“সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা হৃদয়ে ধারণ করলে, মুক্তির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুগম হবেই।”
Published : 14 Apr 2025, 09:55 AM
ইতিহাস-ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, মুক্তচিন্তার নির্ভয় প্রকাশ, আবহমান সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা সকলে হৃদয়ে ধারণ করলে, মুক্তির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতে পৌঁছানো যে সহজ হবে, সেই বার্তাই এল সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণে আয়োজনে।
ষাটের দশকে পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নগরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করা সংগঠনটির এবারের নববর্ষ কথনে নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী বলেন, সকল অতৃপ্তি প্রতিবিধানের দায় রাষ্ট্রের, তবে সমাজকেও সে দায় নিতে হয়।
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অনুষ্ঠানে এক মিনিট নীরবতাও পালন করে ছায়ানট।
সকলে একসাথে মিলবার, চলবার স্বপ্ন নিয়ে ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে ভৈরবীর রাগালাপে ছায়ানটের ১৪৩২ বঙ্গাব্দবরণের প্রভাতী আয়োজনের সূচনা হয়। রাগ পরিবেশন করেন সুপ্রিয়া দাশ।
রাজধানীর রমনা উদ্যানের বটমূলে সোমবার ছায়ানটের ৫৮তম এ আয়োজন যথারীতি শুরু হয় নতুন বছরের প্রথম দিন ভোর সোয়া ৬টায়।
বাঙালি সমাজকে নিয়ে মুক্তির পথযাত্রী হতে এবার ছায়ানটের বর্ষবরণের বার্তা- 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়'।
ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা এবারের আয়োজন নিয়ে আগেই বলেছিলেন, "বিশ্বব্যাপী যেমন ক্ষয়ে চলেছে মানবতা, তেমনি এদেশেও ক্রমান্বয়ে অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। তবুও আমরা আশাহত হই না, দিশা হারাই না, স্বপ্ন দেখি হাতে হাত রেখে সকলে একসাথে মিলবার, চলবার।
"বাঙালি জাগবেই, সবাই মিলে সুন্দর দিন কাটানোর সময় ফিরবেই। সার্থক হবেই হবে, মানুষ-দেশ, এ পৃথিবীকে ভালোবেসে চলবার মন্ত্র।"
প্রভাতি এই আয়োজনে সম্মেলক কণ্ঠে ‘নূতন প্রাণ দাও, প্রাণসখা’ এবং একক কণ্ঠে দীপ্র নিশান্ত শোনান ‘তিমির দুয়ার খোলো’।
৯টি সম্মেলক, ১২টি একক গান ও ৩টি পাঠ পরিবেশন করা হয়। দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে সব মিলিয়ে দেড়শতাধিক শিল্পী অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিল ছায়ানট, এখন তা বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া প্রতিটি পহেলা বৈশাখেই সে অনুষ্ঠান হয়েছে; নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়েছে সুরের মূর্ছনা আর কথামালায়। কোভিডের দুবছর এ আয়োজন করা হয় ভার্চুয়ালি।
২০০১ সালে ছায়ানটের বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। তাতে ১০ জন নিহত হন। এরপর থেকে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই প্রতি বছর বর্ষবরণের এ আয়োজন হচ্ছে।
১৯৬১ সালে পাকিস্তানি শাসকদের বাধা উপেক্ষা করে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপন এবং তার সূত্র ধরে পরে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট গঠনে অনেকের সঙ্গে সনজীদা খাতুন ছিলেন নেতৃস্থানে।
বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিংবদন্তিতুল্য সনজীদা খাতুন গত ২৫ মার্চ বিকাল ৩টায় জীবনের এই বিপুল যাত্রা সাঙ্গ করেন। এবারই প্রথম সনজীদা খাতুনকে ছাড়া বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করে ছায়ানট।
এবার ছায়ানটের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে নববর্ষ কথন পাঠ করে শোনান ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী।
তিনি বলেন, "মুক্তির অন্বেষায়, দীর্ঘ বন্ধুর পথপরিক্রমায় অর্ধশতকবর্ষ পূর্বে, বিপুল আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ওই যাত্রাপথের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে, ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতসহ সকল মাধ্যম এবং বিভিন্ন স্থাপনায়।
"বাঙালির স্বাধীকার অর্জনের সংগ্রামে অনন্য মাত্রা যুক্ত করেছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব, নতুন বাংলা বছরকে বরণ করার আয়োজন। আমরা এক আলোকিত দেশ ও সমাজের স্বপ্ন দেখি, যে দেশের মানুষ সর্বজনের শান্তি-স্বস্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধর্ম-জাতি-বিত্তের বিভাজন ভাঙবে, গড়বে উদার সম্প্রীতির সহিষ্ণু সমাজ।"
সারওয়ার আলী বলেন, "বাঙালির মানবতার মুক্তিসাধনা স্বাধীন আপন দেশেও প্রত্যাশা এবং আশাভঙ্গের নানান চড়াই উতরাইয়ের দোলাচল প্রত্যক্ষ করেছে। নববর্ষের ঊষালগ্নে, আজ চোখ ফেলি হিসেব-নিকেশের হালখাতায়। একদিকে মুক্তির জন-আকাঙ্ক্ষা অর্জনের প্রত্যাশা, অন্যদিকে পীড়াদায়ক বিদ্বেষ-বিভক্তি, নারী-শিশুর অমানবিক মর্যাদাহানি ও অপরিণামদর্শী অসহিষ্ণুতা।
"সকল অতৃপ্তি প্রতিবিধানের দায় রাষ্ট্রের, তবে সমাজকেও সে দায় নিতে হয় বৈকি। সকলে ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ, মুক্তচিন্তার নির্ভয় প্রকাশ, আবহমান সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা হৃদয়ে ধারণ করলে, মুক্তির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুগম হবেই।"
অনুষ্ঠানে সেঁজুতি বড়ুয়ার কণ্ঠে পরিবেশিত হয় একক গান ‘আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ’;
সম্মেলক গান ‘তুমি প্রভাতের সকরুণ ভৈরবী’, মোস্তাফিজুর রহমান তূর্য’র কণ্ঠে একক গান ‘ভেঙেছো দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’, জহিরুল হক খানের কণ্ঠে একক আবৃত্তি ‘ঝড়ের খেয়া’ (নির্বাচিত অংশ)।
সম্মেলক গান ‘সকল কলুষতামসহর, জয় হোক’, ফারজানা আক্তার পপির কণ্ঠে একক গান ‘তোর ভিতরে জাগিয়া কে যে’; সুমন মজুমদারের কণ্ঠে একক গান ‘জগতের নাথ করো পার হে’, সম্মেলক গান ‘মোরা সত্যের 'পরে মন’; ফারহানা আক্তার শ্যার্লি’র কণ্ঠে একক গান ‘আজি নূতন রতনে’; খায়রুল আনাম শাকিলের কণ্ঠে একক গান ‘গগনে প্রলয় মেঘের মেলা’ পরিবেশিত হয়।
সুমনা বিশ্বাস আবৃত্তি করেন ‘দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য’, ছোটদের সম্মেলক গানে ছিল ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। এছাড়া লাইসা আহমদ লিসা কণ্ঠে তুলে নেন 'আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায়’।
সম্মেলক গান ‘মোরা এক বৃন্তে দু'টি কুসুম’; সৈয়দা সনজিদা জোহরা বীথিকার কণ্ঠে একক গান ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়’; সুস্মিতা দেবনাথ শুচির কণ্ঠে একক গান ‘মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ’ পরিবেশিত হয়।
সম্মেলক গান ‘এই বাংলা রবি ঠাকুরের’, আবুল কালাম আজাদের কণ্ঠে একক গান ‘এ বিশ্ব মাঝে যেখানে যা সাজে’; চন্দনা মজুমদারের কণ্ঠে একক গান ‘মন সহজে কি সই হবা’; জয়ন্ত রায়ের কণ্ঠে একক আবৃত্তি ‘সভ্যতা’ (নির্বাচিত অংশ) পরিবেশন করা হয় অনুষ্ঠানে।
এছাড়া সম্মেলক গান ‘ও আলোর পথযাত্রী’ এবং ‘আইজ আইলো রে বছর ঘুরি’ পরিবেশিত হয়।
সারওয়ার আলীর নববর্ষ কথনের পর সকলে মিলে ‘জাতীয় সংগীত’ গেয়ে আয়োজনের সমাপ্তি হয়।
রমনা উদ্যান থেকে এই আয়োজন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেল (youtube.com/@chhayanautbd) ও ফেইসবুক পেইজে (facebook.com/chhayanautbd)। বিটিভিও সরাসরি সম্প্রচার করে অনুষ্ঠান।