পরিত্যক্ত বিমানবন্দরে আশা খুঁজছে এয়ারলাইন্সগুলো, বেবিচকের ভাবনায় নেই

বেবিচক বলছে, অভ্যন্তরীণ সচল বিমানবন্দরগুলোর মানোন্নয়ন ও সেবা বাড়ানোই আপাতত তাদের লক্ষ্য।

গোলাম মর্তুজা অন্তুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2023, 05:46 AM
Updated : 25 Feb 2023, 05:46 AM

পদ্মা সেতুসহ যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে আকাশপথে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী কমার ‘আশঙ্কা’ করছে বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো, ফলে ব্রিটিশ আমলে তৈরি পরিত্যক্ত, কার্যক্রম সঙ্কুচিত কিংবা বন্ধ হয়ে পড়া বিমানবন্দরগুলো সচলের কথা বলছে তারা।

তবে আকাশপথের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, সেসব বিমানবন্দরকে আবার জাগিয়ে তোলার কথা আপাতত ভাবছে না তারা।

বরং অভ্যন্তরীণ যে বিমানবন্দরগুলো সচল রয়েছে, কিংবা কার্যক্রম খানিকটা কমে এসেছে, সেগুলোর মানোন্নয়ন ও সেবা বাড়ানোর কথা বলছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। পুরনো বা পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো চালুর বিষয়টি তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু পোস্টে বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ আমলে তৈরি সাতটি (বর্তমানে পরিত্যাক্ত) বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এমন খবরে যেসব এলাকার বিমানবন্দরগুলোর অবস্থান সেসব এলাকার বাসিন্দারা ওই পোস্টগুলো শেয়ার করছেন। তবে বেবিচক বলছে, সেই আশা ‘আপাতত পূরণ হচ্ছে না’।

বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর সংগঠন এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বলছে, যোগাযোগ কাঠামোর উন্নয়নে বিমান পরিবহনের অভ্যন্তরীণ বাজার ছোট হয়ে আসছে, যে কারণে নতুন গন্তব্য খোঁজা প্রয়োজন। আর সেজন্য পরিত্যাক্ত বিমানবন্দরগুলোতেই আশা দেখছে তারা।

সিভিল এভিয়েশনের হিসেবে, বর্তমানে দেশে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পাশাপাশি ১২টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর রয়েছে। এ ১২টির মধ্যে রাজশাহী, সৈয়দপুর, বরিশাল, যশোর ও কক্সবাজারের বিমানবন্দর এখন বাণিজ্যিকভাবে সচল।

বাকি সাতটির মধ্যে বাগেরহাট বিমানবন্দর নির্মাণাধীন। আর তেজগাঁও, শমসেরনগর (মৌলভীবাজার) ও বগুড়া বিমানবন্দরে এয়ার অপারেশন শুরুর অনুমোদন নেই। ঈশ্বরদী, কুমিল্লা ও ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দরের সেবা এখন বন্ধ।

এর বাইরে পটুয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশদের তৈরি করা এয়ারফিল্ড রয়েছে, যেগুলোর কোনো কোনোটি সামরিক প্রয়োজনে কাজে লাগছে।

এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশদের শাসনে। তখন ব্রিটিশ উড়োজাহাজগুলো একবার জ্বালানি নিয়ে খুব বেশি দূর যেতে পারত না। সেজন্য ব্রিটিশরা দেশজুড়ে বিমান ওঠানামার উপযোগী কিছু এয়ারফিল্ড তৈরি করে। পরে সেগুলোর ওপর নির্ভর করেই দেশের বেসামরিক বিমান পরিবহন শুরু হয়।

এগুলোর অনেকগুলোই ‘শর্ট টেক অফ অ্যান্ড ল্যান্ডিং’ এর উপযোগী হলেও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয়নি। তবে এ বিমানবন্দরগুলো ঘিরেই নতুন পথ খোঁজার কথা ভাবছে এয়ারলাইন্সগুলো।

নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং  এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব মফিজুর রহমান বলেন, কোভিডের আগ পর্যন্ত প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে এয়ারলাইন্সের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছিল। অথচ পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বরিশালের ফ্লাইট মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে। একইসঙ্গে অন্যতম আরেকটা গন্তব্য যশোর, সেখানেও যাত্রী ২০-২৫ শতাংশে নেমে আসছে।

আগে যশোরে প্রতিদিন ১৫টা ফ্লাইট চালাত নভোএয়ার, এখন পাঁচটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। কখনো এর নিচেও নামছে। পর্যাপ্ত যাত্রী নেই, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলছে ফ্লাইটগুলো।

মফিজুর রহমান বলেন, “অভ্যন্তরীণ বাজারটা অলরেডি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। এখানে সম্প্রসারিত হওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। কক্সবাজার কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের একটা বিরাট অংশ, অভ্যন্তরীণ মোট যাত্রীর ৩৫ শতাংশই কক্সবাজারের। সেখানে নতুন রেললাইন হয়ে গেলে, কর্ণফুলী টানেল হয়ে যাওয়ার পর কক্সবাজারেও ৭০ শতাংশ ফ্লাইট কমে যাবে বলে আমরা ধারণা করছি।

“উত্তরবঙ্গেও রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে, সেখানেও ফ্লাইট কমে যাবে। আগামীতে আমরা যে দৃশ্যটা দেখব, তা হল আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারটা হয়ত ৭ থেকে ৮ শতাংশ বাড়বে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে বিরাট ধস নামবে। এখনি আমাদের মোট সক্ষমতার বিপরীতে চাহিদা আছে মোটে ৬০ শতাংশ।”

অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান পরিবহনে নতুন গন্তব্য খোঁজার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে মফিজুর বলেন, “রোড নেটওয়ার্ক ভালো হতেই থাকবে। আমাদের অনেকগুলো এয়ারফিল্ড যেগুলো অব্যবহৃত আছে, সেগুলাতে আমাদের খুঁজতে হবে। এরমধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মনে করি ঈশ্বরদী।

“একটা বিরাট কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি সেখানে আছে, পাশাপাশি আছে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র। ঈশ্বরদী বিমানবন্দরটা যদি আবার অপারেশনে নিয়ে আসা যায় তাহলে এটা সম্প্রসারণের একটা এরিয়া হবে।”

নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “আমরা টুরিজম বেইজড একটা সম্ভাবনা দেখি মৌলভীবাজারের শমসেরনগর এয়ারপোর্টে। সেখানে অনেকগুলো রিসোর্ট আছে, বেড়ানোর জায়গা আছে। আবার উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁওয়ে যে এয়ারপোর্টটা আছে সেটা সৈয়দপুর থেকে সড়কপথে দুই ঘণ্টার দুরত্বে, সেটাও যদি কানেকশন করা যায়, তাহলে সেখানেও ডমিস্টিকে আমরা সম্প্রসারণ দেখছি।“

বাগেরহাট বিমানবন্দরের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, “অনেকদিন আলোচনায় আছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। জমি-জমা একোয়ার করা হয়েছে। বাগেরহাটে যদি একটা এয়ারপোর্ট করতে পারি, এটার সাথে মোংলা পোর্ট আসবে, এই পোর্টটা আস্তে আস্তে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। এছাড়া এর আশপাশে রামপাল বা অন্যান্য যে শিল্প স্থাপনা গড়ে উঠছে তার ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এই এয়ারপোর্টটা অনেক কাজে আসবে। তাছাড়া এখানে সুন্দরবন ভিত্তিক পর্যটনের একটা ব্যাপার আছে।

“আমরা যদি বাগেরহাট এয়ারপোর্টটাকে ইকো ট্যুরিজম বেইজড একটা কনসেপ্ট নিয়ে ডেভেলপ করতে পারি, তাহলে কিন্তু এখানেও একটা সম্ভাবনা আছে। ডমিস্টিকে এখন যেমন একটা সঙ্কোচন হচ্ছে, আমরা এগুলোকে যদি এক্সপ্লোর করতে পারি তাহলে কিন্তু আমাদের ডমিস্টিকের সম্প্রসারণের আরেকটা সুযোগ আসবে।”

তবে এখন পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো চালুর পরিকল্পনা না থাকার কথা জানিয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, “আমরা আপাতত পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলোর দখল নিচ্ছি। বিভিন্ন লোকজন আশপাশে দখল করে নিচ্ছিল। সেজন্য এই জায়গাগুলোর নিরাপত্তা বেস্টনি দেওয়া, জায়গা বুঝে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। এখন সেই উদ্যোগটাই নেওয়া হচ্ছে ।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই পরিত্যাক্ত বিমানবন্দরগুলো চালু করার বিষয়টি আমাদের প্রায়োরিটিতে নেই। সেগুলো চালুর কোনো পরিকল্পনাও এখন আমরা করছি না। আমাদের প্রয়োরিটি এখন দেশের বিদ্যমান ডমিস্টিক বিমানবন্দরগুলোর মানোন্নয়ন করা, সেগুলোর সেবা বাড়ানো।

“দেশের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোর কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে থার্ড টার্মিনালের কাজ চলছে। ওগুলো হয়ে গেলে তারপর যেসব এলাকায় (বিমানবন্দর) চালু করা যায় সেগুলো আমরা দেখব। কোন এলাকায় করলে ভায়াবল হবে সেটা স্টাডি করেই সিদ্ধান্ত হবে। জনস্বার্থে যেখানে প্রয়োজন সেখানে বিমানবন্দর করা হবে।”