পঙ্গু হাসপাতালে শুয়ে পরিচিত একজনকে ফোনে মনের কষ্টের কথা বলছিলেন দোকান কর্মী জাকির সিকদার।
Published : 30 Jul 2024, 12:33 AM
“হ্যালো, আমার একটা পা নাই। গুলি লাগছিল পায়ে, পরে পা কেটে ফেলতে হইছে। বেঁচে আছি এটাই তো বড় কথা। চোখের সামনে কয়েকজন মারা গেল। ভালো থাইকেন। আমার জন্য দোয়া কইরেন।”
কোটা আন্দোলনের সংঘর্ষের গুলিতে আহত বাড্ডার বাসিন্দা মো. জাকির সিকদার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি। কিছুক্ষণ পরপর স্বজন আর পরিচিতরা কল করে তার সম্পর্কে জানতে চায়। এমন একটি ফোন কলে রোববার তিনি যখন এই বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন তার মা হনুফা বেগম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) ক্যাজুয়ালিটি-২ এর শয্যায় শুয়ে থাকা সন্তানকে পাশে রেখে মা বলছিলেন, “ছেলেটা আমার ব্যাথায় এই কয়েকটা দিন কাতরিয়ে, অসংখ্যবার কান্না করায় চোখের পানিও ফুরিয়ে গেছে।
“আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে দেখতে এসে পা নাই দেখে জড়িয়ে ধরে কান্না করলে সেও কান্না করে, কিন্তু চোখ দিয়ে আর পানি আসে না। পানি তো শেষ। কত কষ্ট গেছে ছেলেটার উপর দিয়ে।”
“ছেলেটারে এখনও বিয়েও করাইনি”- বলে আফসোস করতে লাগলেন হনুফা। বলেন, “বয়সও খুব বেশি না। জীবন পুরোটাই পড়ে আছে।”
সুস্থ হলে একটা নকল পা সংযোজনের পরিকল্পনা করছেন তিনি। বলেন, “যাতে আস্তে ধীরে হলেও চলাফেরা করতে পারে।”
যেভাবে পা হারালেন জাকির
জাকির গুলশান -১ এর একটি কাপড়ের বিক্রয়কেন্দ্রে চাকরি করতেন জাকির। গত ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের কনপ্লিট শাট্ডাউন কর্মসূচির দিনও কাজে গেছেন বলে তার দাবি।
বলছিলেন, রাত ৯টার দিকে কাজ শেষে মধ্য বাড্ডায় নিজেদের বাসায় যাচ্ছিলেন। বিকালে সেই এলাকায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে, এই তথ্য শুনেছেন তিনি। তবে রাতে ঝামেলা হবে ভাবেননি।
জাকিরের ভাষ্য, বাড্ডায় ব্রাক ইউনিভার্সিটির সামনে গিয়ে যাওয়ার সময় বা পা ফুটা করে বেরিয়ে যায় গুলি।
“গুলি লাগার পর আমি পড়ে গেলে আশেপাশের লোকজন আমাকে রিকশায় উঠাল। একজন গামছা দিয়ে আমার পা বেঁধেও দিল। ততক্ষণে আমার জিন্সের প্যান্ট লাল হয়ে গেছে। আমার জ্ঞান যায় যায় অবস্থা।
“শরীরও প্রচণ্ড কাঁপছিল। তখনই এই রাস্তা দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছিল। আমাকে সেটায় তোলা হলে দেখলাম আরও চারজন রোগী। সবার পায়ে গুলি লেগেছে। একজনের অবস্থা বেশি খারাপ, কয়েকটি গুলি লেগেছে।”
গুলিটা করল কে?
জাকির বলেন, “তখন পরিবেশ থমথমে থাকলেও কিছু হচ্ছিল না। আশপাশে মানুষজন দাঁড়িয়ে ছিল। কোথাও পুলিশও দেখতে পাইনি। তবুও কোথা থেকে যেন গুলি লেগে পায়ের হাড়গোড় ভেঙে গেল। আর অনবরত রক্ত…।”
বড় ভাই আব্দুর রহমান বলেন, “জাকিরের নম্বর থেকে হঠাৎ করে ফোন করে অপরিচিত একজন বলল, ‘জাকিরের অবস্থা ভালো না, তাকে রামপুরা-বনশ্রীতে ফরাজি মেডিকেলে নেওয়া হচ্ছে।’
“কিছুক্ষণ পর আবার ফোন আসল, সেখানে রাখে নাই, তাই পঙ্গু বা ঢাকা মেডিকেলে নেবে। তখন আমরা মানসিকভাবে এমনিতেই ভেঙে ছিলাম। তার মধ্যে গাড়িও নাই রাস্তায়। একটা সিএনজি চালককে হাতেপায়ে ধরে আনতেছিলাম, তখন আন্দোলনকারীরা আবার নামিয়ে দিল। কিছুক্ষণ সামনে এগিয়ে গিয়ে আরেকটা গাড়ি নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে তাকে চিকিৎসারত অবস্থায় পাই। সেখানে সাত থেকে আট ব্যাগ রক্ত লেগেছিল। আর পঙ্গুতে আনার পর অবস্থা বেশি খারাপ থাকায় রোববার (২১ জুলাই) পা কাটা হয়। পায়ের হাড় একবোরে গুঁড়া হয়ে গিয়েছিল।”
এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হল না
উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন মো. রাকিবুল। সাতটি পরীক্ষা দিয়েছেন, বাকি আর ছয়টি। কিন্তু এবার পরীক্ষার হলে আর বসা হবে না তার।
১৮ জুলাই উত্তরা বিএনএস সেন্টারের পেছনে গুলিবিদ্ধ হন পশ্চাতদেশে।
তিনি বলেন, “আমরা সাত-আটজন বন্ধু আমাদের কলেজের গেটের গলিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। তখন দেখলাম মানুষজন দৌড়াচ্ছে। ভয় পেয়ে আমরাও দৌড় দিলাম। দেখলাম পেছন থেকে সমানতালে গুলি আসছে। হঠাৎ করে একটা গুলি লেগে সামনে দিয়ে বের হয়ে যায়।”
আর দৌড়াতে পারছিলেন না। কোমড়ের নিচ থেকে অবশ হয়ে যায় তার, হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে রাস্তার এক পাশে দেয়ার ঘেঁষে বসলেন। সেখানে থাকা মানুষজন ধরাধরি করে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেয়। সেখানে থেকে সোহরাওয়ার্দী ও নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল ঘুরে পরের দিন ভোরে নেওয়া গয় পঙ্গু হাসপাতালে।
হাসপাতালের শয্যায় শুয়েও পরীক্ষার কথা চিন্তা করছেন। বলছিলেন, “এ অবস্থায় বসে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব না।”
একই দিন বিকালে উত্তরা হাউজবিল্ডিং এলাকায় পায়ে গুলিবিদ্ধ হন আদমজী ক্যান্টনমেন্টে ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ইমন। তিনি পরিবারের সঙ্গে উত্তরাতেই থাকেন।
হাসপাতালে ইমনের সঙ্গে থাকা বড় ভাই মো. সাইমন বলেন, “ভাগ্য এমন খারাপ যে এত অল্প বয়সেই পায়ে এতবড় আঘাত পেল। ডাক্তার জানিয়েছে পাঁচ থেকে ছয় মাসের বেশি সময় লাগবে চিকিৎসায়। কী কী করতে হবে এমন কিছু ডাক্তার এখনও জানায়নি।
“ভাইটা প্রাণে বেঁচে আছে এটাই অনেক বড় পাওয়া। কত মানুষ তো মারা গেছে তার সঠিক হিসেব কে জানে।”