সীমান্তে সংকট: মিয়ানমারের ‘ইতিবাচক মনোভাব’ দেখেছেন বিজিবি মহাপরিচালক

এবারের সম্মেলনে সীমান্তে যৌথ টহল শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Nov 2022, 02:49 PM
Updated : 29 Nov 2022, 02:49 PM

সীমান্তে উত্তেজনা, মাদক পাচার, স্থল মাইন ও বিদ্যুতায়িত কাঁটাতার স্থাপন নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়ে মিয়ানমার ‘ইতিবাচক মনোভাব’ দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ। 

তিনি বলেছেন, দুই দেশের সীমান্ত সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হলেও সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণের কথা হয়নি। 

গত ২৪ থেকে ২৭ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোয় দুই দেশের অষ্টম সীমান্ত সম্মেলনে অংশ নেয় ১০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। সম্মেলনের অভিজ্ঞতা জানাতে মঙ্গলবার ঢাকার পিলখানায় বিজিবি সদরদপ্তরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে আসেন বিজিবির মহাপরিচালক।

তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশের ইস্যুগুলো গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছি। আর মিয়ানমারের কর্তকর্তারা সেগুলো আমলে নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়েও তারা (মিয়ানমার) কাজ করে যাচ্ছেন, আমরা ইতিবাচক ফলের আশা করছি।” 

মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি, স্থল মাইন পুঁতে রাখা, বিদ্যুতায়িত কাঁটাতার- এতকিছুর পরেও এবারের সীমান্ত সম্মেলনে মিয়ানমারের ‘ইতিবাচক মনোভাব’ দেখার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ বলেন, “একটা বিষয় নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন একজন বলে এবং আরেকজন শোনে। যে বলে, সে কিন্তু বুঝতে পারে যে শুনছে তার শোনাটা কেমন। এজন্য বারবার বলছি, আমি তিন পর্যায়ে আমাদের ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলেছি এবং প্রত্যেকটি জায়গায় তারা ধৈর্য্য সহকারে আমার কথা শুনেছে। 

“এজন্য বলছি ধৈর্য্য সহকারে শোনা এবং পরবর্তীতে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো এবং আশ্বাস দেওয়া যে তারা এটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করবে। এই পরিবেশ বা এই মনোভাবটা আমি পেয়েছি, তারা আমাদের আশ্বস্ত করছেন যে তারা এই বিষয়টা গ্রহণ করছেন। গ্রহণ করে, এটার ওপর আলোচনা করে এটার ব্যাখ্যা পাওয়া কিন্তু এক ধরণের ইতিবাচক সাড়া। এটা আমরা পেয়েছি।” 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বিজিবি প্রধান বলেন, “প্রত্যাবাসনটা দীর্ঘমেয়াদী একটা প্রক্রিয়া। এটার বিভিন্ন পর্যায় আছে, ধাপ আছে। ‘ভেরিফিকেশন’ থেকে শুরু করে ওপারে যাওয়ার পর তাদের রিসিভ যে করবে এরপর তাদের অস্থায়ীভাবে কোথায় রাখা হবে, তাদের আবাসস্থলে কীভাবে নিয়ে যাওয়া হবে… এই পুরো বিষয়টা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। আমার কাছে মনে হয়েছে, তারা এগুলো নিয়ে কাজ করছে।”

২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।

২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।

এ পরিস্থিতির মধ্যেই তিন মাসের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির কারণে সীমান্তে অস্থিরতা চলছে। সীমান্তের এপারে বাংলাদেশের বাসিন্দারাও আতঙ্কে রয়েছেন। মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে আসা গোলায় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।

বিষয়গুলো নিয়ে এর আগে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে চারবার তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ঢাকায় নিযুক্ত আসিয়ান রাষ্ট্রদূত এবং অন‌্যান‌্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে ব্রিফ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। 

পুরনো খবর

বিজিবি-বিজিপি বৈঠক: আকাশসীমা লঙ্ঘনে মিয়ানমারের দুঃখ প্রকাশ

মিয়ানমার থেকে গোলা আসা বন্ধ না হলে জাতিসংঘে তুলব: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

মর্টার শেল: মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব, কড়া প্রতিবাদ ঢাকার

মিয়ানমারের গোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, হতাহতের খবর 

সীমান্ত সম্মেলনে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আশ্বাস পাওয়ার কথা তুলে ধরে মেজর জেনারেল সাকিল বলেন, “তারা বলেছে, এখানে (মিয়ানমারে) সব ধর্মের মানুষেরা সমান অধিকার পাবে, তাদের জীবনযাত্রা কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে না। তারা যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেছে, তখন আমরা ধরে নিতে পারি রাখাইনে পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। 

“দ্বিতীয়ত, এখন সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের একটা ‘সিজ ফায়ার’ (অস্ত্র বিরতি) চলছে। এই দুটো বিষয়কে যদি ‘দুইয়ে দুইয়ে চার’ মেলাই তাহলে বলতে হবে আগের তুলনায় একটা ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রাখাইনে যা প্রত্যাবাসনের জন্য একটা ইতিবাচক দিক।”

সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখা ও বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারের প্রসঙ্গে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, “তারা বলেছে সব জায়গায় মাইন নেই। যে সমস্ত জায়গায় চোরাচালান, মানবপাচারের মতো ঘটনাগুলো বেশি ঘটে সে সমস্ত জায়গায় এগুলো রয়েছে। এগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাজ বলেও তারা উল্লেখ করেছে। 

“আমরা বলেছি, যারাই এগুলো করুক না কেন এগুলোকে ক্লিয়ার করতে হবে। আমরা বলেছি, যৌথভাবে এটা করব। তাহলে ওই সমস্ত জায়গায় যৌথভাবে টহল দিতে পারব। বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারের বিষয়েও তারা একই ব্যাখ্যা দিয়েছে। আমরা সেগুলো সরিয়ে নিতে বলেছি।” 

মাদক চোরাচালান রোধেও মিয়ানমার ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, “আমরা মাদক কারখানার ঠিকানা এবং কিছু ব্যক্তির নাম তাদের দিয়েছি। মাদক পাচারে ছোট ছোট জেলে নৌকাগুলো ব্যবহার হয় বলে দুপক্ষের তথ্য থেকেই জানা যায়। 

“কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী যাতে সীমান্ত অতিক্রম করে একে অন্যের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না পারে এ বিষয়ে তারা আমাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।”

এবারের সম্মেলনে সীমান্তে যৌথ টহল শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান বিজিবি মহাপরিচালক।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপনকে এবারের সম্মেলনের ‘অন্যতম সাফল্য’ হিসেবে দেখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি যোগাযোগ যদি বাড়ানো যায়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”

বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে বিজিবির কর্মকর্তারা ছাড়াও স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা ছিলেন। অন্যদিকে ডেপুটি চিফ অব মিয়ানমার পুলিশ ফোর্স-এর মেজর জেনারেল অং নেইং থু এর নেতৃত্বে দেশটির ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল সম্মেলনে অংশ নেয়।

মিয়ানমার প্রতিনিধি দলে দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং অভিবাসন ও জনসংখ্যা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা ছিলেন।

দুই বছর ১০ মাস পরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের মধ্যে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। এবারের সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বিজিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। 

  • বিভিন্ন পর্যায়ে নির্ধারিত ফোকাল পয়েন্ট ব্যক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ ও তাৎক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদান

  • প্রতি দুই মাসে একবার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ের সমন্বয় সভা

  • বছরে দুইবার রিজিয়ন (আঞ্চলিক) কমান্ডার পর্যায়ে এবং বছরে দুইবার বিজিবি এবং বিজিপি (এমপিএফ)-এর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনের আয়োজন করতে সম্মত হয়েছে উভয়পক্ষই

  • উভয় পক্ষই সীমান্তে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়েছে।

  • মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ‘অবৈধভাবে’ ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ বা আইসসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচার রোধে মিয়ানমার মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার আশ্বাস দিয়েছে।

  • দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সীমান্তবর্তী জনগণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি এবং বিভ্রান্তি এড়াতে মিয়ানমার তাদের ড্রোন, হেলিকপ্টার ও বিমান চলাচলের আগাম তথ্যসহ সীমান্তে গোলাগুলি-বিস্ফোরণ ও নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান পরিচালনার তথ্য আদান-প্রদান করতে সম্মত হয়েছে।

  • সীমান্ত কাঁটাতারে বিদ্যুতায়ন এবং ল্যান্ড মাইন স্থাপনের বিষয়ে বিজিবি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলে বিজিপি বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করবে বলে আশ্বস্ত করে।