সর্বস্তরে থাক মায়ের ভাষা, শহীদ দিবসের প্রত্যাশা

“এখনো সর্বোচ্চ আদালতে ইংরেজিতে অধিকাংশ রায় হয়। সাইনবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন ও বিজ্ঞাপন সবখানেই ইংরেজির দাপট। তাহলে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হল কেন?”, বললেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2024, 11:06 AM
Updated : 21 Feb 2024, 11:06 AM

মিছিলে ঝরা কিছু টগবগে প্রাণ, এনে দিল মায়ের ভাষার গান, নিয়ে গেল স্বাধিকার আর স্বাধীনতা পথে, তারা চির অম্লান; গৌরব আর শোকের একুশ আলোয় সেই বীরদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করল জাতি।

মায়ের শেখানো বুলিকে সাত দশক আগে তারা এনে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। বাঙালির ইতিহাসের গৌরবের সেই অধ্যায় স্মরণে এবারও ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে শহীদ মিনারের বেদী।

ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের দিনটি প্রতি বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় মর্যাদার সঙ্গে। আহ্বান জানানো হয়- বিদেশি ভাষার দাপটে যেন রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ভাষা ম্লান না হয়ে যায়, অফিস-আদালত বা সবক্ষেত্রে যেন চলে বাংলা, যাতে অক্ষুণ্ন থাকে নিজেদের ভাষার মর্যাদা।

অন্য বছরের মত এবারো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের স্মৃতির চরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সেই আহ্বান জানালেন একদল মুক্তিযোদ্ধা। ‘জাতীয় সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশন’ এর ব্যানারে এসেছিলেন তারা।

ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর পর আক্ষেপ করে তারা বললেন, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সাত দশকেও দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এখনো ঘটেনি। ‘বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা?’- রামনিধি গুপ্তের এই চরণই যেন তাদের অভিব্যক্তি।

সংগঠনটির সদস্য সচিব মুক্তিযোদ্ধা গোলাম কাদের বাবুল বলেন, “ভাষাই তো আমাদের স্বাধীনতা এনে দিল। স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৭১ এর আগে আমরা কতটা অবহেলিত ছিলাম, সেটা ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করে। আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। রক্ত দিয়ে সেই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল।

“বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গর্ব হয়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পরও দেশের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন না হওয়া দুঃখজনক। এখনো আমাদের সর্বোচ্চ আদালতে ইংরেজিতে অধিকাংশ রায় হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে শুরু করে সাইনবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন ও বিজ্ঞাপন সবখানেই ইংরেজির দাপট। তাহলে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হল কেন?”

সাপ্তাহিক ‘একাত্তরের গেরিলা’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, “আজকে আমাদের জন্য একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার দিন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালিকে আত্মহুতি দিতে হয়েছে। আজকে এটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য গৌরবের।

“কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আমরা বাংলা ভাষাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারি নাই। এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। তরুণ প্রজন্ম মনেপ্রাণে মাতৃভাষাকে লালন করতে পারছে না।”

মোফাজ্জল হোসেন বলেন, “বিশ্বের নয়টা দেশে আমি ঘুরেছি। আমি দেখেছি, মাতৃভাষাকে তারা অনেক সম্মান করেন। তারা সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে উপস্থাপন করা চেষ্টা করে।”

কালো পাঞ্জাবি, হাতে রক্তরাঙা ফুল আর শ্রদ্ধায় নাঙ্গা পায়ে একুশের প্রথম প্রহর থেকেই জনতার ঢল নামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এরপর ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই শোনা যায় প্রভাতফেরির সেই গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… আমি কি ভুলিতে পারি’।

বুধবার একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঙালির শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধান, ঢাকার বিভিন্ন মিশনের কূটনীতিকরাও ফুল নিয়ে হাজির হন শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা জানান ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নেতারা।

ঢাকার দুই সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলাম পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন শহীদ বেদীতে। সহকর্মীদের নিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল।

সকালে কালো ব্যাজ ধারণ করে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি আজিমপুরে ভাষা শহীদদের কবরেও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ।

অপরদিকে রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রভাতফেরি নিয়ে আজিমপুরে ভাষা শহীদদের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। শোকের ব্যানার, কালো পতাকা আর কালো ব্যাজ নিয়ে সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে তারা পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।

একুশের প্রথম প্রহরেই জিএম কাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ওয়াকার্স পার্টি, জাসদ, বাসদ, সিপিবি, ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে স্মরণ করা হয় ভাষা শহীদদের।

বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের সন্তানদের নিয়ে শহীদ মিনারে আসেন ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশন থেকে আসা তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম বলে, “আমাদের বাংলা বইয়ে এই লালবৃত্তের শহীদ মিনারটা দেখেছি। ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, জব্বারের নাম পড়েছি। আজকে এখানে এসে ফুল দিতে পেরে ভালো লাগছে।”

বাবার সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসেছিল আজিমপুর ওয়েস্টার্ন হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিউল বাসেত নিয়ন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিয়ন বলে, “টিভিতে শহীদ মিনার আর ভাষা শহীদদের কথা জেনে এখানে আসতে খুবই আগ্রহী ছিলাম। বাবা তাই নিয়ে এসেছে।”

নিয়নের বাবা আব্দুল বাসেত খোকন বলেন, “আমরা যে ভাষায় কথা বলি, এ ভাষাটা কীভাবে আসল, কত কষ্টের বিনিময়ে এ ভাষাটাকে আমরা পেয়েছি, এটা জানানোর জন্য ছেলেকে নিয়ে এসেছি। যাতে মায়ের ভাষার প্রতি তার মমতাবোধ থাকে এবং ভাষা সম্পর্কে আরও উৎসাহী হয়।”