মোটরযানের ফিটনেস, ট্যাক্স-টোকেন, রুট পারমিট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতার মেয়াদ ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সংস্থাটি।
Published : 31 Jul 2024, 09:27 PM
কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে দেওয়া আগুনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ১৩ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে সব সেবা। তাতে বিপাকে পড়েছে মানুষ, প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে সংস্থাটির কার্যালয়ের সামনে।
সংস্থাটি বলছে, নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির নিবন্ধন, রুট পারমিট এই মুহূর্তে দেওয়া যাবে না। বন্ধ থাকবে মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস, অগ্রিম আয়কর প্রদান কার্যক্রমও।
এ অবস্থায় মোটরযান নিবন্ধনের প্রাপ্তিস্বীকার পত্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যানবাহনের কর এবং ফিটনেস সনদের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও যেন গ্রাহকদের হয়রানি না করা হয়- সেজন্য সব জেলা প্রশাসন, পুলিশকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে।
বুধবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে এরইমধ্যে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া মোটরযানের ফিটনেস, ট্যাক্স-টোকেন, রুট পারমিট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতার মেয়াদ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সহকারী সচিব মো. জসিম উদ্দিনের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ”গত ১৮ ও ১৯ জুলাই বিআরটিএ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটতরাজ করা হয়েছে। এতে বিআরটিএ ভবনে থাকা সার্ভার ও আইএস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মোটরযান সংক্রান্ত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।”
মেয়াদ বাড়ানোর সময়সীমা প্রসঙ্গে এতে বলা হয়েছে, “২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ১৬ জুলাই থেকে যেসব গ্রাহকের মোটরযানের ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, অগ্রিম আয়কর, রুট পারমিট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন সংক্রান্ত কাগজপত্রের মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়েছে অথবা ১৫ সেপ্টেম্বর অতিক্রান্ত হবে সেগুলোর মেয়াদ ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হলো।”
এ সময় নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, মালিকানা বদলি এবং নতুন যানবাহনের নিবন্ধনও বন্ধ থাকবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।
আগুনে ভোগান্তি বিআরটিএর গ্রাহকদের
কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলার সময় গত ১৮ ও ১৯ জুলাই দু’দফা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয় এবং মিরপুরে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়।
সেদিন ওই ভবনের বিভিন্ন তলায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, চালানো হয় ভাঙচুর। লুট করা হয় মূল্যবান জিনিসপত্র।
ভাঙচুর ও আগুনে ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেদিন থেকেই বিআরটিএর সব ধরনের সেবা বন্ধ আছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন গাড়ি সংক্রান্ত সেবাগ্রহীতারা।
কারফিউ শিথিলের পর থেকে প্রতিদিনই লোকজন বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয়ে ভিড় করছে। চলতি সপ্তাহে মিরপুরে বিআরটিএর ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সামনে সেবাপ্রত্যাশীদের ভিড় দেখা গেছে।
তাদের কেউ আসছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে, কেউ আসছেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করতে। কেউ ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে; যানবাহনের ফিটনেস নবায়ন, ট্যাক্স টোকেনের টাকা জমা দেওয়ার জন্যও আসছেন লোকজন।
ঢাকার গাবতলী বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা আজিজুর রহমান গাড়ি চালানোর জন্য নতুন লাইসেন্স করবেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বিআরটিএতে তার বায়োমেট্রিক ডেটা দেওয়ার কথা ছিল। তবে সেবা বন্ধ থাকায় তা দিতে পারেননি তিনি। চাকরির জন্য এটি দরকার তার। সে কারণে বিপাকে পড়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, “পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বায়োমেট্রিক ডেটা দিতে হয়। গত সোমবার ডেট ছিল। সেদিন এসে ঘুরে গেছি, বিআরটিএর অফিস বন্ধ। আজ আবার এলাম। বায়োমেট্রিক দেওয়ার পর লাইসেন্সটা পাওয়া যায়। লাইসেন্সটা আমার জন্য খুব জরুরি, একটা চাকরিতে জয়েন করার কথা।”
সেবা বন্ধ থাকায় নিজের গাড়ির বার্ষিক আয়কর পরিশোধ করতে পারছেন না ঢাকার মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার বাসিন্দা কাজী মশিউর রহমান পলাশ। করণীয় জানতে রোববার সকালে বিআরটিএ কার্যালয়ে আসেন তিনি।
পলাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাড়ির আয়করের মেয়াদ ছিল ২৪ জুলাই পর্যন্ত। ওইদিনই পরবর্তী বছরের আয়কর ব্যাংকে জমা দিয়ে ‘ট্যাক্স টোকেন’ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন।
“ব্যাংক টাকা জমা নেয়নি। তারা বলে, বিআরটিএর সার্ভার বন্ধ থাকায় ট্যাক্স টোকেনের টাকা জমা নেওয়া যাবে না। তারা যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, সেখানে ট্যাক্সের টাকা জমা না দিলে কী হবে তা বলা হয়নি। এটা বন্ধ থাকায় দুই ধরনের ঝামেলায় পড়ব, ট্যাক্স টোকেন ডেট ফেইল হওয়ায় বিআরটিএকে জরিমানা দিতে হবে, আবার রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশও মামলা দেয়।”
একটি টয়োটা সেডান কারের ফিটনেস নবায়নের শেষ সময় ছিল রোববার। এজন্য গাড়ি নিয়ে নিউ মার্কেট এলাকা থেকে এসেছেন ফখরুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ আজ। ফিটনেসের নবায়নের জন্য তো অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ দেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে আমি কাল থেকে কীভাবে গাড়ি চালাব?
“আর ডেট ফেইল হয়ে যাওয়ায় আমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিআরটিএ একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে- সেখানে ফিটনেসের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।”
বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয় চত্বরে তাঁবু টানিয়ে বসার ব্যবস্থা করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রতিদিন তারা এখানে এসে বসেন। তবে কার্যালয়ের কক্ষগুলো ভাঙচুর করায় সেখানে যেতে পারছেন না, সেবা দিতে পারছেন না।
বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সব ধরনের গ্রাহকরাই বিআরটিএতে এসে ভিড় করছেন।
“পরীক্ষা দেওয়ার পর বায়োমেট্রিক ডেটা দেবেন- এমন গ্রাহকরা আছেন বিপদে। আবার বায়োমেট্রিক ডেটা দিয়ে বিদেশে চলে যাবেন-এমন গ্রাহকরা পড়েছেন সবচেয়ে বিপদে। বায়োমেট্রিক ডেটা দিতে পারলে ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স পেত। কিন্তু এখন তো সবই বন্ধ।”
বিআরটিএর সেবা বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন নতুন গাড়ি ক্রেতারাও। ঢাকার পুরানা পল্টনের ইয়ামাহা মোটরসাইকেলের বিক্রেতা ক্রিসেন্ট এন্টারপ্রাইজের বিক্রয় প্রতিনিধি জয়নব আকতার শিমু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মোটরসাইকেল বিক্রি করার পর অনেক ক্রেতার মোটরসাইকেলের নিবন্ধন তারাই করে দেন। তবে সার্ভার বন্ধ থাকায় এখন করা যাচ্ছে না।
“আপাতত বিআরটিএতে রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে না। যখন চালু হবে- তখন আমরা সাথে সাথে করে দেব। আমরা এখন বাইক বিক্রি করে ডিটেইল রেখে দিচ্ছি।”
এর আগে বিআরটিএ গত শুক্রবার সেবা সংক্রান্ত জরুরি বিজ্ঞপ্তি দেয়। সেখানে বলা হয়, গত ১৮ ও ১৯ জুলাই বিআরটিএ ভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের কারণে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ের সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কারণে ১৮ জুলাই থেকে বিআরটিএর সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ আছে। এ অবস্থায় ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু/নবায়ন, মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন, মালিকানা বদলি, রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ আছে। এসব সেবার বিপরীতে বিআরটিএ যে প্রাপ্তিস্বীকার রশিদ দিয়েছে, তার মেয়াদ আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান গৌতম চন্দ্র পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সার্ভার চালু না হলে আয়কর, ফিটনেস সনদের ফি নেওয়া যাচ্ছে না, কোনো কাজই করা যাচ্ছে না। এজন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি গত বৃহস্পতিবার পুলিশ বিভাগ এবং প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে বিআরটিএ।
“এখানে দুইটা বিষয় হয়েছে, যাদের অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ হাতে ছিল-তাদের যেন বিআরটিএ অফিসে এসে মেয়াদ বাড়াতে না হয়, সেজন্য আমরা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয়ত, যাদের এই স্লিপ নাই অথবা মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে-তাদের বিষয়ে আমরা পুলিশ বিভাগ এবং প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে অবহিত করছি। তাদের বলছি, এই পরিস্থিতিতে সেবা দিতে পারছি না, তারা যেন বিষয়গুলো বিবেচনা করেন।”
ডেটাসেন্টার কবে নাগাদ চালু হতে পারে-এমন প্রশ্নে গৌতম বলেন, “সার্ভারের কেবলগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। এগুলো অনেক মূল্যবান এবং যারা বিক্রি করে- তাদের কাছেও সবসময় থাকে না। আমরা কেবল সংগ্রহের চেষ্টা করছি। কেবলগুলো পুনঃস্থাপন করে সার্ভার চেক করে দেখব-কী অবস্থায় আছে। এই প্রক্রিয়াটা আমরা শুরু করেছি।”
হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শাহাবুদ্দিন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা বিআরটিএর চিঠি পেয়েছেন।
“আমি রোববার চিঠি পেয়েছি। সেখানে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিষয়টি বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা অবশ্যই ওই চিঠি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। ডেটা সেন্টার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে যেসব যানবাহনের কাগজপত্রের নবায়ন বা নিবন্ধন অথবা এ সংক্রান্ত সমস্যা হয়েছে, তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। আমাদের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদেরও বিষয়টি জানিয়ে দেব যেন তারা বিষয়টি বিবেচনা করেন।”
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় ঢাকার বনানীতে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় ভবনের নিচতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত আগুন দেওয়া হয়। ভবনের বেজমেন্টে থাকা কয়েকটি যানবাহনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
পরদিন ১৯ জুলাই দুপুরের পর বিআরটিএ কার্যালয়ে ফের হামলা চালানো হয়। এ সময় ১২ তলা ওই ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে গিয়ে ভাঙচুর করা হয়। বিভিন্ন কক্ষে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ল্যাপটপ, কম্পিউটারসহ মূল্যবান মালামাল লুট করে তারা।
প্রায় একই সময়ে মিরপুরে হামলা চালানো হয় বিআরটিএর ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে। সে সময় সেখানকার প্রবেশপথের সঙ্গে থাকা হেল্প ডেস্ক, আনসার ক্যাম্প, গাড়ি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (ভিআইসি) চারটি কক্ষ এবং ভিআইসি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া বিআরটিএর ঢাকা বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয়, বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ের মূল ভবনের প্রতিটি কক্ষের জানালার কাচ ভাঙচুর করা হয়। ঢাকা বিভাগীয় পরিচালকের গাড়িসহ পাঁচটি গাড়ি, কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন