এতে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় শিল্পকলাকেন্দ্রিক সংগীতসহ অন্যান্য মাধ্যমের শিখন আর চর্চা বন্ধ; অসন্তোষ সংস্কৃতিকর্মীদের।
Published : 05 Sep 2022, 08:40 AM
প্রায় তিন বছর বন্ধ কক্সবাজারের কুতুবদিয়া শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম; প্রথম দুই বছর গেছে করোনাভাইরাস মহামারীতে আর বছরখানেক ধরে সেটি আনসার সদস্যদের বাসস্থান।
এতে দ্বীপ উপজেলাটিতে শিল্পকলাকেন্দ্রিক সংগীতসহ অন্যান্য মাধ্যমের শিখন আর চর্চা বন্ধ। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও এর প্রভাব পড়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পকলার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
পাশেই আনসারদের ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। যে কারণে একাডেমির মহড়া কক্ষে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের এসব আনসার সদস্যের বসবাসের ফলে একাডেমি চত্বরে সংস্কৃতিকর্মীদের যাওয়া আসাও বন্ধ।
এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতিচর্চার প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা আর অবহেলার চিত্রই ফুটে উঠছে বলে মনে করছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এতদিন শিল্পকলা একাডেমিতে আনসার সদস্যরা থাকার মানে তো ওইখানে সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়া।
“কেন এটি করা হল আমরা বুঝতে পারছি না। আশা করব দ্রুত শিল্পকলা একাডেমিতে সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেবে স্থানীয় প্রশাসন।”
বিষয়টি জানতে পেরে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী কতুবদিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যার সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকায় শিল্পকলার এক কর্মকর্তা।
তিনি জানান, স্বল্প সময়ের মধ্যেই সেখান থেকে আনসার সদস্যদের সরিয়ে নেওয়া হবে বলে ইউএনও আশ্বাস দিয়েছেন। আর মহাপরিচালক শিল্পকলার কার্যক্রম গতিশীল করতেও ইউএনওকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা জানান, করোনাভাইরাস মহামারীকালে একাডেমিতে ক্লাস বন্ধ থাকায় আনসারদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু মহামারীর নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়ে সবকিছু স্বাভাবিক হলেও তারা সেখান থেকে সরছেন না। এতে শিল্পকলা আর চালু হয়নি; মাঝে পেরিয়ে গেছে তিনটি বছর।
আবার কবে সেখানে সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ তৈরি হবে সেটিও বলতে পারছেন না কেউ। এ নিয়ে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছেন।
গত ২৫ জুলাই শাহীন আবরার নামে শিল্পকলার সাবেক এক শিক্ষার্থী ফেইসবুকে তিনটি ছবি শেয়ার করে একাডেমি প্রাঙ্গণে যেতে না পারার আক্ষেপ তুলে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বর্তমানে কক্সবাজারে বসবাসকারী শাহীন সঙ্গীতচর্চাতেও যুক্ত আছেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই শিল্পকলায় আমি গান শিখেছি। এমন দৃশ্য দেখলে খুব মন খারাপ লাগে।“
ইমরানুল হক আজাদ নামে আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফেইসবুকে লিখেছেন, “আমার বানান করতে যেমন স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচিতি সম্পর্কে জানা দরকার, ঠিক তেমনি হারমোনিয়ামে গান তুলতে বা গাইতে গেলে স্বরলিপির পরিচিতি সম্পর্কে জানা দরকার। স্বরবর্ণ শিখতে লাগে প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বরলিপি শিখতে লাগে শিল্পকলা। আর সেই শিল্পকলার অবস্থা যদি হয় এমন তাহলে কি আর সংস্কৃতি বলতে কিছুই থাকবে।
“…ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ, আপনারা এই অবহেলিত কুতুবদিয়ার ক্ষুদে শিল্পীদের প্রতিভাকে মাঠির সঙ্গে মিশিয়ে দিবেন না।”
কুতুবদিয়া উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সমীর কান্তি শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে অনুষ্ঠান যখন থাকে তখন আমরা পাশের একটি স্কুলে মহড়া করি।”
সরকারি বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের মধ্যেই এখন শিল্পকলার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ বলে তিনি জানান।
স্থানীয় একটি হাই স্কুলের শিক্ষক সমীর ২০০৪ সাল থেকে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে গান শেখান শখের বশে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের তালিকাভুক্ত এ শিল্পী বলেন, “আমাদের এখান থেকে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জাতীয় পর্যায়ে সুনাম কুড়িয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী বাইরেও চলে গেছে।”
করোনাভাইরাসের আগে শিল্পকলায় সঙ্গীত, আবৃত্তি, নৃত্য বিভাগে নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলত। সঙ্গীতে ৪০ জনের অধিক শিক্ষার্থী ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন নতুন করে ক্লাস শুরু হলে বুঝতে পারব আগের মত শিক্ষার্থীরা আসবে কি না? আনসার সদস্যদের নতুন বিল্ডিং হচ্ছে, সেটির কাজ শেষ হলে তাদের সেখানে সরিয়ে নেওয়া হবে।”
কক্সবাজার জেলা কালচারাল অফিসার সুদীপ্তা চক্রবর্তী জানান, উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিগুলোতে মূলত সভাপতি ইউএনও এবং একজন সাধারণ সম্পাদক থাকেন। তারা সেটি পরিচালনা করেন।
আর কালচারাল অফিসাররা ইউএনওদের মাধ্যমে শিল্পকলার খবরাখবর নেন এবং মাঝেমধ্যে পরিদর্শন করে দেখেন ঠিকমত ক্লাস হচ্ছে কি না বলে জানান সুদীপ্তা।
মহামারীর বিধিনিষেধ ওঠার পর কুতুবদিয়া শিল্পকলা পরিদর্শন করেছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রামু, টেকনাফ, উখিয়া যাওয়া হয়েছে। তবে কুতুবদিয়া যাওয়া হয়নি।”
কুতুবদিয়ার ইউএনও দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যাকে ফোন করে এ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি ‘মিটিংয়ে আছেন’ বলে সংযোগ কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করলেও আর রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠানো হলেও উত্তর দেননি।
বিষয়টি তার জানা নেই উল্লেখ করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "শিল্পকলা একাডেমি বন্ধ রেখে যদি সেখানে আনসারদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়, সেটি কেন করা হয়েছে আমি খোঁজ নেব।"