“আমি আর আমার ভাই ছবি আঁকতাম, তারপর বনানী কবরস্থানে যেতাম, বাবার কবর খুঁড়তাম। ভাবতাম, বাবাকে আমরা স্পর্শ করতে পারব।”
Published : 25 Dec 2023, 09:29 PM
পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম নিহত হওয়ার পর তার পরিবারকে যে যুদ্ধে নামতে হয়েছিল, চার যুগ পরও তা ‘শেষ হয়নি’ বলে জানালেন তার মেয়ে নাহিদ ইজাহার খান।
সংরক্ষিত নারী আসনের এই সংসদ সদস্য বললেন, “আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত করি। যতো ঝড় আসে, সেটা আমরা মোকাবেলা করি।”
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘গেরিলা ১৯৭১’ এর আয়োজনে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের স্মরণসভায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন নাহিদ ইজাহার খান। সেখানে তার কথায় উঠে আসে তার বাবার স্মৃতি, বাবার মৃত্যুর পর বিপর্যয়ের মধ্যে টিকে থাকার সংগ্রামের গল্প।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পঁচাত্তরের নভেম্বরে চলা সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান পাল্টে দেয় বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ।
রক্তাক্ত সেই ঘটনাপ্রবাহের ৪৭ বছর পর গত মে মাসে মামলা করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান। তার বাবা, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রমকে হত্যার অভিযোগে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জাসদ নেতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরকে (অব.) হুকুমের আসামি করা হয় সেই মামলায়।
নাহিদ ইজাহার খান বলেন, “যেদিন বাবা চলে গেলেন, সেদিন থেকেই আমাদের আরেক যুদ্ধ শুরু হল এবং সেই যুদ্ধ আমরা এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছি।
“প্রথম যুদ্ধটা শুরু হল, নভেম্বরের ১০ তারিখ যখন বাবার লাশটা নিয়ে এল। সেই ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখার পর আমার যে কেমন লাগছিল, তখন আমার ৫ বছর বয়স, বাবা বলতে সেই স্মৃতিটাই আমার চোখে ভাসে। বাবার পুরো রক্তাক্ত শরীরটা পড়ে ছিল।”
তিনি বলেন, “আমি আর আমার ভাই ছবি আঁকতাম, তারপর বনানী কবরস্থানে যেতাম, বাবার কবর খুঁড়তাম। ভাবতাম, বাবাকে আমরা স্পর্শ করতে পারব।”
নাহিদ জানান, বাবার পরিচয়ের কারণে সে সময় কোনো স্কুলও তাকে ভর্তি নিতে চাইত না।
“যখন আমাদের স্কুলে যাওয়ার সময়, তখন আমাদের কোনো স্কুলে পড়তে দিত না আমার বাবার পরিচয়ে। শিক্ষা-স্কুল আমাদের জীবন থেকে চলে গিয়েছিল অনেক বছরের জন্যে। নীরব একটা যুদ্ধ ছিল।”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই সংসদ সদস্য বলেন, “আমার অন্যান্য বন্ধুরা যখন স্কুলে তার বাবার কাছে যেত, তখন আমার ভেতরে অনেক কষ্ট হত। আমি ওদের সামনে কাঁদতাম না। কিন্তু আমার বুকটা ফেটে যেত।
“আমি কোনোদিন ওই জীবনটা পাব না। বাবার হাত ধরে স্কুলের গেইট দিয়ে বের হতে পারব না। বাবা বলে ডাকতে পারব না। এবং বাবা কোনো সময়ে আমার পাশে থাকবে না। বাবার উপস্থিতি বুঝতে হলে আমাকে যেতে হয় বনানী কবরস্থানের সামনে। আমি জানি না বাবা তখন আমার কথা শোনার জন্য আমার পাশে থাকেন কিনা।”
নাহিদ ইজাহার খান যখন তার বাবার কথা বলছিলেন, দর্শক সারিতে থাকা অনেকের চোখ ভিজে যাচ্ছিল।
“বাবা না থাকাটা যে কত বড় কষ্টের, কোন বাবা-মায়ের যখন অপমৃত্যু হয়, তা যে কতটা কষ্টের, সেই সন্তানরাই তা বুঝতে পারে,” বলে চলেন নাহিদ।
কান্না মুছে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, “শুধু পড়াশোনা না, তোমরা অমায়িক হও। ভালো মানুষ হও। বাবা-মা বড়দের শ্রদ্ধা করো। আমরা অনেক ত্যাগ করেছি, ত্যাগ সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় ও বিজয়ের মুখ দেখায়। এটাতে একটি আত্মতৃপ্তি আছে।
“আমাদের বাবারা বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যেই। আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কখনও কেন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করব না।”
টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার ইচ্ছা বীরাঙ্গনা রিজিয়ার
অনুষ্ঠানে যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করেন বীরাঙ্গনা রিজিয়া খাতুন।
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর যখন আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, জিয়া আমার স্বামীকে আটকায় রাখছিল। আমরা অনেক কষ্ট করছি। মানুষকে এত অত্যাচার করছে পাকিস্তানিরা, মেয়েদের নির্যাতন করছে।
“পানি পাই নাই, ভাত পাই নাই। কত জায়গায় পালায় থাকছি। তিন মাস নিখোঁজ ছিল। আমারে মাইরা গাথায় ফালায় রাখছিল। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না কইরা খাওয়াছি দেইখা অত্যাচার করছে। যুদ্ধের কয়েকদিন আগে আমার স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে কারওয়ান বাজার থেকে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করছে।”
স্বাধীন দেশে মানুষের কাছ থেকে যে অনেক ‘অসম্মানজনক কথা’ শুনতে হয়েছে, সে কথাও বলেন রিজিয়া খাতুন।
তিনি জানান, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধে যাওয়ার ইচ্ছা তার অপূর্ণই রয়ে গেছে।
অনুষ্ঠানে যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুনও উপস্থিত ছিলেন। তার বিষয়ে সাংবাদিক মাসুদ পারভেজ বলেন, মেরিনার এখনও গেজেট হয়নি।
“মেরিনা আপা যুদ্ধ শিশু। তার মা কচি বেগম। মেরিনা আপার বাবার নামের জায়গায় কচি বেগমের স্বামীর নাম ছিল, যে কারণে যুদ্ধশিশু হওয়ার পেছনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এখন পর্যন্ত মেরিনা খাতুনের গেজেট হয়নি। আমি এই জায়গাটি থেকে উত্তরণ চাই।
“যুদ্ধ শিশু যারা আছেন, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মত সম্মান পাবে, কিন্তু অর্থ পাবে না? মুক্তিযোদ্ধারা যে সকল সুযোগ-সুবিধা পায়, তা যেন মেরিনা আপারা পায়।”
সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান বলেন, রিজিয়া খাতুন যাতে টুঙ্গিপাড়ায় যেতে পারেন, সেজন্য তিনি সগযোগিতা করবেন। চেষ্টা করবেন মেরিনা খাতুনের জন্যও।
তিনি বলেন, “আপনাদের দুজনের বিষয়েই আমি কাজ করব। আপনাদের যতটুকু প্রাপ্য, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি তা অবশ্যই করব।”