‘রাস্ট্র ভাষা গান’ ও একজন পল্লীকবি শামসুদ্দীন

আশেক ইব্রাহীম
Published : 22 Feb 2017, 04:07 AM
Updated : 22 Feb 2017, 04:07 AM

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙ্গালী
তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।
১.
আমরা তাকে চিনি চারণ কবি শামসুদ্দীন নামে, তিনি নিজের নাম লিখতেন 'সেখ সামছুদ্দীন' গ্রাম: ফতেপুর, পোস্ট: বাগেরহাট, জেলা খুলনা (১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত গানের বই থেকে নেওয়া)। জন্ম আনুমানিক ১৩২১-২২ বঙ্গাব্দ (১৯১৫ খ্রি.) মৃত্যু ১৩ ই আশ্বিন ১৩৮১ বঙ্গাব্দ (২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ খ্রি.)। ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানের রচয়িতা হিসেবে খুব বেশীদিন হয়নি এই নামটি আমাদের আলোচনায় এসেছে। 'রাস্ট্র ভাষা গান' নামে পরিচিত অমর এই গানের রচয়িতা কবি শামসুদ্দীন একুশের প্রথম গানের রচয়িতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, এমন কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। বিভিন্ন লেখার সূত্র ধরে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় বাগেরহাট এ, সি, লাহা টাউনক্লাবে সর্বদলীয় সমাবেশে কবি শামসুদ্দীন স্ব-কন্ঠে এই গান গেয়ে ভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন।

কবি শামসুদ্দীনের পরবর্তি প্রজন্ম, আবুবকর সিদ্দিক, মোহাম্মদ রফিক এবং ভাষাসংগ্রামী মনসুর আহম্মেদ প্রমুখ পল্লীবাসি কবি সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁকে স্মরণ করেছেন বিভিন্ন প্রবন্ধে, স্মৃতিচারণায়, গল্পে। পৌঁছে দিয়েছেন বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত। কবি আবুবকর সিদ্দিকী সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লিখেছিলেন কবি শামসুদ্দীন এবং তাঁর গান নিয়ে। বাগেরহাটের ভাষাসংগ্রামী মনসুর আহমদ লিখেছেন বাগেরহাটের ছোটকাগজ 'চোখ'-এর ফেব্রুয়ারী ১৯৯০ সংখ্যায়। মোহাম্মদ রফিক তার গল্পগ্রন্থ 'গল্পসংগ্রহ' –এ গল্প লিখেছেন কবি শামসুদ্দীনকে নিয়ে। আড্ডায় আলোচনায় বাগেরহাটের প্রবীণ মানুষের কাছ থেকে শামসুদ্দীন সম্পর্কে শোনা যায়। কয়েকদিন আগে কবি মোহাম্মদ রফিক তার পৈত্রিক গ্রাম বৈটপুরে বেড়াতে আসেন, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এক প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেছিলেন, "জানো, বাঙ্গালী শব্দটা আমি জীবনে প্রথম শুনেছিলাম শামসুদ্দীনের এই গানে"। বাগেরহাটে আরেক কিংবদন্তী প্রয়াত গনি সরদার, যিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রতি বছর ২০ ফেব্রুয়ারী রাত ১২ টার পর থেকে সারারাত একটা ভ্যানের সামনে লাউড স্পিকারে 'রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙ্গালী, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি'-এই গান গাইতে গাইতে কাঁদতেন আর ঘুরে বেড়াতেন শহরের অলিতে গলিতে। তার কন্ঠে প্রকাশিত হাহাকার আমাদের নিয়ে যেত ৫২ সালের রক্তাক্ত রাজপথে। সমস্ত শহর যেন বুকচাপা কান্নায়, শোকে নিমজ্জিত হয়ে থাকত সমস্ত দিন। শ্রদ্ধেয় গনি সরদারের কন্ঠেই এই গান আমি প্রথম শুনেছি, শামসুদ্দীনকে চিনেছি। এভাবেই শামসুদ্দীন লোকমুখে টিকে আছেন বছরের পর বছর ধরে।

'রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙ্গালি' গানের রচয়িতা এবং সুরকার সম্পর্কে তথ্য বিভ্রান্তি আগে থেকেই ছিল, সে সম্পর্কে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত কবি আবুবকর সিদ্দিক-এর লেখায় বিস্তারিত জানা যায়। পরবর্তিতে ২০০৯ সালে বাংলালিংক-এর একটি বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে আবারো এ প্রসঙ্গ আলোচনায় আসে, কে এই গানের গীতিকার এবং সুরকার? আসলেই কি একুশের প্রথম গানের রচয়িতা এবং সুরকার বাগেরহাটের ফতেপুর গ্রামের দরিদ্র কবি শামসুদ্দীন নাকি অন্য কেউ? ঐ সময়ে কয়েকটি পত্রিকায় লেখালেখি হয়। অনেকে বাংলালিংক-এর বিজ্ঞাপনকে ইতিহাস বিকৃতির দায়ে দোষারোপ করেন। গীতিকার হিসেবে কবি শামসুদ্দীন এবং সুরকার হিসেবে অনেকে আলতাফ মাহমুদের কথা উল্লেখ করেন। অন্যদিকে বাগেরহাটের ভাষাসংগ্রামী মনসুর আহম্মেদ, আবুবকর সিদ্দিক প্রমুখের লেখায় ২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সন্ধ্যায় বাগেরহাটে শামসুদ্দীনের স্ব-কন্ঠে এই গান গেয়েছিলেন এমন উল্লেখ পাওয়া যায়। ক'দিন আগে এই লোককবি'র প্রকাশিত প্রথম গানের বই হাতে এসে পৌঁছানোর পর সে-সব বিভ্রান্তি কেটে গেছে। এখন আমরা নিশ্চিত বলতে পারি, 'রাস্ট্র ভাষা গান'-এর গীতিকার এবং সুরকার কবি শামসুদ্দীন নিজেই। পরবর্তিতে গানের কথায় এবং সুরে কিছু পরিবর্তন করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। বর্তমানে যে গান শোনা যায়, সেটি আলতাফ মাহমুদ কর্তৃক 'রাস্ট্র ভাষা গান'-এর পরিবর্তিত রূপ।

২.
সম্প্রতি বাগেরহাটে একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে খুলনা 'দি ইস্টার্ণ প্রেস' থেকে প্রকাশিত কবি শামসুদ্দীনের একটি গানের বই পাওয়া যায়। বইটির শিরোনাম 'পাকিস্তান পল্লীগীতি'। ১৪ টি গান সম্বলিত এই বই এযাবৎকালে পাওয়া কবি শামসুদ্দীনের একমাত্র বই। কবির মৃত্যুর পর থেকে এতদিন পর্যন্ত এই বইখানা ছাড়া অন্য কোন লিখিত বা মুদ্রিত বই বা পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা যায়নি। তার কারণ হিসেবে জানা যায়, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সমুহ আক্রমণ থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচানোর জন্য কবি শামসুদ্দীন তাঁর বড় ছেলে খোকনকে সাথে নিয়ে সকল বই এবং লেখা পুড়িয়ে ফেলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার পরিজন নিয়ে নিজ গ্রাম ফতেপুরেই বসবাস করছিলেন কবি শামসুদ্দীন। পাকিস্তান সরকারের বেতনভুক্ত বয়াতি হলেও পাকিস্তান সরকারের সমালোচনা তার প্রায় সব গানের ভেতরই পাওয়া যায়। সম্ভবত সে কারণেই পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতাবিরোধীদের আক্রোশ থেকে বাঁচতে, সাবধানতা হিসেবে, সবার আগেই তিনি বড় ছেলে খোকনকে সাথে নিয়ে নিজের গানের খাতা এবং মুদ্রিত বই পুড়িয়ে ফেলেন। এরপর থেকে মানুষের মুখে মুখেই তার কবিতা এবং গান 'সামছুকবির' গান হিসেবেই টিকে আছে। মুদ্রিত বই ছাড়া তার নামের বানান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে সবাই এতদিন তাঁর নামের বানান 'শামসুদ্দিন' বা 'সামছুদ্দিন' লিখে এসেছেন।

১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশিত এই গানের বইয়ের প্রাপ্তিস্থান হিসেবে 'খুলনা মডার্ণ বুক ডিপো' এবং 'বাগেরহাট মডার্ণ বুক ডিপো'র উল্লেখ রয়েছে। এই বইয়ের ভুমিকা লিখেছিলেন বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজের অধ্যাপক মীর মোশাররফ আলী, ভূমিকা শেষে তারিখ উল্লেখিত হয়েছে ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৩। এই বইয়ে কবি জসিমউদ্দিনের প্রসংশাপত্রও ছাপা হয়েছিল। এখানে কবি শামসুদ্দীনের নিবেদন অংশ হুবহু সংযুক্ত করা হল:
নিবেদন
আজ বহুদিন পরে আমার কয়েকটি গানের কুসুম আমার নিরীহ দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত ও চির অনাদৃত ছায়াঢাকা পল্লীবাসির নিকট হাজির করিলাম, ইহারা সংখ্যায় কম হলেও এ রকম কত না ব্যাথার কমল আমার সুখ দুঃখের সাথী হয়ে আমার কবিতা কাননে ঘুমিয়ে আছে। তাই এই দুর্য্যােগে সুযোগ পেয়ে পাকিস্তান ও পরে দেশের সমস্যাকে উপলব্ধি করে, গরীব দেশবাসির নিকট হাজির করিলাম, আমি কোনদিন কোন বই ছাপিয়া জনসাধারণের কাছে হাজির হব কি না তা আমার জানা ছিলনা, আমার কয়েকজন হিতাকাংখির সৎসাহস ও উৎসাহে এ কার্য্যে ব্রতী হইলাম। সু-সাহিত্যিক এ্যাডভোকেট্ আবদুল জলীল ও এ্যাডভোকেট্ আবদুল জব্বার, চেয়ারম্যান সৈয়দ মোস্তাগাওছুল হক ও বিশিষ্ট দেশ কর্ম্মী সেখ আবদুল আজিজ সাহেব ও আতাহার আলী খান সাহেব ও বন্ধুবর ফেরদৌস আমাকে নানাভাবে সাহায্য করিয়াছেন। কবি মোজাহারুল ইসলাম ও কবি হবিবর রহমান সাহেব ত্রুটি বিচ্চুতি দেখিয়া দিয়াছেন, বন্ধুবর প্রফেসর মীর মোশাররফ আলী সাহেব এই বইয়ের ভূমিকা লিখিয়া দিয়াছেন; ইহাদের কাছে আমি চিরঋণি থাকিলাম। আমার এই সরল সুর ও ভাষার লেখা গানে যদি কাহারও প্রাণে একটুও দোলা দ্যায় তবে নিজেকেই ধন্য মনে করিব। এত আনন্দ ও উৎসাহের মধ্যেও আমি আজ অসুখি, আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ রয়ে গেল, যার জন্য গান লিখিলাম ও শিখিলাম হয়ত তাকে আর ফিরিয়া পাব না, এর চাইতে বড় দুঃখ আর কি আছে। ইতি-
নিবেদক-
সেখ সামছুদ্দীন

বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজের অধ্যাপক মীর মোশাররফ আলী এই গানের বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহন করার অপরাধে পরবর্তিতে অধ্যাপক মীর মোশাররফ আলীকে চাকরীচ্যুত করা হয়েছিল। এই বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন:

পল্লী কবি ও গায়ক সামছুদ্দীন সাহেবের এই ক্ষুদ্র গানের বইখানির আত্মপ্রকাশ বিশেষ অর্থপূর্ণ। নর নারীর নিছক প্রেম লইয়া সাহিত্য গীত রচনার দিন অতীত হইয়াছে। প্রকৃত সাহিত্য সমাজ জীবনের আয়না স্বরূপ। বর্ত্তমানে আমাদের সমাজে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রাস্ট্রভাষা সমস্যা চরম আকার ধারণ করিয়াছে। ঘরে ঘরে হাজার হাজার গরীব জনসাধারণ নিদারুণ দুঃখ কষ্টে ও গভীর নিরাশায় দিন কাটাইতেছে। অনেকে দুই মুষ্টি ভাতের অভাবে অকালে শুকাইয়া মরিতেছে। অথচ পাকিস্তান কায়েমের শুভলগ্নে জনসাধারণ সকল অভাব অনটনহীন এক সুখী ও স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়াছিল। কুচক্রীদের চক্রান্তে তাহাদের সুখস্বপ্ন আজ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। জনদরদী সামছুদ্দীনের কবি কন্ঠে সাধারণ মানুষের সেই স্বপ্ন ভঙ্গের বুকফাটা বেদনাই ফুটিয়া উঠিয়াছে। বিভিন্ন জনসভায় কবি যখন গীতগুলি পল্লীসুরে গাহিয়াছেন, তখন জনসাধারণকে নীরবে অশ্রুবর্ষণ করিতে দেখিয়াছি। তাহার পল্লী-গীতি রচনা, তাই একদিকে সার্থক অন্যদিকে পূর্ববাঙ্গলায় সাহিত্য সঙ্গীতের সঠীক পথ-নির্দ্দেশ।

এখন একটি কথা সত্যের খাতিরে না বলিয়া পারিতেছিনা। এই গানগুলির ভাব ও ভাষা সহজ সরল ও শিক্ষাহীন জনসাধারণের ভাব ভাষারই মত। পণ্ডিত সমাজ ইহার মধ্যে সমালোচনার যথেষ্ঠ বিষয় পাইলেও সরল হৃদয়ে পল্লীবাসী, গ্রাম্য কবির এই সলাজ আত্মপ্রকাশকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাইবেন ইহাই আমার বিশ্বাস।

মীর মোশাররফ আলী
অধ্যাপক
বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ
১১/২/৫৩

সে সময়কার তরুণ কবি সামছুদ্দীন সম্পর্কে কবি জসিমউদ্দিন-এর ভাষ্য এই বইয়ে মুদ্রিত হয়েছে। কবি জসিমউদ্দিন লিখেছেন:

সেখ সামছুদ্দিন সাহেবের কয়েকটী কবিতা ও গান পড়িয়া ভালো লাগিল। অজ্ঞাত পল্লীর কোনে বসিয়া কোকিল পাখির মত তিনি গান গাহিয়া চলিয়াছেন, কে ভালো বলিল কে খারাপ বলিল তাতে কি তার আসে যায়। মনের আনন্দ তাঁকে গান গাওয়ায়, এই আনন্দ যেন তাঁর চিরকাল থাকে তাকে সতত এই দোয়া করি।

এই বইয়ের সুত্র ধরে বলা যায়, বই আকারে প্রকাশের পূর্বেই কবি জসিমউদ্দিন শামসুদ্দিনের লেখা কবিতা এবং গান সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশিত কবি সামছুদ্দিনের প্রথম বই 'পাকিস্তান পল্লীগীতি' উৎসর্গ করা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি। উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছিলেন:

আমার এই প্রথম গানের বই ভাষা আন্দোলনের শহীদ ভাইদের রুহের মাগফেরাতে উৎসর্গ করিলাম ও আমার গানের শ্রেষ্ঠ গুরু শ্রীযুক্ত বাবু সুকলাল চক্রবর্ত্তী ও আব্বাসউদ্দিন সাহেবের শ্রীচরণে অর্পণ করিলাম।

'পাকিস্তান পল্লীগীতি' বইয়ে মোট ১৪ টি গান মুদ্রিত হয়। দু'টি গানের সুরকার হিসেবে ডি,এল, রায় এর নাম উল্লেখ করা হয়। গানগুলোর শিরোনাম বইয়ের ক্রম অনুসারে: ভাটিয়ালী (কাহারবা)/ আধুনিক ভাটিয়ালী (কাহারবা)/ ভোটের গান (পল্লীসুর) (কাহারবা)/ জাতীয় সঙ্গীত (গজলমিশ্র ভাটিয়াল) (কাহারবা)/ পাকিস্তানের নিশান ওড়ে (দেশ মিশ্র) (দাদ্রা)/ আমি পাকিস্তানবাসী (পল্লীসুর)/ পাকিস্তানের পরে (দেশ) সুর (একতালা)/ দেশের ছবি (সুর ডি,এল, রায়) (কাহারবা)/ চাষীর গান (পল্লীসুর ভাটিয়ালী মিশ্র) (দাদরা)/ খয়রাতির গান (ভাটিয়ালী সুর) (কাহারবা)/ প্রভাতফেরী (সুর ডি,এল, রায়) (কাহারবা)/ কারবালা কাহিনী (পল্লী সংগ্রহ)/ রাস্ট্র ভাষা গান (পল্লীসুর) (কাহারবা)/ আধুনিক ভাটিয়ালী গান(দাদ্রা)।

এসব গানের ভেতর একদিকে পাওয়া যায় নব্য স্বাধীন পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য এবং আশাবাদ অন্যদিকে জনগনের দুর্দশা আর দারিদ্র থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিবাদ। 'পাকিস্তানের নিশান ওড়ে' গানের ভেতরের কয়েকটি লাইন এমন:

স্বাধীন ভারত স্বাধীন ভারত স্বাধীন পাকিস্তান,
আল্লাহু আকবর বন্দেমাতরম হাঁকো নওজোয়ান।
পায়ের তলে ভারতভূমি দিচ্ছে তোমার চরণ চুমি,
ভারতাকাশাশে উড়ছে দেখ তৃ-বর্ণ নিশান।
পাকিস্তানে উড়ছে দেখ নীলাকাশের চাঁন॥

দেশের ছবি গানের ভেতরে পাওয়া যায় তৎকালীন পাকিস্তানের পল্লীসমাজে বৈষম্যের প্রকৃত চিত্র। আশাভঙ্গ এবং হাহাকার ফুটে ওঠেছে তার গানে:

ঘরে ঘরে আজ অভাব অনটণ ঘরে ঘরে আজি খাই খাই।
সোনার বাংলা স্বাধীন হ'লো কেন গো অন্ন বস্ত্র নাই।
সারা দেশ জুড়ে ভিখারির বেশে ভাইয়ে ভাইয়ে হ'লো ঠাই ঠাই
মানব প্রীতির বাঁধ ছুটে যায় কার মাথা আজ কেবা খাই॥
… … … … … … … … … … … …

খোদার দেওয়া এই পৃথিবীর আমরা সবাই সরীকদার,
একজনে খায় লক্ষ বিঘা আমরা মাত্র বর্গাদার
কাহারও মাত্র বসত বাড়ী ঘর আছে কারও ছাউনি নাই।
কেহবা আবার সর্ব্বহারা গাছ তলাতে নিয়েছে ঠাই॥

'পাকিস্তান পল্লীগীতি'র ভেতর কবির 'দুই কবরের মাঝে' কাব্যের প্রশংসাপত্র ছাপা হয়েছিল। ধারণা করা যায় যে এই বইটি 'পাকিস্তান পল্লীগীতি' প্রকাশের পরবর্তী প্রকাশনা হিসেবে পান্ডুলিপি প্রস্তত ছিল। এছাড়াও কবির আরো একটি বই প্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয় যার নাম 'কবিতা কানন প্রথম পাঠ'। এ দুটি বই পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছিল কি না জানা যায় না।

এই কবির লেখা দুই কবরের মাঝে কাব্যের প্রশংসাপত্র:
বন্ধুবর কবি সেখ সামছুদ্দিন সাহেবের "দুই কবরের মাঝে" বইখানা পড়ে আমি অবর্ণনীয় আনন্দ উপভোগ করলাম। এ বই'র কাহিনীটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজের সংস্কারমূলক এবং পল্লী জীবনের যথাযথ প্রতিচ্ছবি, তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার কবিতা ও ছন্দের ভেতর দিয়ে। মর্ম্মান্তিক ও আনন্দের সংমিশ্রণে এবং কাহিনীর রূপ, রস, গন্ধ ও মাধুর্য্যে কাহিনী কাব্য খানা অতুলনীয় বলে পল্লী প্রেমিকদের অকথ্য আনন্দ প্রদান করবে। বিশেষ করে আমার মনে হয় এ যেন দক্ষিণ বঙ্গের ঘরের কাহিনীতে পরিপূর্ণ।

এ বই'র নায়ক হচ্ছে চাষার ছেলে ফজর, আর নায়িকা হচ্ছেন আশরাফি ঘরের মেয়ে শামছুন্নাহার। এ দু'য়ের প্রেম নিয়েই যেন কবির যত ব্যথা। ইতি
সরদার এ, খালেক (তোতা মিয়া)
বাগেরহাট পি,সি, কলেজ (১ম বর্ষ)
সাউদখালী (খুলনা)
১২ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৩

'পাকিস্তান পল্লীগীতি' বইয়ের ভেতরে সংযুক্ত অবস্থায় কবির অন্য সময়ে প্রকাশিত বইয়ের ৬ টি পৃষ্ঠা (৩ পাতা) পাওয়া যায়। সেখানে ২/৩, ৭/৮, ৫/৬ পৃষ্ঠায় আরো চারটি (ভাটির দেশের গান, গোরাজাব, ভোটের গান, এবং শিরোনাম ছাড়া একটি) গান পাওয়া যায়। এই অংশে পাওয়া যায় আরো একটি বই প্রকাশের আগাম ঘোষণা:

এই কবির লেখা ১৬ টি গান সন্নিবিষ্ট কবিতা পুস্তক
-চাবুক-
শীঘ্রই বাহির হইতেছে।

৩.
তাৎক্ষণিক গান রচনার ক্ষমতা ছিলো এই বিস্মৃতপ্রায় কবির। ফলে, চারণকবি, স্বভাবকবি, লোককবি, পল্লীকবি, ভাষাকবি নানা উপাধিতে তাকে মানুষ মনে রেখেছে। সামছুদ্দীন, সামছুদ্দিন, শামসুদ্দীন বিভিন্ন বানানে তাঁর নাম লেখা হয়েছে। অসংখ্য গান এবং কবিতা রচনা করেছিলেন তিনি। যার প্রায় সবই হারিয়ে গেছে। কিছু কিছু গান মানুষের মুখে মুখে হয়ত এখনও বেঁচে আছে কিন্তু আজ আর নির্দিষ্টভাবে বলার উপায় নেই কতগুলো গান বা কবিতার রচয়িতা শামসুদ্দিন।

কবি শামসুদ্দীনের কোনো ফটোগ্রাফ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার চেহারা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা পাওয়া যায়না। সে সময়কার মানুষদের কাছে শোনা যায়, তার মাথায় ছিল লম্বা চুল, উচ্চতা ৫ ফুট ৬/৭ ইঞ্চির মতো, ভরাট মুখ গায়ের রং শ্যামলা। বিভিন্ন সভা সমাবেশে পাজামা ফতুয়া পরিহিত কবিকে দেখা যেত দোতরা বাজিয়ে গান গাইছেন। এই তারযন্ত্রটির ভগ্নপ্রায় খোল আজো তার পরিবার যত্ন করে রেখেছেন পিতার একমাত্র স্মৃতি হিসেবে। তাঁর সময়কার বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় তিনি হারমোনিয়াম এবং বাঁশি বাজাতে পারতেন। তাৎক্ষণিকভাবে রচিত গান সুর করে গাইতেন বিভিন্ন আসরে। জেনারেল আইয়ুব খান সরকারের (১৯৫৮-১৯৬৯) সময়ে তৎকালীন সি.ও. অফিস বর্তমান তথ্য অফিসে বয়াতি হিসেবে চাকরী পেয়েছিলেন। তার কাজ ছিল গানের দল নিয়ে ইরি ধান চাষ, স্বনির্ভরতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদি সরকারী কর্মসূচি প্রচারের জন্য গান রচনা করা এবং বিভিন্ন স্থানে ঘুরে-ঘুরে গেয়ে বেড়ানো। কবি এই চাকরীতে মাসে ২০০ টাকা বেতন পেতেন। শোনা যায় সি.ও. অফিসের তৎকালীন এস.ডি.পি.আর.ও. মওলানা আব্দুল হাসান খালেকের সহযোগিতায় কবির গানের একটি বই ছাপা হয় কিন্তু এই বই এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

অনেকে বলেন কবি শামসুদ্দীন একসময় গ্রামে মুদি দোকান চালাতেন। কারো কারো ভাষ্য মতে দড়াটানা খেয়াঘাটে একটা মুদি দোকানে বিকেলে আড্ডা দিতেন নিয়মিত। পরবর্তিতে নাগেরবাজার একটা দোকান দিয়েছিলেন। ১৩ ই আশ্বিন ১৯৭৪ খ্রি. বাগেরহাট মহকুমা হাসপাতালে মৃতুবরণ করেন।

রাস্ট্র ভাষা গান (আদি রূপ)
(পল্লীসুর) (কাহারবা)

রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন করিলি ও বাঙ্গালী– রে ভাইরে
ঢাকার শহর রক্তে ভাসালী
যারা হইত পূর্ব বাংলায় জিন্না লিয়াকত
বেছে বেছে মারা হইল জাতির ভবিষ্যত ॥

রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে এইতো তাদের গান–
ন্যায্য দাবী করিয়া ভাইরে খুয়াইলী পরাণ ॥

ইংরাজযুগে হাটুর নীচে চালাইত গুলি
স্বাধীন দেশে ভাইতে ভাইয়ের উড়ায় মাথার খুলি ॥
তোতাপাখি পড়তে এসে খুয়াইলী পরাণ
মায় সে জানে বেটার দরদ যার কলেজার জান্ ॥

মাও কান্দে বাপও কান্দে, কান্দে জোড়ের ভাই
বন্ধু বান্ধব সবাই কান্দে খেলার দোসর নাই ॥
গুলি খাওয়া ভাইয়ের আত্মায় কেন্দে কেন্দে কয়
তোমরা বাঙ্গালী মা ডাকিও জনম দুঃখী মায় ॥

মায়ের কোলে মইরতাম যদি কাইন্ত কোলে নিয়া
জনম ভরে কাইন্ত মা'ধন কবর বুকে দিয়া ॥
করাচীর ঐ রাজপথ দেখ রক্তে লাল লাল
হতভাগা ভাইরে নিয়ে যাও কবির অশ্রুজল ॥

কান্দিবে না এমনি মানুষ এই দুনিয়ায় নাই
কান্দনের যেন হাট বসাইছে আমার মালেক সাই
ও দরদীরা মোদের কবরে করিও জিয়ারৎ
কবর যদি না পাও করিও রুহের মাগফেরাৎ ॥