“আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না,” বলেন তিনি।
Published : 17 Jul 2024, 07:44 PM
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে সংঘাতের বিচারবিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি আন্দোলনকারীদের সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈয্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।”
হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, “আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, যারা হত্যাকাণ্ড ও লুটপাট, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে এরা যেই হোক না কেন তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
“আমি আরও ঘোষণা করছি হত্যাকাণ্ডসহ যে সকল অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে সে সকল বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে।”
আদালতের রায়ে সরকারি চাকরিতে ২০১৮ সালের পর আবার কোটা পুনর্বহাল হলে তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যশীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন গত সপ্তাহে ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচির পাশাপাশি আন্দোলনকারীরা অবরোধে নামেন। তাদের ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে মঙ্গলবার দেশজুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে যায়। এতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে শিক্ষার্থী, পথচারীসহ ছয়জন নিহত হন, আহত হন কয়েকশ মানুষ।
এমন প্রেক্ষাপটে জাতির উদ্দেশে ভাষণে এসে প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। তাদের পরিবারের সদস্যের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন।
হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “পরিবারের সদস্যদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা দরকার, সেটা আমি করব।”
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আট মিনিটের এ ভাষণ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়।
আদালতের রায়ে কোটা বাতিলের পর হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিল করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আদালতে শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। আদালত শিক্ষার্থীদের কোনো বক্তব্য থাকলে শোনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
”এই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের সুযোগ রয়েছে। এই আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানের সুযোগ থাকা স্বত্বেও রাস্তায় আন্দোলনে নেমে দুষ্কৃতিকারীদের সংঘাতের সুযোগ তৈরি করে দেবেন না।”
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সংঘাতের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে, উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন সরকারপ্রধান।
এসব ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে তদন্তের পাশাপাশি কারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উসকে দিয়েছে তাদের চিহ্নিত করার কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ”কাদের উস্কানিতে সংঘর্ষের সূত্রপাত হল, কারা কোন উদ্দেশ্যে দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিল তা তদন্ত করে বের করা হবে।”
প্রধানমন্ত্রী বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী দিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে রাখার ওপর জোর দিয়ে বলেন, “আমি আন্দোলনরত কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এই সন্ত্রাসীরা যে কোনো সময় সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের প্রতি আমার আবেদন, তারা যেন তাদের সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ থাকেন।
“একইসাথে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে নজর রাখেন।”
শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলেনের মুখে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করা হয়। সরকারের সেই পরিপত্র ঈদের আগে হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা দুই সপ্তাহ ধরে টানা আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
ধারাবাহিক সেই কর্মসূচির মধ্যে সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে শিক্ষার্থীদের ওপর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় হামলাও হয়।
এর প্রতিবাদে পরদিন মঙ্গলবার বিকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের কর্মসূচি দিলেও সকাল থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও রেল অবরোধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় তা সহিংসতা রূপ নিলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
সংঘাতের পরদিন বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে সন্ত্রাসীরা ঢুকে পড়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমি বিশ্বাস করি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সাথে সন্ত্রাসীদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।”
’অত্যন্ত বেদনা-ভারাক্রান্ত মন’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতে এসেছেন তুলে ধরে কোটা বাতিলের পূর্বাপর বর্ণনা করেন।
দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, “লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছি। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি।
”বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে একটা মর্যাদা আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। তারপরও আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ যখন একটু স্বস্তি-শান্তিতে ফিরে, তখন মাঝে-মধ্যে এমন কোন ঘটনা ঘটে যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।”
আন্দোলনের শুরু থেকে সরকার যথেষ্ট ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে মন্তব্যে করে তিনি বলেন, “বরং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ সহযোগিতা করে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যখন আন্দোলনকারীরা স্মারকলিপি প্রদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্বার্থান্বেষীরা ঢুকে পড়ার কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ”দুঃখের বিষয় হলো এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করবার জন্য বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে। যেহেতু বিষয়টি উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে তাই সকলকে ধৈর্য ধরতে আহ্বান জানাচ্ছি।
”অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল কিছু মহল এই আন্দোলনের সুযোগটা নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করবার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। এর ফলে, এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে যে সকল ঘটনা ঘটেছে তা খুবই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। অহেতুক কতগুলো মূল্যবান জীবন ঝরে গেল। আপনজন হারাবার বেদনা যে কতটা কষ্টের তা আমার থেকে আর কে বেশি জানে?”
হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, “চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীরা বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে নিচে ছুঁড়ে ফেলে অনেক ছাত্রদের হাত পায়ের রগ কেটে দেয়। তাদের উপর লাঠিপেটা এবং ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে, একজন মৃত্যুবরণ করেছে, অনেকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ঢাকা, রংপুর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবন ও ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হলে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর করা হয়।
”সাধারণ পথচারী, দোকানীদের আক্রমণ, এমনকি রোগীবাহী এম্বুলেন্স চলাচলে বাধা প্রদান করা হয়। মেয়েদের হলে ছাত্রীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে এবং লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। আবাসিক হলে প্রভোস্টদের হুমকি দেওয়া ও আক্রমণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের উপর চড়াও হয়ে তাদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত তাদের সাথে এই সকল সন্ত্রাসীদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সংঘাত ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।”