সেই সার্চ কমিটিতে যেন কোনোভাবেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার তাগিদও দেওয়া হয়েছে।
Published : 14 Sep 2024, 08:39 PM
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিধান মেনে সার্চ কমিটি গঠন করেই নির্বাচন কমিশন গঠনের পরামর্শ উঠে এসেছে এক আলোচনায়। তবে সেই সার্চ কমিটিতে যেন কোনোভাবেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকতে না পারে, সে বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ’ শীর্ষক এক সংলাপে এই পরামর্শ উঠে আসে।
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে এই আলোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ছাড়াও ছিলেন রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও শিক্ষার্থীরা।
ছাত্র-জনতার প্রবল গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পদত্যাগ করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
নৌ পরিবহন এবং বস্ত্র পাট উপদেষ্টা ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন তিন স্তরের একটা সার্চ কমিটির প্রস্তাব করেন।
তিনি বলেন, “প্রথম স্তরে একটি কমিটি হবে; যেখানে নাগরিক সমাজ থাকতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা থাকতে পারে এবং কিছু অফিশিয়াল থাকতে পারে, যেমন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
“এখান থেকে সাধারণ নামগুলো পাওয়া যাবে। ধরুন, ১০০ নাম আসবে। সেখান থেকে ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী নামগুলো তারা বের করবে। তারপর বাছাই করে দ্বিতীয় ধাপে পাঠাবে।”
তার পরামর্শ, দ্বিতীয় স্তরে একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি থাকবেন প্রধান। তারা নামগুলো বাছাই করবেন। একেকজন কমিশনারের জন্য ৪টা হোক বা ৫টা নাম যাবে তৃতীয় স্তরে।
সংসদ বহাল থাকলে সেই নামগুলো যাবে ‘পার্লামেন্ট বিজনেস কমিটিতে’। এই কমিটিতে যত জন সরকারি দলের লোক থাকবে, ততজন বিরোধী দলের লোক থাকবে।
এই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশন ও অন্য একেকটি কমিশনারের জন্য অন্তত দুটি করে নাম পাঠাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। তিনি তাদের থেকে কাউকে বাছাই করবেন। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কিছুই যাবে না।
সাখাওয়াত চাইছেন নির্বাচন কমিশনে যারা আসবেন, তাদের বয়স ৪০ থেকে ৪৫ হতে হবে।
“যেহেতু নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিষয়, তাকে প্রাজ্ঞ হতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রশাসনিক সিস্টেম এবং এটাকে পরিচালনা করার মতো দক্ষতা থাকতে হবে, নিরপেক্ষ হতে হবে। মাঠ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা থাকতে হবে।”
নির্বাচন কমিশনে এক মেয়াদে দায়িত্ব পালন ও পরে রাজনীতি পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, “যত ভালো কমিশন গঠন হউক ভালো নির্বাচন করতে হলে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজন। এটা কীভাবে হবে, সেটা রাজনৈতিক দলগুলো মিলে ঠিক করবে।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমাদের যে সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন, সেখানে নাগরিক সমাজের যে দুজন প্রতিনিধি ছিলেন, তারা দুঃখজনকভাবে ‘সরকারের প্রতিনিধিত্বই’ করেছেন। এমন দুটি দলকে তারা অনুমোদন (নিবন্ধন) দিয়েছেন, যাদের কেউ চেনে না।
“আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়া উচিত রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তিতে। এবং আমরাও সেটা প্রস্তাব করেছি। আমরা প্রস্তাব করেছি যে, ৬ থেকে ৭ জন নিয়ে একটা অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটি হবে। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি থাকবেন, বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীর একজন প্রতিনিধি থাকবেন। এবং সংসদের যে তৃতীয় বৃহত্তম দল, তাদেরও একজন প্রতিনিধি থাকবে। একইসঙ্গে একজন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি থাকবে, একজন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি থাকবে।”
সার্চ কমিটি সরকার নির্ধারণ করবে না এবং কমিটির জন্য যেসব নাম জমা পড়ে, সেগুলো আগেই প্রকাশ করতে হবে, এমন একটি প্রস্তাবও দেন বদিউল।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ও জোট করে চারটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এবং ভেঙে দেওয়া সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “নির্বাচন কমিশন নিয়োগে সংবিধানের কয়েকটি ধারা সংশোধন করতে হবে। সার্চ কমিটি রিভিউ করা প্রয়োজন।
“আমাদের যদি সার্চ কমিটি করতে হয়, সেখানে এমন একটা ফরম্যাট আসতে হবে, গত ৩০-৪০ বছরের অনেক কিছু সেখানে আসবে এবং ভবিষ্যৎ ৩০-৪০ বছরের জন্য নিরপেক্ষ লোক দিতে পারবে।
“সব সাবেক প্রধান বিচারপতি, সব রাষ্ট্রপতি, সব স্পিকার এ ধরনের ক্রাইটেরিয়া আনতে হবে। মূল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে যখন যে সরকার থাকবে সে যেন সার্চ কমিটি এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়োগটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।”
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের মুখ্য পরিচালক আব্দুল আলীম ‘স্বাধীন’ নির্বাচন কমিশন গঠনে পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরেন।
সরকারি ও নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় পেশাদারদের নিয়ে স্বাধীন সার্চ কমিটি গঠন, কমিশনে কখনও সরকারের সুবিধাভোগীদেরকে নিয়োগ না দেওয়ার আইন করা, কমিশনের জন্য উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকলেও এমন একটি প্রক্রিয়া নির্ধারণ, যেখানে তারা একমত থাকবে এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কমিশনে নিয়োগ দেবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন দেখতে চান বলে জানিয়েছেন।
দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহকারী সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেন, “সার্চ কমিটির মাধ্যমে পাওয়া নাম নিয়ে আবার রাজনৈতিক দলের কাছে ফিরে যেতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো এর সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার।”
সংলাপে জামায়াতের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নূর, গণফোরামের একাংশের নেতা সুব্রত চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলনের আশ্রাফ আলী আকন্দও সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।
এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের চিফ অব পার্টি ডানা এল ওল্ডস।