“তাদের (জুলাই শহীদদের) রক্তের সাথে গাদ্দারি হয় এমন কোনো কাজ, কোনো পদক্ষেপ যেন আমাদের তরফ থেকে সংঘটিত না হয়, সেই তৌফিক আমাদের দান করেন মওলা।”
Published : 31 Mar 2025, 10:40 AM
বছর ঘুরে আবারও উৎসবের বার্তা নিয়ে এসেছে ঈদুল ফিতর।
এক মাস রোজা শেষে সোমবার ঈদের সকালে ঢাকার জাতীয় ঈদগাহসহ সারাদেশের ঈদগাহ আর মসজিদে মসজিদে ঈদের জামাতে অংশ নেন লাখো মুসলমান।
বরাবরের মত এবারও ঈদের প্রধান জামাত হয় হাই কোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহে। নামাজ শেষে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের জন্য দোয়া করা হয়। আহতদের জন্য সুস্থতা কামনা করা হয় আল্লাহর কাছে।
দেশের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে বাংলাদেশকে একটি আদর্শ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যাশা জানানো হয় ঈদের মোনাজাতে।
সকাল সাড়ে ৮টায় এই জামাতে ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ আবদুল মালেক।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানসহ উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সচিবসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ শামিল ছিলেন জাতীয় ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাতে।
নামাজ ও খুতবা শেষে জাতির উদ্দেশে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। সেখানে সবার প্রতি ঈদ মোবারক জানান তিনি। পরে মোনাজাতে দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায় দোয়া করা হয়।
মুফতি মোহাম্মদ আবদুল মালেক মোনাজাতে সবার গুনাহ মাফ করে দিতে, ঋণমুক্ত জীবন দিতে, সকল অসুস্থ ব্যক্তিকে নিরাময় দিতে, সকলের ‘পেরেশানি’ দূর করতে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানান।
তিনি বলেন, “পুরো মুসলিম বিশ্বকে আপনি হেফাজতে রাখেন। মজলুম মুসলিম উম্মতকে জুলুম থেকে রক্ষা করেন। জালিমদেরকে জুলুম থেকে বিরত রাখার হিম্মত দান করেন। ঈমানি শক্তি বাড়িয়ে দেন।
“আমাদের এই দেশকে আপনার বিশেষ হেফাজতে রাখেন। এই দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যে মুরুব্বিরা আছেন, তাদের হেফাজত করেন, তাদের হিম্মত আরো বাড়িয়ে দেন। সবাইকে আপনার হেফাজতে রাখেন।”
সকল অকল্যাণ থেকে হেফাজত করার আর্জি জানিয়ে ইমাম মোনাজাতে বলেন, “এই দেশের বিরুদ্ধে যেখানে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, আপনি সব ষড়যন্ত্র বরবাদ করে দেন। এই দেশকে আদর্শ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার তৌফিক দান করেন। দেশের প্রত্যেক নাগরিককে শৃঙ্খলা রক্ষা করার তৌফিক দান করেন। এই দেশের কল্যাণে যারা যেখানে কাজ করছে, তাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করেন।”
২০২৪ সালে জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণ করে তিনি বলেন, “আল্লাহ, এই ভাইদেরকে… যারা আমাদেরকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, শহীদ হয়ে গেছেন, আল্লাহ আপনি তাদের শাহাদাৎকে কবুল করেন। আহত হয়ে আছেন, আল্লাহ তাদের পূর্ণ সুস্থতা দান করেন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন, সেই তৌফিক নসিব করেন
“দেশের সবাইকে এই ভাইদের রক্তের কদর করার তৌফিক দান করেন। তাদের রক্তের সাথে গাদ্দারি হয় এমন কোনো কাজ, কোনো পদক্ষেপ যেন আমাদের তরফ থেকে সংঘটিত না হয়, সেই তৌফিক আমাদের দান করেন মওলা।
মোনাজাতে তিনি বলেন, “দেশের মধ্যে অমুসলিম যারা অবস্থান করছে, আল্লাহ, তারা যেন নিরাপত্তার সাথে, আরো বেশি নিরাপত্তার সাথে থাকতে পারে, সেই তৌফিক তাদেরকেও দান করেন, আমাদেরকেও দান করেন।”
নামাজ শেষে কোলাকুলি আর করমর্দনে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন সবাই।
জাতীয় ঈদগাহ মাঠে প্রথমবার এসেছেন শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন রাফে। রাজধানীর ডেমরা থেকে আসতে খুব সকালে রওয়ানা দিতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কখনও জাতীয় ঈদগাহে নামাজ পড়িনি। বড় ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম আসলাম। বড় মাঠে অনেক মানুষের সঙ্গে নামাজ পড়লাম, খুবই ভালো লেগেছে।”
বছর পাঁচেক বয়সী সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে আজিমপুর থেকে আসা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জাতীয় ঈদগাহ মাঠে নামাজ শেষে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোহাম্মদ ইউনূস আসবেন এটা শুনে চলে আসলাম খুব সকালেই। তিনি যে বক্তব্য দিবেন তা কল্পনাও করিনি।
“তিনি কত সাধারণ কথায় গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলে দিলেন। এটাই তো চাই, রাজনীতিবিদদের কাছেও আমাদের প্রত্যাশাটা থাকবে, তারা সাধারণ মানুষের জন্য ভাববেন। দেশের জন্য ঐক্যর কথা বলবেন।”
সকালের সূর্যদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দূর দূরান্ত থেকে সব বয়সীরা ছুটে আসেন ঈদগাহ ময়দানে। সবার গায়ে নতুন পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। অনেকের হাতে ছিল জায়নামাজ। শিশু-কিশোররা আসে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে।
জাতীয় ঈদগাহ মাঠে এবারও প্রবেশ করতে হয়েছে সারিবদ্ধভাবে। প্রধান ফটকে বসানো আর্চওয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নিরাপত্তা রক্ষায়।
ঈদগাহে ঢুকতে প্রধান ফটক থেকে মানুষের লাইন চলে যায় পল্টন মোড় পর্যন্ত। উত্তরে লাইন ঠেকে মৎস্য ভবন মোড় ও দক্ষিণে বঙ্গবাজার পর্যন্ত।
ঈদ গা ময়দানে সহজে প্রবেশ ও বের হতে মাঠের আশপাশ মৎস্য ভবন, বঙ্গবাজর, পল্টন, জিপিও মোড় ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী।
এ বলয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে বেরিকেড দেওয়া হয় পুলিশ। পল্টন মোড়, মৎস্য ভবন, বঙ্গবাজার, দোয়েল চত্বর মোড়ে গাড়ি চলার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঈদগাহ ময়দানে যেতে বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে হয়।
এবার ঈদগাহে ৩৫ হাজার নারী-পুরুষের নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা ছিল বলে জানিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
নারীদের জন্য মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে পর্দার আড়ালে নামাজের ব্যবস্থা ছিল। যেখানে প্রবেশে পৃথক ফটকের ব্যবস্থাও রাখা হয়।
ঈদগাহ প্রাঙ্গণে ছিল অজুর ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, পুলিশ, র্যাবের কনট্রোল রুম। ফায়ার সার্ভিসের একটি দলও জাতীয় ঈদগাহের মাঠের পাশে ছিল।
প্রতিবছরের মত এবারও ঈদের দিন পাঁচটি জামাত হচ্ছে ঢাকায় বায়তুল মোকাররমে। সকাল ৭টায় প্রথম, সকাল ৮টা দ্বিতীয়, সকাল ৯টায় তিনটি জামাত হয়। সকাল ১০টায় চতুর্থ জামাতের পর পঞ্চম জামাত হবে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে।