কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার মধ্যে গুলিবিদ্ধ অনেক এখনো হাসপাতালে ভর্তি। একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে তাদের। পঙ্গু হাসপাতালে কাটতে হয়েছে ছয় জনের পা।
Published : 02 Aug 2024, 11:24 PM
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে এক যুবকের কোমরের কাছে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করছিলেন একজন নার্স। ওই ব্যক্তি ব্যথায় ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলে তীব্র আর্ত-চিৎকার করছিলেন।
গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিটির নাম খোরশেদ আলম। মোটরগাড়ি কেনাবেচা করেন। বাসা বনশ্রীতে। গত ১৯ জুলাই জুমার নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে মসজিদের সামনেই গুলিবিদ্ধ হন।
তার পেটে শটগানের কয়েকটি গুলি লেগেছে। ভর্তির পর এ পর্যন্ত চার দফা অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের জায়গায় সংক্রমণ হয়েছে।
খোরশেদের কাহিনি জানা গেল তার পাশে থাকা বন্ধু সালমানের কাছ থেকে।
গত বুধবার তিনি বলেন, “অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে শটগান দিয়ে গুলি করা হয়েছে, অনেকগুলো গুলি ঢুকেছে পেটে। এখন পর্যন্ত চার দফা অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, আজ আবার করতে হবে। পায়খানার রাস্তা ফেলে দেওয়া হয়েছে, সুস্থ হলে তিন মাস পর আবার সেটা অপারেশন করতে হবে। সুস্থ হবে কিনা জানি না, হলেও দীর্ঘ সময় লাগবে।”
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে গত ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ নামে যে কর্মসূচির ডাক আসে, সেদিন ঢাকার বাড্ডা ও উত্তরায় সংঘর্ষে কয়েকজন শিক্ষার্থীর প্রাণহানির পর উত্তাপ ছড়ায়। বিকালের দিকে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় একযোগে হামলা হয়, সংঘাতে শিক্ষার্থী নয়, এমন মানুষদের উপস্থিতিও দেখা যেতে থাকে।
পরের দিনও চলতে থাকে সংঘর্ষ, গুলি, প্রাণহানি। উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে মধ্যরাতে জারি হয় কারফিউ। তবু চলতে থাকে সংঘর্ষ। ২১ জুলাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সামনে আসে।
সরকারের তরফেই দেড়শ মানুষের মৃত্যুর তথ্য এসেছে, তবে আহতের সংখ্যা কত, সেই হিসাব জানানো হয়নি।
আহতদের একটি বড় অংশই হাসপাতালে যান গুলির ক্ষত নিয়ে।
ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, গুলিতে আহতদের মধ্যে অনেকের পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে, হাড় গুঁড়ো হয়ে যাওয়ায় পাও কেটে ফেলতে হয়েছে বেশ কয়েকজনের।
ঢাকা মেডিকেলে খোরশেদের পাশের শয্যায় আছেন কামরুল হাসান, যিনি গুলিস্তানে হামদর্দের একটি বিক্রয়কেন্দ্রে চাকরি করেন। তিনিও ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন, ঘটনাস্থল বায়তুল মোকাররমের সামনে।
তার ভাই হাসিবুর হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, অফিস শেষে বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন কামরুল। নামাজের পর পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ শুরু হলে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
“অপারেশন হয়েছে। অপারেশনের ১০ দিন পর মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) সেলাই কাটছে। তবে ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয়ে গেছে। এখন ড্রেসিং করছে, আবার সেলাই করবে। ১০ দিন পর সেলাই কেটে দেখবে ঠিক আছে কি না। আমরা জানি না কবে বাসায় যেতে পারব। পুরোপুরি সুস্থ হবে কবে তাও জানি না।”
গুলিতে আহত রোগীদের একটি বড় অংশ চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। তবে যাদের জখম গুরুতর, তারা এখনো হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। ভবিষ্যতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কি না, এ নিয়ে সংশয়ে রোগী ও তার স্বজনরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০১, ১০২ এবং ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে জায়গা হয়েছে গুলিবিদ্ধদের। তারা সার্জারি বিভাগের অধীনে চিকিৎসাধীন।
উত্তরা এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন ১৭ বছরের রোমান মিয়া, বাসা আজমপুর কাঁচাবাজার এলাকায়। ১৮ জুলাই উত্তরাতেই তার পিঠে কোমরের পেছন দিক দিয়ে রাবার বুলেট লাগে। কোমরের হাড় ভেঙে যাওয়ায় বাম পা অবশ হয়ে গেছে।
রোমানের মা, বোন তাকে দেখাশোনা করছেন।
বোন রিমি আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের বাবা ক্যান্সার আক্রান্ত, রোমানই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কেউ একজন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে দিয়ে যায়। খবর পেয়ে পরে তারা হাসপাতালে আসেন।
কোমর থেকে গুলি বের করা হলেও কোমরের হাড়ের চিকিৎসা এখনও শুরু হয়নি।
“ডাক্তার বলতেছে আমাদের ছুটি দিয়া দিবে। কিন্তু আমরা ছুটি নিয়া গিয়া ভাইরে কই ভর্তি করামু? আমাদের সেই সামর্থ্য নাই। বাম পা নাড়াইতে পারে না, এ অবস্থায় ভাইটা কোনোদিন আর দাঁড়াইতে পারব কি না বুঝতেছি না।”
বুধবার ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ৩৭ জন রোগীর ৭০ শতাংশেই গুলিবিদ্ধ বলে জানিয়েছেন একজন নার্স।
এখানে ভর্তি রোগীদের শারীরিক অবস্থা কী- এই প্রশ্নে সার্জারি বিভাগের প্রধান সালমা সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাইছি না। বিষয়টি নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে কথা বললে ভালো হয়।”
হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে গিয়ে দেখা করা সম্ভব হয়নি। মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।
গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কত রোগী ভর্তি হয়েছেন তার সঠিক তথ্যও পাওয়া যায়নি।
তবে সার্জারি বিভাগের অধীনে ৮০ জনের মত রোগী ভর্তি হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ উদ্দিন। তাদের মধ্যে ৪০ জন রোগী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
পঙ্গু হাসপাতালে পা কাটতে হয়েছে ৬ জনের
গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র– পঙ্গু হাসপাতালে এসেছিলেন ২৭২ জন। তাদের মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে অনেকে ফিরে যান। ভর্তি হন ২৪৫ জন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ভর্তি ছিলেন ৭৪ জন।
কারও হাতে, কারও পায়ে গুলি লেগেছে। এখন পর্যন্ত পা কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে ৬ জনের।
গত ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় গুলিতে আহত হয়েছেন মো. আকাশ মিয়া। আকাশের দাবি, পুলিশ তার মিষ্টির দোকানের ভেতর ঢুকে খূব কাছ থেকে গুলি করেছে। তার বাম পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে।
তার একদফা অস্ত্রোপচার হয়েছে, আরও অস্ত্রোপচার করতে হবে।
আকাশ বলেন, “আমি কোনো দল করি না, সেদিন ঝামেলার সময় আমি দোকানের শাটার ফেলে দেই। আমার মালিক, আরেকটা ছোট বাচ্চা ছেলেও সেখানে আশ্রয় নেয়। পুলিশ আইসা দোকানের শাটার খুইলা কয় আমি নাকি ছাত্রদলের কর্মী। বন্দুক আমার বুকের দিকে তাক কইরা রাখছে, আমি হাত দিয়া বন্দুক নামাইয়া দিলে গুলি হাঁটুতে লাগছে। একদম কাছ থেইকা গুলি করছে, হাড্ডিগুড্ডি সব গুড়া হইয়া গেছে।”
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা ভর্তি আছে তাদের মধ্যে তিনজন ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের বিষয়ে এখনই বলা যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি পা রাখার জন্য। যদি দেখি যে সম্ভব না, তখন কেটে ফেলতে হবে।
“যারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তাদের কাউকে কাউকে হয়ত আরও দুইতিন মাসও হাসপাতালে থাকা লাগতে পারে। অনেকে এর আগেই বাসায় চলে যেতে পারবেন।”
আবার দাঁড়াইতে পারমু কি না জানি না
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে বৃহস্পতিবার ১৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। তাদের মধ্যে ১২ জন গুলিবিদ্ধ, একজন শিশু। তাদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে চিকিৎসকরা কোনো তথ্য দেননি। সাংবাদিক পরিচয় দিলে হাসপাতালে নার্স, আয়ারাও কথা বলতে অপারগতা জানান। পরিচয় গোপন করে ওই ওয়ার্ডে গিয়ে কথা একজন নার্সের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ভর্তি রোগীদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
সেখানে ভর্তি আছেন মিরপুরের নুরুল ইসলাম নামে একজন। তার পায়ে গুলি লেগেছে। মিরপুর এলাকায় সংঘর্ষের সময় বাম পায়ে গুলি লাগে তার।
“অপারেশন কইরা গুলি বাইর করছে। কিন্তু এই পা আর ঠিক হইব কি না, আবার দাঁড়াইতে পারমু কি না জানি না। একটা গুলি জীবনটা কেমন কইরা দিল!”
১৯ জুলাই মোহাম্মদপুর জাপান গার্ডেন এলাকায় পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক এলাকার ২২ বছর বয়সী সাগর হোসেন। তিনি মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ালেখা করেন।
সাগরের মা ফাতেমা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাগরের কোমরে গুলি লেগেছে। এখন সে বাম পা নাড়াতে পারে না।
“এখন পর্যন্ত দুইবার অপারেশন হইছে। ডাক্তার কইছে অর্থোপেডিক ডাক্তার দেখাতে হবে। তিন মাস পর আবারও অপারেশন করতে হবে। হাসপাতাল থেকে কবে ছাড়া পাইব জানি না। ভবিষ্যৎ কী তাও জানি না।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক সফিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ৬৫ জন ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৪ জন আছেন।
আহতদের অবস্থা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এইগুলা নিয়া আর কথা বলা সম্ভব হবে না। এটুকুই থাক।”