Published : 27 Apr 2025, 09:25 PM
অন্যের মধ্যস্থতায় কিংবা নিজেরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান যাতে সমস্যার সমাধান করে ফেলে, সেই প্রত্যাশার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা ঘিরে দুদেশের মধ্যে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে রোববার তিনি ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ চায় না, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এমন কোনো সংকটের সৃষ্টি হোক, যা এই অঞ্চলের জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
“আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। আমরা শান্তি চাই দক্ষিণ এশিয়ায়। আমরা জানি, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন বিভিন্ন ইস্যুতে সংঘাতময় সম্পর্ক আছে। কিন্তু আমরা চাই না এখানে এমন বড় কোনো সংকট সৃষ্টি হোক, যেটা এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বিপদের কারণ হয় উঠতে পারে।”
অন্তবর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান বলেন, “ভারত ও পাকিস্তান দুদেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান, আমরা চাইব তারা দুপক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে ফেলুক।
“আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, বিদেশের কাছ থেকে মধ্যস্থতার প্রস্তাবও এসেছে; যেভাবে হোক মধ্যস্থতার মাধ্যমে হোক অথবা দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হোক, আমরা চাই যে, উত্তেজনা প্রশমিত হোক এবং শান্তি বজায় থাকুক।”
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত মঙ্গলবার জঙ্গি হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত ও এক ডজনের বেশি মানুষ আহতের ঘটনা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছে। ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে একটি সংগঠন ওই ঘটনার দায় স্বীকার করেছে।
সংগঠনটি পাকিস্তান-ভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। টিআরএফ এর পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সমর্থন আছে বলে অভিযোগ করে আসছে ভারত।
লস্কর ই তৈয়বার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতের মুম্বাইয়ে ২৬/১১ সন্ত্রাসী হামলার হোতা হাফিজ মহম্মদ সাঈদ সেই সময় যেসব ‘ছায়া সংগঠন’ গড়ে তুলেছিলেন, সেই সূত্রেই গড়ে উঠেছিল ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) -এর মত জঙ্গি দলগুলো।
এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় বুধবার ভারতের তরফে সার্ক ভিসা স্কিমের অধীনে পাকিস্তানিদের ভিসা দেওয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে এই ভিসার অধীনে ভারতে থাকা পাকিস্তানিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এছাড়া প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আটারি স্থল সীমান্ত বন্ধের পাশাপাশি ঐতিহাসিক সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। পাশাপাশি দুই দেশের হাই কমিশনে কর্মকর্তা কমানো ও ফিরে যাওয়াসহ একাধিক নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এর পাল্টায় ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি স্থগিত এবং ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ। ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিতের পাশাপাশি নয়া দিল্লিকে পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান। তাছাড়া ভারতীয় উড়োজাহাজের জন্য আকাশসীমা বন্ধেরও ঘোষণা এসেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশীর সংঘাত কোন পর্যায়ে যাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় বাংলাদেশসহ অন্য প্রতিবেশীরা। এর মধ্যে সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখায় ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে কয়েক দফায় গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে।
দীর্ঘদিন বৈরী সম্পর্ক বজায় রাখা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে সৌদি আরব। দুদেশের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ বিবেচনায় বাংলাদেশও মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেবে কি-না, এমন প্রশ্নে করা হয়েছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে।
উত্তরে তিনি বলেন, “আমি মনে করি না যে, এই মুহূর্তে আমাদের মধ্যস্থতার ভূমিকা নেওয়া চেষ্টা করা উচিত। আমরা চাইব যে, তারা নিজেরা নিজেরা সমস্যার সমাধান করে ফেলুক।
“তারা যদি আমাদের সহায়তা চায়, যে আপনারা মধ্যস্থতা করুন, তাহলে হয়ত আমরা দেখব। তার আগে আগ-বাড়িয়ে আমরা কিছু করতে চাই না।”
দুদেশর সংঘাতের প্রভাবের বিষয়ে এক প্রশ্নে তৌহিদ হোসেন বলেন, “আধুানিক জামানায়, সব কিছু সবাইকে কম-বেশি প্রভাবিত করে। এই ইস্যু আমাদেরকে একটুও প্রভাবিত করবে না, সেটা আমি বলি না। তবে, তাদের যে সংঘাত, সেটা সরাসরি আমাদের প্রভাবিত করার কিছু নাই। কারণ, আমরা এখানে কোনো পক্ষ নই।
“যেটা বলেছি, আমরা চাই যে, তারা দুপক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে ফেলুক, কোনো সংঘাত না থাকুক।”
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভাব মোকাবেলায় ‘পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যে কোনো সংঘাতে বা যে কোনো সম্পর্ক খারাপ হলে ব্যবসা-বাণিজ্যেতো প্রভাব পড়েই। তবে এর মানে এই নয় যে, আমরাতো পাকিস্তানের সাথে সংঘাতে লিপ্ত না। কাজেই, তাদের কাছ থেকে যদি আমাদের স্বার্থ থাকে, তুলা আমদানি করা, সেটা আমরা করব।
“ভারত আমাদেরকে যে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিচ্ছিল গত বছর দেড়েক যাবত, সেটা তারা প্রত্যাহার করেছে। আমাদেরকে মোডাস ভিভেন্ডি (জীবন চলার পথ) বের করে নিতে হবে, এই পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে করতে পারি।”
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের প্রেক্ষাপটে সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ফ্লাইট চালুর সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা তুলে ধরে তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমাদেরকে এভাবেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি মনে করি যে, এটা এভাবেই এগোবে।
“তাদের সংঘাতের কারণে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব যদি হয়, সেই প্রভাব যাতে আমাদের বেশি ক্ষতি করতে না পারে, আমাদেরকে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানো হবে কি-না, এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, “এটা হয়ত, যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন তারা হয়ত বলতে পারবেন। এই মুহূর্তে আমার কাছে এই রকম কোনো তথ্য নাই।”
‘বাংলা-ভাষী মানেই বাংলাদেশি নয়’
ভারতের গুজরাটসহ বিভিন্ন রাজ্যে ‘বাংলাদেশিদের’ গ্রেপ্তারের খবর সংবাদ মাধ্যমে এলেও সে দেশ থেকে সরকারিভাবে কোনো তথ্য না পাওয়ার কথা বলছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত্ আমরা এ ব্যাপারে শুধু পত্রপত্রিকাতে দেখেছি। এর বাইরে কোনো অফিসিয়াল কমিউনিকেশন আমাদেরকে দেওয়া হয়নি। আপনারা জানেন, অফিসিয়াল কমিউনিকেশন পেলেও আমাদেরকে দেখতে হবে, আসলে তারা বাংলাদেশের লোক কি-না। যদি বাংলাদেশের মানুষ হয়, আমরা তাদেরকে অবশ্যই ফেরত নেব।
তবে আটকরা বাংলাদেশের মানুষ কি-না, তা ‘প্রমাণসাপেক্ষ’ বিষয় মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, “ভারতে আমরা জানি যে প্রচুর বাংলাভাষী আছে। বাংলায় কথা বললে কেউ বাংলাদেশের মানুষ, এমন কোনো নিশ্চয়তা নাই।”
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গুজরাটের আহমেদাবাদ ও সুরাট শহরে শুক্রবার রাতে অভিযান চালিয়ে নারী ও শিশুসহ এক হাজার ২৪ বাংলাদেশিকে আটকের তথ্য দিয়েছে রাজ্য পুলিশ।
শনিবার আহমেদাবাদে সংবাদ সম্মেলনে রাজ্য পুলিশের প্রধান বিকাশ সহায় বলেন, “শুক্রবার রাতে আটক হওয়া সবাইকে আইনি প্রক্রিয়া শেষে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। তদন্ত কর্মকর্তারা পশ্চিমবঙ্গের অপরাধ চক্রের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন, যাদের বিরুদ্ধে জাল নথি তৈরির অভিযোগ রয়েছে।
“পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হওয়া জাল নথি ব্যবহার করেই অধিকাংশ বাংলাদেশি গুজরাটসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থান করছে। একটা যৌথ জিজ্ঞাসাবাদকেন্দ্রে এসব বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে।”
বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে মিশনগুলো কিছু জানিয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নে তৌহিদ হোসেন বলেন, “তারা কোনো কিছু নিশ্চিত করতে পারেনি কারণ, ভারত কর্তৃপক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি এখনও অফিসিয়ালি।”
কাশ্মীরের ঘটনার পরে বৈধ ভিসাধারীদেরকেও গ্রেপ্তার করার খবরের বিষয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কোনোভাবে পাই, তাহলে আমরা সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। এখানে একটা জিনিস বুঝতে হবে যে, বৈধ ভিসা নিয়ে যারা যান, তারা ওখানে সফর করে ফেরত চলে আসবেন। কিন্তু, যদি তাদের কেউ কোনো আইনভঙ্গ করে থাকেন, সেটার জন্যতো কোনো দেশ ব্যবস্থা নিতেই পারে। সেটা হল অন্য কথা।
“না হলে, আমরা চাইব যে, বৈধ ভিসা নিয়ে যারা যাচ্ছেন, তারা তাদের সফর শেষে ফিরে আসুন। আমরা এ ব্যাপারে ট্রাভেলার্স অ্যাডভাইজরি ইস্যু করি নাই। তবে, আমি মনে করি যে, যাদের নিতান্ত প্রয়োজন নেই, এই সংঘাতের সময়ে বরং অ্যাভয়েড করাই ভালো।”