দেশে দেশে মৃতদের জন্য সুপ্রাচীন উৎসব

শান্তা মারিয়াশান্তা মারিয়া
Published : 7 Sept 2021, 01:59 PM
Updated : 7 Sept 2021, 01:59 PM


মৃত ও জীবিত কোন বিপরীত বিষয় নয়। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো মৃত্যু। চোখ ও চোখের পাতা যেমন আলাদা নয় তেমনি জীবন ও মৃত্যু মিলিয়েই জৈব সত্তার পূর্ণতা। আদিম সমাজে মানুষের মৃত্যুকে অনেক সময়ই বিচ্ছিন্ন করে দেখা হয়নি। বরং মৃতরা যে জীবিতদের মতোই সুখ-দুঃখের চক্রের ভিতর দিয়ে আবর্তিত হয় সেটি মনে করা হতো। অনেক আদিম সমাজেই পূর্বপুরুষ পূজার বিধান ছিল। কখনও কখনও মনে করা হতো মৃত পূর্ব প্রজন্মের মানুষরা কোন কোন রাতে ফিরে আসতে পারে জীবিত আত্মীয়দের কাছে। জীবিতের সম্পদে মৃতেরও অধিকার আছে এমনটিও মনে করা হতো। মিশরীয়দের কথাই ধরা যাক। তারা পিরামিডের ভিতরে মৃতদের সমাধিস্থ করার সময় পার্থিব জগতের বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে দিত। মনে করা হতো মৃত ব্যক্তি যখন অন্য জগতে যাবে তখন তার আত্মার প্রয়োজন পড়বে সেসব কিছুই যা তার জীবিত অবস্থায় দরকার ছিল। মৃত ফারাওয়ের সঙ্গে সহমরণে পাঠানো হতো তার পত্নী ও দাসদাসীদেরও।

শুধু মিশরীয় নয়, ইনকা রাজাদের সমাধিক্ষেত্রেও পাওয়া গেছে বহু সম্পদ যা তার অন্তিম যাত্রার পাথেয় হিসেবে দিয়ে দেয়া হয়েছে সমাধির ভিতরে।
মৃত পূর্বপুরুষ বা পূর্ব প্রজন্মের মানুষ আবার ফিরে আসতে পারে কিংবা বছরের অন্তত একটি দিনে প্রেতাত্মারা ফিরে আসে এমন বিশ্বাস থেকে বেশ কয়েকটি উৎসব বিভিন্ন মানব সমাজে প্রচলিত রয়েছে।
চীনের এমন একটি উৎসবের নাম চুংইউয়ান যা ভূত উৎসব নামে পরিচিত। চীনের সংস্কৃতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখানে মৃত পূর্ব প্রজন্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য বেশ কয়েকটি উৎসব রয়েছে। যেমন ছিংমিং ফেস্টিভ্যাল, ছুং ইউনং ফেস্টিভ্যাল ইত্যাদি। তবে চুং ইউয়ান ফেস্টিভ্যালের বৈশিষ্ট্য হলো লোকজ বিশ্বাস অনুযায়ী মনে করা হয় এই রাতে মৃত পূর্বপ্রজন্মের প্রেতাত্মা আপনজনদের কাছে ফিরে আসে। চীনের লোকজ বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী সপ্তম চান্দ্র মাসের ১৫তম রাতে চুংইউয়ান উৎসব পালন করা হয়। এ বছর এটি পালিত হয়েছে ২২ আগস্ট। মূলত আগস্ট মাসের শেষের দিকেই এটি পালিত হয়।
চুংইউয়ান উৎসবকে বৌদ্ধরা উল্লামবানা উৎসব বলে থাকেন।


চীনের লোকজ সংস্কৃতি অনুযায়ী তারা বিশ্বাস করে এদিন মৃতদের জগতের ফটক খুলে যায় এবং প্রেতাত্মারা মর্ত্যে ফিরে আসে। তাই তারা কিছু আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রেতাত্মাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।
রীতি রেওয়াজের মধ্যে রয়েছে:
পানিতে লণ্ঠন ভাসানো: এই রাতে নদী, পুকুর বা কোন বড় জলাশয়ে লণ্ঠন ভাসানো হয়। পদ্মফুলের আকারে ম্যাশ পেপার বা কাগজ দিয়ে বানানো হয় নৌকা। সেখানে প্রদীপ বা মোমবাতি বসিয়ে পানিতে ভাসানো হয়। এর মাধ্যমে প্রেতাত্মাদের প্রতি সম্মান জানানো হয়।

কাগজের টাকা পোড়ানো: কাগজের তৈরি টাকা যা দেখতে সত্যিকারের নোটের মতো কিন্তু আসলে তা নয়, সেটি পোড়ানো হয় এ রাতে। লোকজ বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত জগতের প্রধান ইয়ামা(যম) এদিন প্রেতাত্মাদের ১৫ দিনের জন্য ছুটি দেয়। ছুটিতে যেন মৃতরা টাকা খরচ করতে পারে এজন্য কাগজের তৈরি নোট পুড়িয়ে উৎসর্গ করা হয় মৃত আপনজনের নামে। চীনে এই উপলক্ষ্যে আসল টাকার মতো দেখতে কাগজের টাকা বিক্রি হয় দেদার।

ছাগল উপহার: এদিন মায়ের দিকের আত্মীয় যেমন মামা ও নানা তাদের ভাগ্নে-ভাগ্নি ও নাতি-নাতনির জন্য ছাগল উপহার পাঠান।

আরও রয়েছে কিছু কিছু বিশেষ বিধিনিষেধ।
বলা হয়ে থাকে অশুভ প্রভাব এড়াতে এই রাতে বিশেষ কিছু রীতি রয়েছে। সেসব বিধিনিষেধ হলো,

১. রাতে ভেজা কাপড় ঝুলানো চলবে না: ভেজা কাপড় প্রেতাত্মাকে আকর্ষণ করে। ভূত এটার মধ্যে আটকে পড়তে পারে।
২. খোলা চুলে ঘুমানো নয়: এ রাতে ভূতেরা ঘোরাঘুরি করে। চুল খোলা রাখলে তারা এলাকেশীকেও তাদের একজন বলে ধরে নিতে পারে।
৩. রাতে জন্মদিন উদযাপন নয়: সেদিন যদি কারও জন্মদিন হয় তাহলে সেটি দিনের বেলায় উদযাপন করতে বলা হয়। রাতে 'হ্যাপি বার্থ ডে' বলে গান গাওয়ার সময় হয়তো কোন অশরীরি কণ্ঠ সুর মেলাচ্ছে এমনটি হতেও পারে।
৪. রাতে ফটো তোলা নিষেধ: রাতে ছবি তুললে প্রেতাত্মার ছবি উঠে যেতে পারে এবং সে ফটোগ্রাফারকে অনুসরণ করে বাড়ি অবধি পৌঁছে যেতে পারে।
৫. 'ভূত' শব্দটি বলা চলবে না: 'ভূত' কথাটি কিন্তু প্রেতাত্মারা অপমানজনক বলে মনে করে। এ রাতে তারা সব জায়গায় ঘোরাঘুরি করে। তাই 'ভূত' বা অন্য কোন আপত্তিকর শব্দ তাদের কানে গেলে তারা প্রতিশোধ নিতে পারে।
৬. 'পেপার গোস্ট মানি'র উপর পা দেয়া খারাপ: চুংইউয়ান ফেস্টিভ্যালে প্রেতাত্মাদের উদ্দেশ্যে যে কাগজের নোট (পেপার গোস্ট মানি) পুড়িয়ে উৎসর্গ করা হয় সেগুলো পা দিয়ে পাড়ানো নিষেধ। এগুলো প্রেতাত্মারা সংগ্রহ করে। পা দিয়ে পাড়ালে ওরা রাগ করে প্রতিশোধ নিতে পারে।
৭. অন্য লোকের কাঁধ চাপড়ানো নয়: লোকজ বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষের দুই কাঁধে ও মাথায় শুভ আগুন রয়েছে। কাঁধ চাপড়ালে আগুন নিভে যেতে পারে। তাতে মানুষটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
৮. ঘাড় ফেরানো খারাপ: চুংইউয়ানের রাতে বন জঙ্গল বা নির্জন জায়গা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কেউ যদি পিছন থেকে ডাকে তাহলে সাড়া দেয়া চলবে না বা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো নিষেধ। এমন হতে পারে যে ডাকছে সে অশুভ শক্তি বা ভূত । ভয়ংকর কিছুও চোখে পড়তে পারে।
এগুলো সবই লোকজ রীতি বা নিছকই রিচুয়াল। তবে সামাজিক ঐতিহ্য বা ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহীদের কাছে নিঃসন্দেহে কৌতুহলজনক।

এই লোকজ উৎসবটি সুপ্রাচীন কাল থেকে চীনের লোকসংস্কৃতির অংশ। এটি তাদের লোকজ ধর্মের মধ্যে ছিল। পরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের সঙ্গে এটি বৌদ্ধ রীতি রেওয়াজের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। মৃতের আত্মার শান্তির জন্য তখন বুদ্ধের কাছে প্রার্থনার রীতি গড়ে ওঠে। পাশাপাশি খাদ্য সামগ্রীও নিবেদন করা হয় মৃতদের জন্য। এটিকে হাংরি গোস্ট ফেসিটভ্যালও বলা হয়। এর পিছনে রয়েছে একটি মিথ।

এক তরুণ তার মৃত মায়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য পরলোকে যায়। গিয়ে দেখে তার মা খুব ক্ষুধার্ত। সে মাকে যতই খাদ্য সামগ্রী দিতে চায় অন্য ভূতেরা সেটি খেয়ে ফেলে। পরে সে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করে। দৈববাণী হয় যে, মন্দিরে খাদ্য সামগ্রী দান করো। এর মাধ্যমে তার মায়ের অতৃপ্ত আত্মা শান্তি পায় অন্য ভূতেরাও শান্ত হয়। এখনও চীনের বৌদ্ধ মন্দিরে অনেক মানুষ খাদ্য সামগ্রী নিয়ে যান। এই উৎসবটিকে চীনের বৌদ্ধরা উল্লামবানা উৎসব বলে থাকে।

এই প্রসঙ্গে গ্রিক মহাকবি হোমারের অডিসি মহাকাব্যের একটি অংশের কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ছে। গ্রিক বীর অডিসিউস পৃথিবীর শেষ প্রান্ত ছুঁয়ে মৃতদের জগতে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতবক্তা টাইরেসিয়াসের আত্মাকে খুঁজে বের করতে। তখন তিনি একটি মেষ বলি দিয়ে রক্ত উৎসর্গ করেন। টাইরেসিয়াসের আত্মা রক্তপান করে তৃপ্ত হয়ে তাকে ইথাকায় ফেরার পথ বাতলে দেন। সেসময় অন্য অতৃপ্ত আত্মারাও ভিড় করে এসেছিল রক্ত পান করার জন্য।


ভূত চতুর্দশীর কথাও আমাদের মনে পড়ছে নিশ্চয়ই।
বাঙালির সনাতন হিন্দু ধর্মের একটি অনুষ্ঠান হলো ভূত চতুর্দশী। এটি পালিত হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন। কালীপূজার আগের দিন। মনে করা হয়, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশীর রাতে মৃত পূর্ব প্রজন্মের মানুষরা ধরাধামে ফিরে আসেন। তাদের সন্তুষ্টি বিধানে এবং অতৃপ্ত আত্মা যেন অভিশাপ না দেন সেজন্য তাদের পূজা করা হয়। এদিন চৌদ্দ পদের শাক খাওয়ার রীতি। অশুভ শক্তির প্রভাব দূর করতে সন্ধ্যায় চৌদ্দটি প্রদীপ জ্বালানোরও রীতি আছে। এই চৌদ্দটি শাক হলো ওল, কেও, বেতো, কালকাসুন্দা, নিম, সরষে, শালিঞ্চা, জয়ন্তী, গুলঞ্চ, পলতা, ঘেঁটু, হিঞ্চে, শুষুনী এবং শেলু। মৃত্যুর পর মানব দেহ পঞ্চভূতে (ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম) বিলীন হয়ে পাঁচ উপাদানের মধ্যেই মিশে থাকেন। তাই প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা ১৪ রকমের শাক মৃত ১৪ পুরুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। ১৪ শাক ধোয়ার পর সেই জল বাড়ির প্রতিটি কোনে ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

এই সময়ে উত্তর ভারতে নরক চতুর্দশী নামে আরেকটি উৎসব পালিত হয়।
মৃতদের উৎসব হিসেবে সুপরিচিত হলো হ্যালুইন ফেস্টিভ্যাল।
হ্যালুইন উৎসব মূলত অটাম উৎসব। প্রাচীন কৃষিজীবী সমাজে ফসল তোলার পর উৎসব হতো। কৃষির আবিষ্কারের পর বজ্র, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ আগুনের মতো নতুন এক শক্তির অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে থাকে আদিম মানবগোষ্ঠি। এই শক্তি ফসলের নবজন্ম। প্রথমে উদ্যান চাষ তারপর বৃহত্তর কৃষিক্ষেত্র। নীরস, নির্জীব মৃত মাটি ফুঁড়ে জন্ম নেওয়া সজীব অংকুর মানুষকে বিস্মিত করে। সবুজ পাতায় কিভাবে জীবনের স্পন্দন ফুটে ওঠে তা দেখে বিস্মিত হয় মানুষ। বীজ থেকে উদ্ভিদের জন্ম মানুষের কল্পনাশক্তিকেও জারিত করে। বজ্র, বৃষ্টি, আগুনের মতো কৃষি বা উদ্ভিদের জন্মকেও মানুষের কাছে বিস্ময়কর বলেই মনে হয়েছে। বজ্র, বৃষ্টির মতো তাই কৃষিকেও দৈবশক্তির প্রকাশ বলে ধরে নিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছে নানা কাহিনী। বজ্রদেব, অগ্নিদেব, পবনদেব, সাগর-মহাসাগরদেবের পাশাপাশি ধরিত্রীদেব বা কৃষিদেবও পূজিত হওয়া শুরু হয়। কৃষির উদ্ভাবন ঘটেছে নারীর হাত ধরে। তাই অধিকাংশ প্রাচীন পুরাণ কাহিনীতে ফসলের দেবশক্তিকে নারীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। ফসল ওঠার পর তাই আদিম সমাজগুলোতে নানা রকম আচার অনুষ্ঠান পালনের রীতি গড়ে ওঠে অথবা দেবীপূজার আয়োজন চলে।

কখনও সর্বজনীন পূজা হিসেবে আবার কখনও গোপন কাল্ট হিসেবে ফসলের দৈবশক্তিকে আরাধনা করা হয়। শীতে উদ্ভিদের মৃত্যু আবার বসন্তে বীজ থেকে তার জেগে ওঠা এবং শরতে ফসল ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে মানবসমাজ জীবনের বৃত্তকেই যেন আবিষ্কার করেছে। আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অবশেষ হিসেবে তখনও প্রধান দৈবশক্তিকে নারীরূপেই ধরা হতো। মাতৃদেবী, উর্বরতার দেবীরাই কৃষিযুগে কৃষির দেবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।প্রাচীন গ্রিক পুরাণে দিমিতির ছিলেন শস্য ও ফসলের, কৃষির ও উর্বরতার দেবী। ফসল তোলার উৎসব, দিমিতিরের কাল্ট এবং দিমিতিরের উপাখ্যান খুবই মনোগ্রাহী।

খ্রিস্টধর্ম প্রসারের আগে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডের আদি অধিবাসী, কর্নিশ ও কেলটিকদের মধ্যে প্যাগান ধর্ম বা প্রকৃতির পূজা প্রচলিত ছিলো। ফসল তোলার পর শরতে বা শেষ হেমন্তে অনুষ্ঠিত হতো কেলটিক ফসল তোলার উৎসব। সামহাইন ফেস্টিভ্যাল হলো গ্রীষ্মের শেষ দিন এবং শীতের আগমন সূচনাকারী উৎসব। তখন নতুন বছর শুরু হতো শীত থেকে। এই নতুন বছরের আগেই শরতের শেষে সকল মৃত আত্মা জীবিতদের জগতে এক রাত্রির জন্য ফিরে আসতে পারে বলে বিশ্বাস করা হতো। চীনাদের মতো তারাও মনে করতো জীবিতদের উৎপন্ন ফসলে মৃতদেরও অধিকার রয়েছে বা মৃতদের আত্মার সদগতির জন্য ফসলের কিয়দংশ উৎসর্গ করা প্রয়োজন।


রোমান অধিকৃত ব্রিটেনের অথবা তারও আগের প্রাচীন কৃষিদেবতা ছিলেন ভিরিডিওস। যিনি কেলটিকদের প্রাচীন কৃষি ও ফসলের দেব হিসেবে পূজিত হতেন। ব্র্যাসিয়াকা ছিলেন আরেকজন কেলটিক দেবী যিনি ফসলের বা হারভেসটিংয়ের দেবী হিসেবে পূজিত হতেন।কেলটিকদের ফসলকাটার উৎসবের এই রীতিনীতি ও অনেক কাল্ট পরবর্তিকালে হ্যালুইন উৎসবের রীতিতে পরিণত হয় যা কিছু রূপান্তরের মাধ্যমে আজও পাশ্চাত্য বিশ্বে প্রচলিত রয়েছে। আইরিশ হ্যালুইন উৎসবে এখনও টারনিপ বা মূলা-গাজরকে কার্ভ করে ভুতুড়ে চেহারা দেয়া হয়। পরে অবশ্য হ্যালুইন আর প্যাগান উৎসব থাকে না। এটি ক্রিশ্চিয়ানিটির সঙ্গে মিলে যায়। তখন এই উৎসবে সেইন্ট, শহীদ এবং সব মৃতদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালানো, প্রার্থনা করার রীতি প্রচলন হয়। আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড থেকে এই প্রথা পুরো ইউরোপেই ছড়িয়ে পড়ে।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে আমেরিকার উপনিবেশে ক্যাথলিক চার্চের মাধ্যমে হ্যালুইন উৎসব নতুনভাবে বড় উৎসব হয়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। ৩১ অক্টোবর রাতে উইচ এবং অরলকদের(পুরুষ ডাইন)সম্মেলন ঘটে এটা মনে করা হয়। সেই সঙ্গে বুগিম্যানদের দৌরাত্ম্য বাড়ে এদিনে। কখনও কখনও কাকতাড়ুয়াকে ভুতুড়ে বুগিম্যান হিসেবে কল্পনা করা হয়। অটামে ফলানো বড় কুমড়োর মধ্যে আলো জ্বালিয়ে জ্যাক ও ল্যান্টার্ন বানানো হয়। আমার নিজের ব্যাখ্যা হলো, অনেক সময় বেশি ফলন হলে কিছু কুমড়া অথবা কোন পচা কুমড়া ক্ষেতেই ফেলে রাখা হতো। সেই পচা কুমড়ার মধ্যে সৃষ্টি হতো মিথেন গ্যাস যা থেকে আলেয়ার আলো জ্বলে। মনে করা হতো বুঝি ভুতুড়ে আলো জ্বলছে। এ সময় নানা রকম কস্টিউমে সজ্জিত শিশুরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নানা রকম চকলেট, ক্যান্ডি পায়। এই রীতির নাম ট্রিক অর ট্রিট।

একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে এই উৎসবগুলো প্রায় সবই শরৎ বা হেমন্তকালে। চীনে শরতের শুরুতে গ্রীষ্মের ফসল তোলা হয়। এটি হারভেস্টের সময়। ভূত চতুর্দশীও কিন্তু আশ্বিনের ধান কাটার কাছাকাছি সময়ের অনুষ্ঠান।

প্রাচীন গ্রিসেও ফসল তোলার সময় ফসলের দেবী দিমিতিরের কিছু কাল্ট ছিল যা মৃত ও জীবিত জগতের রহস্যময় কিছু আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হতো। দিমিতিরের প্রতীক হলো লাল রঙের পপি ফুল। বার্লি ক্ষেতের মাঝখানে যা জন্মায়। প্রাচীন গ্রিসের ইলিউসিসে ছিল তার মন্দির। দিমিতিরের উপাসনা ও উৎসব হতো বছরের দুটি সময়। অক্টোবরে ফসল তোলার সময় হতো একটি রহস্যময় উৎসব। এতে অংশ নিত মূলত নারীরা। আরেকটি উৎসবে নারী পুরুষ সকলেই অংশ নিতে পারতো। দিমিতিরের পূজায় কী কী আচার অনুষ্ঠান পালন ও মন্ত্রপাঠ করা হতো সে সম্পর্কে পূজারীরা মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিতেন।
গ্রিক পুরাণের শস্য ও উর্বরতার দেবী দিমিতির রোমান পুরাণেও মাতৃদেবী হিসেবে পূজিত। রোমে তার নাম সিরিস।

মৃতদের স্মরণ করে মোমবাতি জ্বালানো, ফানুস ওড়ানো, বাড়ির ছাদে লম্বা বাঁশের মাথায় প্রদীপ বা লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাখার রীতিও বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত।

এইসব প্রাচীন রীতিনীতির ভিতর দিয়ে হয়তো জীবিতরা স্মরণ করে মৃতদের। মৃত প্রিয়জনদের তারা বলতে চায়, 'ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া।' অথবা এক রাতের জন্য হলেও মৃত প্রিয়জনেরা ফিরে আসুক সেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই এসব উৎসবের সূচনা।