দুদক টিউলিপের আইনজীবীদের চিঠির একটি জবাবও দিয়েছে। বলেছে, টিউলিপ তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশির ভাগ সময় আওয়ামী লীগের ’কুখ্যাত দুর্নীতিগ্রস্তদের’ সঙ্গে কাটিয়েছেন, যা প্রমাণ করে তিনি দলের দুর্নীতি থেকে সুবিধা নিয়েছেন।
Published : 20 Mar 2025, 01:09 AM
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের খাতায় নাম আসা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক এবার উল্টো সরকারের বিরুদ্ধে ভুয়া প্রচার চালিয়ে হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন।
তিনি বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তাকে ‘লক্ষ্য করে ভিত্তিহীন প্রচার চালাচ্ছে’। নিজের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগগুলো আবারও অস্বীকার করেছেন তিনি।
বিবিসি লিখেছে, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এক চিঠিতে টিউলিপের আইনজীবীরা বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগগুলো ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’। সংবাদমাধ্যমে বিষয়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনেননি অনুসন্ধানকারীরা।
লন্ডনে ‘বিনে পয়সার ফ্ল্যাট’ নিয়ে তদন্তের মধ্যে যুক্তরাজ্যের আর্থিক সেবা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করা টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ওঠা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তার আইনজীবীরা। দুদককে দেওয়া চিঠির বরাতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিবিসি। তবে চিঠিটি কবে পাঠানো হয়েছে সেই তথ্য দেওয়া হয়নি।
দুদকে পাঠানো চিঠিতে টিউলিপের আইনজীবী প্রতিষ্ঠান ‘স্টিফেনসন হারউড’ বলছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গে টিউলিপ কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না।
যদিও ২০১৩ সালে ক্রেমলিনে ওই প্রকল্পের চুক্তি সই অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি ছবিতে টিউলিপ, তার মা শেখ রেহানা ও খালা শেখ শেখ হাসিনাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দেখা গেছে।
চিঠিতে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সফরে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রকল্পটিতে আর্থিক অনিয়মের কোনো কিছুই তিনি (টিউলিপ) জানেন না। আর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের সঙ্গে লন্ডনের কিংস ক্রসের ৭ লাখ পাউন্ডের ফ্ল্যাট উপহারের বিষয়টিও মেলানোও সত্য নয়। এটা অযৌক্তিক। কারণ কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটের বিষয়টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পেরও ১০ বছর আগের, ২০০৪ সালের।
আরও পড়ুন:
এবার গুলশানের ভবনের সঙ্গে 'টিউলিপ সংযোগ': দ্য টেলিগ্রাফের খবর
'ভুয়া' নোটারিতে বোনকে গুলশানের ফ্ল্যাট দেন টিউলিপ, বলছে দুদক
টিউলিপের আইনজীবীরা বলেন, কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটটি আবদুল মোতালিফ নামের এক ব্যক্তি দিয়েছিলেন, যিনি তার পরিবার ঘনিষ্ঠ।
দুদক সংবাদমাধ্যমের সামনে ঢাকার পূর্বাচলে প্লটে অনিয়মে টিউলিপের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, টিউলিপের আইনজীবীদের চিঠিতে সেগুলোর বিস্তারিত যুক্তিখণ্ডন করা হয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, সংবাদমাধ্যমের সামনে দুদকের ব্রিফিং টিউলিপের যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার একটি নজিরবিহীন চেষ্টা। তার বিরুদ্ধে কোনোভাবেই কোনো অভিযোগ স্বচ্ছ, যথাযথ ও নায্যভাবে দাখিল করা হয়নি, হোক সেটা দুদক কিংবা সরকারেরর পক্ষে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো অভিযোগ।
”টিউলিপের বিরুদ্ধে মিথ্যা আর উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগ করা বন্ধ করুন। সেইসঙ্গে তার মর্যাদা হানি করে এমন মিডিয়া ব্রিফিং ও সবার সামনে অভিযোগগুলো নিয়ে সবার সামনে খোলাখুলি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।”
চিঠিতে দুদকের উদ্দেশে বলা হয়, “টিউলিপ সিদ্দিকের কাছে অবশ্যই দ্রুত প্রশ্ন রাখতে হবে এবং সেটা যেকোনো পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চের মধ্যে। না হলে আমরা ধরে নেব, জবাব দেওয়ার মত কোনো বৈধ প্রশ্নের সুযোগ নেই।”
বিবিসি লিখেছে, দুদক টিউলিপের আইনজীবীদের চিঠির একটি জবাবও দিয়েছে। দুদক বলছে, টিউলিপ তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশির ভাগ সময় আওয়ামী লীগের ’কুখ্যাত দুর্নীতিগ্রস্তদের’ সঙ্গে কাটিয়েছেন, যা প্রমাণ করে তিনি দলের দুর্নীতি থেকে সুবিধা নিয়েছেন।
দুদকের একজন মুখপাত্র জবাবে বলেন, “হাসিনার শাসনের চরিত্র সম্পর্কে তার না জানার দাবির বিষয়টি অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। দুদক ‘যথাসময়ে’ তার আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।”
দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন দ্য টাইমসকে বলেন, টিউলিপের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ যুক্তরাজ্যের আদালতসহ যেকোনো আদালতে প্রমাণিত হবে।
লন্ডনে ‘উপহারের ফ্ল্যাট কাণ্ডে’ পদত্যাগ করা টিউলিপ বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি। বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। পূর্বাচলে টিউলিপসহ শেখ ও সিদ্দিক পরিবারের সদস্যদের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়েও মামলা করেছে দুদক।
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি বলছে, বাংলাদেশে টিউলিপের কোনো সম্পত্তি নেই। ফলে বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। যদিও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অভিজাত এলাকায় তার সম্পত্তির কথা বলা হয়েছে।
লন্ডনে বিনামূল্যে ফ্ল্যাট উপহার নেওয়া, বাংলাদেশের প্রকল্পে বড় অঙ্কের দুর্নীতিতে টিউলিপের নাম আসার পর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সাত মাসের মাথায় গত ১৪ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান টিউলিপ। পরিস্থিতি জটিল করে তোলে লন্ডনের কয়েকটি বাড়ি, যা তাদের দেন ধনাঢ্য বাংলাদেশিরা, যাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার যোগ আছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় কিংস ক্রসের একটি ফ্ল্যাট, যেটা টিউলিপকে উপহার দিয়েছিলেন আবদুল মোতালিফ নামের এক ব্যবসায়ী, যিনি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ। এখন ওই ফ্ল্যাটের দাম ৭ লাখ পাউন্ড। ওই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে টিউলিপ থাকেন অন্য বাসায়।
ব্রিটেনের সিটি মিনিস্টার হিসেবে আর্থিক খাতের দুর্নীতি বন্ধ করা টিউলিপের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সেখানে টিউলিপের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জোরালো হয়। তবে প্রথম থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন ৪২ বছর বয়সী টিউলিপ।
অভিযোগ নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের ইনডিপেনডেন্ট এথিকস অ্যাডভাইজর (স্ট্যান্ডার্ডস ওয়াচডগ) স্যার লাউরি ম্যাগনাস তদন্ত করেন। এরপর গত ১৪ জানুয়ারি দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেন টিউলিপ। পদত্যাগপত্রেও তার অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
টিউলিপ ও তার পরিবার ঘনিষ্ঠদের নিয়ে দুর্নীতির মামলা ছাড়াও রাজধানী ঢাকার পূর্বাচলে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের অনিয়ম করে নেওয়া প্লটের মামলাতেও তার নাম এসেছে।
এ ছাড়া গাজীপুরের কানাইয়ায় অবকাশযাপনের বাড়ি ‘টিউলিপ’স টেরিটরি’ নিয়েও অনুসন্ধান করছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মধ্যেই গুলশানে তার নতুন সম্পত্তি ‘সিদ্দিকস’ ভবনের খবর মেলে।
টিউলিপ পরিবারের আরেক সদস্যের সঙ্গে এর আগে ঢাকায় ১ লাখ পাউন্ডের একটি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছিলেন, যেটি ২০১৫ সালে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-
এবার গুলশানের ভবনের সঙ্গে 'টিউলিপ সংযোগ': দ্য টেলিগ্রাফের খবর