে বাড়ি চলে যামু। ডেকের ভাড়া কম, তারা ৩০০-৪০০ নেয়। আমরা দরকষাকষি করে করে ২০০-২৫০ টাকা দিই। ঈদে একটু বেশি নেয়।”
সুন্দরবন লঞ্চে বরিশাল যাওয়ার জন্য উত্তরা থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সদরঘাটে এসেছিলেন একটি বায়িং হাউজের কর্মরত মো. ইব্রাহিম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই তিন বছর ধরে কেবিনের জন্য হাহাকার নাই। আজ এসেই কেবিন পেয়ে গেছি। যদিও কালকে কেবিনের সংকট পড়তে পারে, তাই আজকেই চলে যাচ্ছি। এক সময় ঈদের সপ্তাহ খানেক আগেও লঞ্চের কেবিন পাওয়া যেত না।
“পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে বাসেই বেশি যাতায়াত করি। কিন্তু ঈদে পরিবার নিয়ে নিরাপদে যাওয়ার জন্য লঞ্চেই বাড়িতে যাচ্ছি।”
এই লঞ্চের কর্মী আবির হোসেন বলেন, “আগে এমন সময় লঞ্চে যাত্রী জায়গা দেওয়া যেত না, আমাদের আয়ও বেশি হতো। এখন তো যাত্রীই নাই। অর্ধেক খালি অবস্থায় লঞ্চ ছাড়তে হবে আজকে।”
এমভি রয়েল ক্রুজ-২ এর পরিচালক ইসরাফিল সায়িফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারা বছর তেমন যাত্রী থাকে না। ঈদে কিছু যাত্রী হয়। এবারও আমরা সেই আশায় প্রস্তুতি নিয়েছি। আশা করি শুক্রবার থেকে যাত্রী আরও বাড়বে।”
টিকিট বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখন তো যাত্রী নাই। টিকিট লঞ্চেই দেওয়া হয়। আর কেবিন সব সময়ই কিছু না কিছু খালি থাকে। তাই আর কাউন্টার দরকার হয় না। মালিকদের লঞ্চের হিসাবের জন্য কাউন্টার রাখা আছে। সেখানে লঞ্চের হিসাব হয়।”
ঈদযাত্রায় নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে সদরঘাট নৌ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহাগ রানা বলেন, “আনসার, নৌ-পুলিশ, ফাঁড়ির পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনীসহ প্রায় ছয় সাতটা বাহিনী সদরঘাট নিরাপদ রাখার জন্য কর্মরত রয়েছে। নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নেই, তবে নিরাপত্তা যাদের দিব সেই যাত্রী সংখ্যা খুবই কম।
“সদরঘাটের আশেপাশের ফুটপাত দখলমুক্তকরণ, সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণসহ যাত্রীদের সহায়তার জন্য সারাক্ষণই কাজ করে যাচ্ছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।”
সদরঘাটের আনসার কমান্ডার মোহাম্মদ মনির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিটি লঞ্চে চারজন করে সশস্ত্র আনসার মোট ১৪৯টা লঞ্চে মোতায়ন করা হয়েছে। লঞ্চের ভেতরে যাত্রীদের যেকোনো ধরনের হয়রানি প্রতিরোধে তারা কাজ করবে এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।”
নৌ পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ নয়ন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্যবারের মত এবারও নৌ মন্ত্রণালয় থেকে ঈদে অতিরিক্ত ভাড়া ও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন না করার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। নৌপথে যাত্রী খরার কারণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কোনো সুযোগ নেই।”
তিনি বলেন, “অন্য সময়ে লোকসান পোষাতে ও যাত্রী ধরে রাখতে লঞ্চ মালিকরা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অনেক কম নিয়ে থাকেন। ঈদের মৌসুমেই কেবল নির্ধারিত ভাড়া আদায়ের সুযোগ পান। সেটাও তুলনামূলক কম।
জ্বালানি তেলের মূল্য, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে নির্ধারিত ভাড়া নিয়েও ক্ষতি পোষানো যায় না।”