বেশির ভাগ ত্রাণদাতাতের টার্গেট ফেনীর দিকেই, নোয়াখালীর গ্রামগুলোর দিকে খেয়াল কম করতেছে। এসব গ্রামের মানুষও ব্যাপক দুর্ভোগে, বলেন এক স্বেচ্ছাসেবী।
Published : 26 Aug 2024, 01:49 AM
"চাইরদিক দি গাছ-গাছরা নষ্ট হইছে, আর আমরা হানিত বাইতেয়াছি। খামু কইত্তুন, বাঁচুম কেমনে? বাড়িত চাইলও নাই।"
বন্যায় তারা কেমন আছেন সেটা এই এক বাক্যেই বুঝিয়ে দিলেন ষাটোর্ধ হোসনে আরা বেগম। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের এই বাসিন্দার ঘরে হাঁটু পানি।
দিনভর টানা বৃষ্টির প্রকোপে পানি আরও বাড়তে থাকায় দুই ছেলে, তাদের স্ত্রী ও চার নাতি-নাতনিদের রেখে এসেছেন প্রতিবেশীর দোতলা পাকা বাড়িতে।
চারিদিকে পানির মধ্যে তারা কোনো রকমে টিকে থাকার বর্ণনা দিয়ে তিনি যা বলছিলেন সেটির মানে দাঁড়ায়, চারিদিকে গাছপালা নষ্ট হচ্ছে। তারা পানির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন। বাড়িতে চাল না থাকায় তারা খাবেন কি, টিকেইবা থাকবেন কীভাবে?
ঘরে রান্না নেই, তবুও নিজের ভিটায় মায়ায় থেকে যাওয়া এই বৃদ্ধা বলেন, "এই ঘরে বই রইছি কোনমতে। ইট হাতখানার হরে চকি তুইলছি। (এই ঘরে বসে আছি কোনো রকম। নিচে ইট দিয়ে চকি উঁচু করছি।)
"এন আর চিন্তা বেশি, ঘরও এই ফিলে, এহন ইগুন লই কষ্ট করি আরি। কিত্তাম কন? সবার বাড়ি ডুবুইন্না। পানি বাড়তেছে।" (এ নিয়েই আমার চিন্তা বেশি। এদিকেই আমার ঘর, এখানে থেকেই কষ্ট করছি। কী আর করব বলেন, সবার বাড়ি ডুবে আছে-পানিও বাড়ছে।)
গেল কয়েকদিন টেবিলের উপর চুলা বসিয়ে রান্নাবান্না চালিয়ে গেলেও রোববার সেটা সম্ভব হবে না বলে দুশ্চিন্তার কথা তুলে ধরলেন তিনি।
বেগমগঞ্জের দুর্গাপুর গ্রামে পানিবন্দি প্রায় সব মানুষের চিত্র একই। গত বুধবার থেকে পানি ঢুকতে শুরু করে গ্রামে, বৃহস্পতিবারের মধ্যে নিমিশেই পানি ঢুকে পড়ে ঘরে। এর প্রভাবে কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষিত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কেউ স্বজন-প্রতিবেশীদের পাকা বাড়ির দোতলায়।
ফসল পুরোটাই পানির নিচে, পুকুর বা ঘেরের মাছও আর নেই। হাঁস-মুরগির খামারগুলোও তলিয়ে গেছে। অনেক গরু-ছাগলও মারা গেছে। কেউ কেউ কিছু গরু স্থানীয় বাজারে বা উঁচু ব্রিজে রেখে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
গ্রামের বাসিন্দা নিজামউদ্দিন বলেন, "আপাতত মাদ্রাসার মধ্যে কোনমতে আছি। কোনমতে চাইরগা রান্দি, সবাইর লগে মিলিমিশি খাই আরকি। আমি তো কোনমতে আছি, আমার চাইতে যারা, আমার চাইতে যারা দুর্বল আছে সবাইরে আল্লাহ হেফাজত করুক।"
তিনি বলেন, "ফসলের তো কথা তো নাই, ঘরদুয়ারই টিকে কি না এখন এইটা সমস্যার বিষয় বর্তমানে। বাড়ি-ঘরে থাইকতে পারি কি না সেইটাই তো বড় দুঃসময় দাড়াই গেছে এখন।"
মেহরাজ নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, "ঘরের সামনে বুকসমান পানি, বলার মত অবস্থা নাই। বাড়িতেই থাকতেছি, চকির উপরে। কোনো রান্না নাই, খাওয়া দাওয়া নাই।"
খানিকটা উঁচু বাড়ি শাহেদের, উঠানে পানি উঠলেও ঘরে এখনও ওঠেনি। আশপাশের স্বজনদের জায়গা দিয়েছেন তার ঘরে।
তিনি বলেন, "সবার অবস্থা খুব খারাপ। আমার জেঠারা উঠছে আমাদের ঘরে। তাদের বাড়িতে পানি বুক সমান হইব।"
এমন যাদের খারাপ অবস্থা তাদের সহায়তায় বের হওয়া স্বেচ্ছাসেবীরাও আছেন বিপাকে।
চৌমুহনী এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষার্থী নিজেদের উদ্যোগে সহায়তা করতে বের হয়েছেন বানভাসী মানুষদের। তাদের অভিযোগ, পৌরসভার আপশপাশে ত্রাণ দিয়েই অনেকে চলে যায়। ভেতরের দিকে কেউ আসেনা, তাই এখানকার মানুষ বঞ্চিত।
এদের একজন শাখাওয়াত হোসেন বলেন, "পৌরসভার মধ্যে টুকটাক ত্রাণ যাইতেছে। হাজীপুর-দুর্গাপুরের মতো প্রান্তিক যে জায়গাগুলো আছে। ওই যায়গাগুলোতে ত্রাণও কম পৌঁছাইতেছে, মানুষের নজরটাও কম পড়তেছে।
"কুতুবপুরের দিকে মানুষ গৃহবন্দি হয়ে আছে। তারা আশ্রয়কেন্দ্রেও আসতে চাইতেছে না। পানিতে একেবারে ডুবে যাওয়ার মতো না হলেও ওদের খাবারের অভাব। যতটুকু পারতেছি ওখানের স্বেচ্ছাসেবীদের জানানোর চেষ্টা করতেছি, কিন্তু কাভারেজটা ঠিকঠাক হইতেছে না।"
তার ভাষ্য, "চৌমুহনী পৌরসভার দিকে মানুষ পাইতেছে কিন্তু গ্রামের দিকে যাইতেছে না। আর বেশির ভাগ মানুষ ফেনীর দিকেই টার্গেট, নোয়াখালীর গ্রামগুলোর দিকে খেয়াল কম করতেছে। ওই জায়গার মানুষগুলাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে আছে।"
বন্যার পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে শাখাওয়াত বলেন, "অনেক জায়গায় পানি বুক সমান। পৌরসভার কিছু জায়গায় কোমর সমান, গ্রামের দিকে বুক সমান।
"নিচতলা, টিনের ঘর ক্ষয়ক্ষতি হইছে। যারা নিচতলায় তাদের খাটের উপরে পানি, কেউ বাসাবাড়িতে চৌমুহনী থাকতেছে, কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে গেছে।"
চারদিক পানিতে ভেসে থাকায় গ্রামের দিকের মানুষের খাবারের কষ্টে থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ”অনেকে আমাদের কাছে বলতেছে, দুইদিন শুকনা টুকটাক যা ছিল তাই খাইতেছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার পাইতেছে না। অনেকের কাছে টাকা আছে, কিন্তু কিনে আনবে ওই পরিস্থিতিতে তারা নাই।"