তার ‘অবৈধ সম্পদ’ অনুসন্ধানকালে এসব শেয়ারের সন্ধান পাওয়ার কথা বলেছে দুদক।
Published : 16 Jan 2025, 06:34 PM
আলোচিত ব্যবসায়ী মো. সাইফুল আলম (এস আলম) ও তার পরিবারের সদস্যদের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছে আদালত।
বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মীর মোহাম্মদ আলী সালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের ৩ হাজার ৫৬৩ কোটি ৮৪ লাখ ২১ হাজার টাকার শেয়ার রয়েছে, যা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ‘অবৈধ সম্পদ’ অনুসন্ধানকালে এসব শেয়ারের সন্ধান পাওয়া যায়।
দুদকের কোর্ট পরিদর্শক আমির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুদকের উপ-পরিচালক আবু সাঈদের আবেদনের উপর শুনানি করে বিচারক এ আদেশ দেন।
আবেদনে বলা হয়, এস আলম তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস ও অন্যান্য দেশে এক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানকালে তার ও তার পরিবারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শেয়ারের তথ্য পাওয়া যায়।
এতে বলা হয়, এসব স্থাপনা এবং স্থাবর সম্পত্তিগুলো অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া না হলে অভিযোগ নিষ্পত্তির আগেই বেহাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এছাড়া অস্থাবর সম্পদগুলো মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ১৪ ধারা অনুযায়ী অবরুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়।
এর আগে গত মঙ্গলবার এস আলম ও তার পরিবারের ২০০ কোটি টাকা মূল্যের ১৬টি স্থাবর সম্পত্তি জব্দ ও ২৫ কোটি টাকাসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৮৭টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত।
২৪ কোম্পানিতে ৩২ কোটি শেয়ার
আদালতে করা আবেদনে বলা হয়, এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ২৪টি কোম্পানির ৩২ কোটি ১০ লাখ ১৯ হাজার ৪৭৮টি শেয়ারের মূল্য ৩ হাজার ৫৬৩ কোটি ৮৪ লাখ ২১ হাজার ৩০০ টাকা।
এতে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস ও অন্যান্য দেশে ১ বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানকালে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর, টিসিবি ভবন থেকে কোম্পানির শেয়ারের মালিকানার তথ্য পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানের সময় পাওয়া তথ্যের বরাতে দুদক আবেদনে বলেছে, এসব শেয়ার হস্তান্তরের চেষ্টা চলছে। তারা সেটি করতে পারলে অপরাধের মাধ্যমে করা তাদের আয় থেকে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করাসহ সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। এ কারণে এসব শেয়ার অবরুদ্ধের আবেদন করা হয়।
কোম্পানিগুলো হল- এস আলম ট্যাংক টার্মিনাল লিমিটেডে, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এস আলম সুপার ওলিন লিমিটেড, এস আলম সিমেন্ট লিমিটেড, এস আলম স্টিলস লিমিটেড, এস আলম পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড, শাহ আমানত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড, এস আলম পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড, এস আলম ব্যাগ ম্যানুফেকচারিং মিলস লিমিটেড, হাসান আবাসন প্রাইভেট লিমিটেড, এস আলম ব্রাদার্স লিমিটেড, এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশেন, সোনালি কার্গো লজিস্টিক লিমিটেড, কর্ণফুলী প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড, ওসিয়ান রিসোর্ট লিমিটেড, এস আলম ভেজিটেবল ওয়েল লিমিটেড, মেরিন এম্প্যায়ার লিমিটেড, এস আলম প্রোপার্টিজ লিমিটেড, মডার্ন প্রোপার্টিজ লিমিটেড, এস আলম ল্যাক্সারি চেয়ার কোচ সার্ভিসেস লিমিটেড, ফাতেহাবাদ ফার্ম লিমিটেড, এস আলম কোন্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড ও এস আলম সোয়াসিড এক্সট্রাকশন প্লান্ট লিমিটেড।
এগুলোতে যাদের শেয়ার রয়েছে তারা হলেন- মো. সাইফুল আলম (এস আলম), তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন, ভাই মো. আবদুল্লাহ হাসান, ওসমান গণি, রাশেদুল আলম, আব্দুস সামাদ ও মো. শহিদুল আলম, এস আলমের ছেলে আহসানুল আলম, আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম, ওসমান গণির স্ত্রী ফারজানা বেগম, সামাদের স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস।
এছাড়া শেয়ার থাকলেও আবেদনে পরিচয় তুলে ধরা হয়নি এমন ব্যক্তিরা হলেন- কামাল পাশা, জাহিদুল হক, মোর্শেদুল আলম, রেশমা পারভীন মোর্শেদ, মিসকাত আহমেদ, সাকিরা শেহরিন, মো. তৌহিদুল আলম, আফতাফ আলম, মাজিদ হক, শওকত সাদেক হোসেন, শাহেলিয়া রশিদ, মিজানুর রহমান ও মো. ফজলে মোর্শেদ।
এর আগে ক্রোক করা হয় যেসব সম্পত্তি
ক্রোক করা ১৬ সম্পত্তির মধ্যে আছে-গুলশানের ১০ তলা ভবন এস আলম টাওয়ার, ধানমন্ডিতে এক বিঘা জমিসহ ৬ তলা ভবন, ধানমন্ডি লেক সার্কাসে ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ জমিসহ ৪ তলা ভবন, গুলশানের ২৬৫৮ বর্গফুট জমির ওপর নির্মিত ফ্ল্যাট, গুলশান-২ এর দশমিক ৭৮৮৮ একর জমি, উত্তরা আবাসিক এলাকায় ৭ তলা ভবন, ভাটারাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১০৩ দশমিক ৩ কাঠা জমির প্লট এবং পৃথক পৃথক ১ দশমিক ৭২০০ একর জমি, ৯৬ কাঠা জমি, ১ দশমিক ৯৫৩৬ একর জমি, ১১ দশমিক ১০৬১ বিঘা জমি ও ১৩১ দশমিক ০৪ কাঠা জমি।
অবরুদ্ধ করা ৮৭টি ব্যাংক হিসাবের মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার ১৯টি হিসাবে ১২ কোটি ২৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৬৩ টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার ৬৮টি হিসাবে ১৩ কোটি ৫৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা অবরুদ্ধ করা হয়।
এরও আগে ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর একই আদালত সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশে ১ বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগে এস আলম ও তার পরিবারের ১২ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া অন্যরা হলেন- সাইফুল আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীন, দুই ছেলে আশরাফুল আলম ও আহসানুল আলম; ছয় ভাই মোরশেদুল আলম, সহিদুল আলম, রাশেদুল আলম, আবদুস সামাদ, ওসমান গণি ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ হাসান।
এছাড়া আবদুস সামাদের স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস, ওসমান গণির স্ত্রী ফারজানা বেগম ও মিশকাত আহমেদ নামের এক ব্যক্তি দেশত্যাগ করতে পারবেন না।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন অনিয়ম সামনে আসে।
চট্টগ্রামভিত্তিক এ গ্রুপের চেয়ারম্যান এস আলমের বিরুদ্ধে ব্যাংক খাতে অনিয়ম, টাকা পাচার, আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তদন্ত শুরু করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। দুদকও ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনসহ বিভিন্ন অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায় এস আলমের বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি করে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অভিযোগ বহু পুরনো। পরে তিনি ও তার ব্যবসায়ী গোষ্ঠী শরীয়াহভিত্তিক আরও কয়েকটি ব্যাংকের পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ নেন।
এসব ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ নামে ও নাম সর্বস্ব কোম্পানি খুলে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
এরইমধ্যে এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তাদের বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করে শেয়ার লেনদেনও স্থগিত করা হয়েছে।
নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ার সরকারের মালিকানায় নেওয়ার কথা বলেছেন।
এর মধ্যে গত ২৯ অগাস্ট এস আলমসহ ৭ আলোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মালিকানা হস্তান্তর স্থগিতের অনুরোধ জানিয়ে যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরকে চিঠি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
একদিন বাদে ৩১ অগাস্ট সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট জানায়, এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তাদের ছেলে আহসানুল আলম ও আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য মিলছে।
এস আলম পরিবারের ১৬ সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ, ৮৭ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
সিঙ্গাপুরে অর্থপাচার: এস আলমের বিরুদ্ধে বন্ধ অনুসন্ধান ফের শুরু
২২ কোটি টাকাসহ এস আলম পরিবারের ১২৫ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
এস আলম ও পরিবারের ১২ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, এস আলমসহ ৭ কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তর স্থগিত রাখতে এনবিআরের চিঠি