ছোট মেয়েকে একদিন পাবে বাবা, একদিন জাপানি মা

দুই শিশুকে জাপানি মায়ের জিম্মায় রাখার যে রায় হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে আপিল শুনানি হবে ১৬ ফেব্রুয়ারি।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Feb 2023, 10:36 AM
Updated : 2 Feb 2023, 10:36 AM

দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশি বাবা ও জাপানি মায়ের মধ্যে আইনি লড়াইয়ের মধ্যে এলো নতুন এক আদেশ। দুই মেয়েই মায়ের কাছে থাকবে বলে থেকে আদেশ আসার চার দিনের মাথায় অন্য একটি আদালত বলেছে, ছোট মেয়েটি একদিন থাকবে বাবার কাছে, একদিন মায়ের কাছে।

দুটি মেয়েরই মায়ের কাছে থাকার বিষয়ে যে আদেশ এসেছিল গত রোববার, তার বিরুদ্ধে বাবার আবেদনের শুনানির আগ পর্যন্ত ছোট মেয়েটিকে এভাবে ভাগাভাগি করে পাবেন বাবা ও মা।

ঢাকার মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ বৃহস্পতিবার এই সিদ্ধান্ত দেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন মেয়ে দুটির বাবা ইমরান শরীফের আইনজীবী নাসিমা আক্তার লাভলী।

গত ২৯ জানুয়ারি আদালতের আদেশের পর ৯ বছর বয়সী ছোট মেয়েটিকে তার মায়ের হাতে তুলে না দিয়ে আত্মগোপনে যান ইমরান। ১১ বছর বয়সী বড় মেয়েটি থাকে মা নাকানো এরিকোর কাছে।

ছোট মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তার মা গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। দুই দিন পর বুধবার গুলশানের কালাচাঁদপুর থেকে বাবা-মেয়েকে উদ্ধার করে সেইফ কাস্টডিতে নিয়ে যায় র‌্যাব। সকালে গুলশান থানার এসআই মামুন মিয়া আসামিদের আদালতে হাজির করেন।

আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদেরকে ৯ বছর বয়সী মেয়েটি বলে, “আমি বাবাকে ভালোবাসি। বাংলাদেশে থাকতে চাই। মায়ের কাছে যাব না।”

ইমরান শরীফ বলেন, “সে আমার কাছে থাকতে চায়, মায়ের কাছে যাবে না। কিন্তু ওর মা ওর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে ওকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ও যেতে রাজি না। আমি বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন।”

বড় মেয়েকে নিয়ে আদালতে আসেন মা নাকানো এরিকোও। তার পক্ষে শুনানিতে ব্যারিস্টার শিশির মনির ছোট মেয়েকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন।

অন্যদিকে ইমরানের পক্ষে শুনানিতে নাসিমা আক্তার লাভলী মেয়েটিকে বাবার হেফাজতে রাখার আবেদন করেন।

ছোট মেয়েটি বিচারকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে শুনানি শেষে তিনি খাস কামরায় তার কথা শোনেন। পরে আদেশ দেওয়ার আগে বলেন, “সে বাবার কাছে থাকতে চায়, না হয় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে যেতে চায়। সে মায়ের সঙ্গে জাপানে যেতে চায়নি। তবে বলেনি যে, মায়ের কাছে থাকবে না।”

পরে বিচারক মামুনুর রশীদ সিদ্ধান্ত দেন, ছোট মেয়েটি শুক্রবার বেলা ১১টা পর্যন্ত বাবার কাছে থাকবে। এরপর তার বাবা তাকে বুঝিয়ে দেবে গুলশান থানাকে।

২৪ ঘণ্টা মায়ের কাছে থাকার পর আবার মেয়েটি ফিরে যাবে বাবার কাছে। এভাবে চলবে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। শিশু দুটি মায়ের কাছে থাকবে বলে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান যে আদেশ দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে ঢাকা জেলা জজ আদালতে আপিলের শুনানি হবে সেদিন।

মায়ের জিম্মায় যেসব কারণে

পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান মেয়ে দুটিকে তার মায়ের কাছে দেয়ার আদেশে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বাবা, মা এবং দুই মেয়ের সবশেষ বসবাসের স্থান জাপান হওয়ার কারণে বাংলাদেশের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ৬ (১) অনুযায়ী এই মামলা এভাবে চলতে পারে না।

আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জাপানে থাকার সময় দুটি শিশুই পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। বাবা তাদেরকে বাংলাদেশে আনার পর নবোদয় প্রি-ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করান। একইসঙ্গে আমেরিকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে শিক্ষাদান চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তবে জেরায় বলেছেন, মেয়েদেরকে তিনি কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি করেছেন। আরজি দাখিলের সময় তারা সেই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল না।

বিচারক এও বলেছেন, শিশু দুটির পড়াশোনার বিষয়ে তাদের বাবার সিদ্ধান্ত তাদের কল্যাণ বয়ে আনবে না বলে মনে করেন তিনি।

মেয়ে শিশু দুটিকে নিয়ে জাপানের টোকিও পারিবারিক আদালতেও মামলা হয় এবং সেই মামলায় প্রথম থেকে লড়েন তাদের বাবা। সেখানে মামলায় লড়ার মধ্যে বাংলাদেশে আরও একটি মামলা করা কোনো সাধারণ যৌক্তিক চিন্তায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলেও মনে করেন বিচারক।

তিনি এও বলেছেন, দুই মেয়ের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে এটা বাধা তৈরি করবে এবং এটি তাদের ভবিষ্যত বিকাশে কল্যাণকর হওয়ার সুযোগ নেই।

মাকে না জানিয়ে জাপান থেকে মেয়ে দুটিকে নিয়ে আসারও সমালোচনা করেছেন বিচারক। তিনি মনে করেন, কোনো আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদের অভ্যাসগত বাসস্থান থেকে হঠাৎ অন্য একটি দেশে নিয়ে আসার এই বিষয়টি মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন রূপকে অসম্মান করার নামান্তর।

দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক, নথি পর্যালোচনা এবং মেয়েদের সঙ্গে খাস কামড়ায় একান্তে আলোচনা করে তাদের স্বার্থের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথাও জানান বিচারক। বলেন, রবাবা ও মায়ের স্বার্থের উপরে রায়ে প্রাধান্য পেয়েছে মেয়েদের মঙ্গল ও নিরাপত্তার বিষয়টি।

দুই শিশুকে নিয়ে বাবা মায়ের বিরোধের আদ্যোপান্ত

প্রকৌশলী ইমরান শরীফ জাপানে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে সে দেশের চিকিৎসক নাকানো এরিকোর বিয়ে হয় ২০০৮ সালে। তাদের ঘরে তিন কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।

দাম্পত্য কলহের জেরে ২০২১ সালের শুরুতে বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো। এরপর ইমরান স্কুলপড়ুয়া বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোট মেয়ে জাপানে এরিকোর সঙ্গে থেকে যান।

মেয়েদের জিম্মা পেতে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২১ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে আসেন এই জাপানি নারী। তিনি হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে তাদের সমঝোতায় আসতে বলেন বিচারক।

কিন্তু ওই দম্পতি সমঝোতায় না আসায় কয়েক মাস ধরে শুনানির পর ওই বছরের ২১ নভেম্বর হাই কোর্ট দুই সন্তানকে বাবার হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত দেয়। পাশাপাশি মা যাতে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বাবাকে খরচ দিতে বলা হয়।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেছিলেন মা নাকানো। পরে আপিল বিভাগ ওই বছর ১৫ ডিসেম্বর এক আদেশে শিশু দুটিকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিলেও বাবা তা না মানায় বিচারকরা উষ্মা প্রকাশ করেন।

পরে আদালত শিশু দুটিকে বাবার হেফাজত থেকে এনে তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং পরে মায়ের হেফাজতে দেওয়ার আদেশ দেয়।

এরপর আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয়, দুই মেয়ে কার জিম্মায় থাকবে তার নিষ্পত্তি পারিবারিক আদালতে হবে এবং তার আগ পর্যন্ত দুই শিশু তাদের মায়ের কাছেই থাকবে। ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই রায় দেওয়া হয়। এরপর আপিল বিভাগ থেকে মামলাটি পারিবারিক আদালতে আসে।

এসব ঘটনার মধ্যে ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে দুই সন্তান নিয়ে জাপানে যাওয়ার জন্য ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন এরিকো নাকানো। আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় তাকে বিমানবন্দর থেকে পুলিশ ফিরিয়ে দেয়।

এ ঘটনায় নাকানোর বিরুদ্ধে অপহরণ ও প্রতারণার অভিযোগ এনে গত ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করেন ইমরান শরীফ। সেখানে নাকানোর বিরুদ্ধে দুই সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ করা হয়। আদালত বাদীর জবানবন্দি শুনে পিবিআইকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলে।

এ মামলায় উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২৯ জানুয়ারি ইমরানের মামলাটি খারিজ করে দেয় আদালত।

সেদিনই বড় মেয়েটি সাংবাদিকদেরকে বলে, “আজকের এই দিনের জন্য আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি এখন নিজ বাড়িতে ফিরতে পারব। এই রায়ের ফলে আমার মতো ভুক্তভোগীরা ভবিষ্যতে সুরক্ষা পাবে। আমি বাংলাদেশকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

বাবাকে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সে বলে, “অবশ্যই বাবাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। তিনি যখনই দেখা করতে চাইবেন, আমি তাকে স্বাগত জানাব।”

রায় ঘোষণার পর সন্তোষ প্রকাশ করে শিশুটির মা নাকানো এরিকো বলেন, “আমি এই দিনটির জন্য দেড় বছর ধরে অপেক্ষা করেছি। আমি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি সত্যিই কৃতজ্ঞ।”

আদালতের রায়ের পর বাবা ইমরান শরীফের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে এই রায়ে সংক্ষুব্ধ জানিয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন বাদীপক্ষের আইনজীবী নাসিমা আক্তার লাভলী।

তবে আদালতের আদেশ অমান্য করে ছোট মেয়েকে মায়ের হাতে তুলে না দিয়ে আত্মগোপনে যান বাবা। বুধবার দুই জনকে হেফাজতে নেয় র্যাব।

এর দুই দিন পর ৩১ জানুয়ারি রাতে বড় মেয়েকে নিয়ে জাপান যাওয়ার চেষ্টা করার সময় মা নাকানো এরিকোকে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ।

এর আগেও দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তখনও তাদেরকে আটকে দেয়া হয়।