‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’

লুতফুন নাহার লতা
Published : 21 May 2022, 10:20 AM
Updated : 21 May 2022, 10:20 AM


আজ ১৯ মে, ২০২২। লন্ডন সময় সকাল ৭টার পরে চির শান্তির দেশে চলে গেলেন সাহসী সাংবাদিক, কবি, লেখক, কলামিস্ট, ও ভাষাসৈনিক আব্দুল গাফফার চৌধূরী। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের আকাশ থেকে এক সাহসী নক্ষত্রের পতন হল। শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশের উত্থান পতন দিয়ে ঘেরা ইতিহাসের এক সুদীর্ঘ অধ্যায়।

কাকতালীয় মনে হতে পারে, তবু একথা সত্য যে সারাজীবন তিনি বাংলা ভাষার জন্যে কাজ করে গেছেন, স্ফুলিঙ্গের মত ওনার লেখা গান ভাষাদিবসের প্রধান অংশ হয়ে গেছে আর ১৯ মে আরেক বাংলা ভাষা আন্দোলনের দিনে তাঁর অনন্ত যাত্রা শুরু হল।

১৯৬১ সালে আজ থেকে ঠিক ৬১ বছর আগে আসামের বরাক উপত্যকা জুড়ে বাংলা ভাষার জন্যে আন্দোলন শুরু হলে এই দিনে সেখানকার জনগনকে নির্মম নির্যাতন ও হত্যার শিকার হতে হয় প্রতিবাদ করবার জন্যে। বাংলা ভাষার দাবীতে জীবন উৎসর্গ করেন ১১ জন মহৎপ্রাণ। ১৯৫২'তে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের পরে বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলা ভাষার জন্যে দ্বিতীয় আন্দোলন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাঁর বিদায়ের জন্যে বেছে নিলেন ঐতিহাসিক সেই সব দিনের একটি দিন। বাংলা ভাষা আন্দোলনের দিন। যে ভাষা আন্দোলন তাঁর চেতনাকে শানিত করেছিল।

আব্দুল গাফফার চৌধূরী ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে বরিশালের উলানিয়া গ্রামের চৌধূরী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন, সেই অনুসারে ধরে নেয়া যেতে পারে খুব অল্প বয়সেই তিনি নিজের দেশে ১৯৫২' ভাষা আন্দোলনের লড়াইয়ে শরিক হন। এই বিপ্লবী চেতনার কারণেই উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লিখে ফেলেন এক কালজয়ী কবিতা। সুরকার আব্দুল লতিফের সুরে সেই গান গাওয়া হতে থাকলেও পরে তাতে আরো হৃদয়গ্রাহী সুরারোপ করেন কিংবদন্তি সুরকার আলতাফ মাহমুদ। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রিয়ারীর প্রভাতফেরীতে প্রথম গাওয়া হয় এই গান। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের বীজ মন্ত্র ছিল এই গানে। একটা হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত সেই গান লাখো বাঙালীর প্রাণের কথা হয়ে বয়ে চলে সমস্ত বাংলার সব নদী যেখানে বয়। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি—-।' আর সব কিছু যদি বাদ দেয়াও হয় শুধু এই একটি মাত্র গান তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। পৃথিবীতে সময় আসে যখন একটি মাত্র দেশলাই কাঠি ঘটাতে পারে প্রচন্ড বিস্ফোরণ।
১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে তাঁর সাথে দেখা হল নিউইয়র্কের এস্টোরিয়াতে, প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মাদ উল্লাহর বাসায়। এর অনেক আগেও তাঁকে দেখেছি ঢাকায়। শিল্পকলা একাডেমীতে একুশের এক আলোচনা আয়োজনে। আমার কন্ঠে ঘোষিত হয়েছে তাঁর নাম। কাছে বসেই শুনেছি তাঁর কন্ঠস্বরে বাংলার জনমানুষের উচ্চারণে সহজ করে বলা জ্ঞানদীপ্ত কথা। ঢাকায় তখন বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী এবং সেই সূত্রে বঙ্গভবনের বেশীর ভাগ অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার জন্যে ডাক পড়ত আমার। হয়ত সেকারণেই এভাবে তাঁকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এরপরে কেটে গেছে অনেকদিন।

আমি আমার পরিবার নিয়ে থিতু হয়েছি নিউয়র্কে। নতুন দেশ, নতুন ভাষা, নতুন সংস্কৃতি সব কিছু ছাপিয়ে বাংলায় কথা বলার কিছু মানুষ আর বাংলাকে ভালোবেসে খুবই সাদামাটা ভাবে স্বদেশ উদযাপন, এই নিয়ে আছি আমরা তখন।
সেবার তিনি এসেছিলেন নিউইয়র্কে বাঙালীর একুশ উদযাপনকে কেন্দ্র করে। সাথে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ খন্দকার আমিনুল হক বাদশা। আমিনুল হক বাদশার পারিবার ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে একটি কিংবদন্তি তূল্য পরিবার। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে এই পরিবারের খুবই ঘনিষ্টতা ছিল।

সেবার নিউইয়র্কে যতদিন ছিলেন, বাদশা ভাইসহ বহুবার দেখে হয়েছে ঐ অল্প দিনেই।
এরপরে আরো কয়েকবার তিনি এসেছেন। বারেবারে দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। সন্তানসম স্নেহ পেয়েছি তাঁর কাছে। ২০০০ সালের দিকে পরিকল্পনা করলেন বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে নাটক বা ছবি বানাবেন। সেই মত লিখলেন 'পলাশী থেকে ধানমন্ডি' প্রথমে তিনি ভাবলেন শেখ হাসিনার রোল কাকে দিয়ে করাবেন। আমাকে খবর পাঠালেন। খাওয়া দাওয়া কমিয়ে আমি যেন নিজেকে তরুণ বয়সের শেখ হাসিনায় রূপান্তরিত হই। আমি হেসে তাঁকে জানালাম তা হবার নয়। আমার এই গোলগাল চেহারার সাথে তাঁর চেহারার মিল নেই। বললেন আমি যেন সময় নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা করি। আমি নিউইয়র্কের সাংস্কৃতিক কর্মী শ্যামা হাইয়ের কথা ওনাকে জানালাম। পরে অবশ্য নিউইয়র্কে শ্যামাই করেছিল সেই অনবদ্য রোলটি। নাটকটি বা চলচ্চিত্রটি তিনি দেশেও করেছিলেন সম্ভবত।

২০০৮ এর শেষে দেশে ইলেকশান হল। আওয়ামীলীগের বিজয়ে সারা দেশে আনন্দ বইছে। শেখ হাসিনা সরকার গঠন করতে চলেছেন। নিউইয়র্ক থেকে আমি কল করে জানতে চাইলাম দেশে যাবেন জানি, কবে যাচ্ছেন! তিনি হেসে বললেন অনেকেই যাচ্ছে এখান থেকে। তুমিও তো যাবা আমাকে লন্ডনের ওমুক বলেছে। ওনার সাথে দীর্ঘ আলোচনা শেষে আমিও দেশে যাব বলে মনস্থির করলাম।

দেশে দেখা হল ওনার সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী। জাতীয় জাদুঘরে সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠান। রাতে আমি ছিলাম গ্রীন রোডে আমার আত্মীয়ের বাসায়। সকালে সারা আকাশ পাখিদের ভয়ার্ত ওড়াউড়ি দেখেও ঠিক বোঝা গেল না কিছুই। আমি চলেছি জাতীয় জাদুঘরে। আমার রিকশা যখন বাটার মোড়ে তখন দেখি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান গুলো, আসে পাশের সব দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লোকজন রাস্তায় ছোটাছুটি করছে, যানবাহন পথে নেই বললেই চলে। রিকশাওয়ালা বলল, 'আফা বিডি আরের মইদ্যে কিছু অইতাছে।' খুবই উদ্বিগ্ন হলাম।

গন্ত্যব্যে যখন পৌঁছুলাম, আমার পরপরই এলেন সাংবাদিক আবেদ খান, আমরা ক'জনা একসাথে ভিতরে ঢুকে দেখি অনুষ্ঠান শুরু হবে এখুনি। সবাই এসে পৌঁছুলে শুরু হল বটে কিন্তু সবার চেহারায় একটা অস্থিরতা। কেউ জানেনা কি হচ্ছে। বিডিআর-এর ভিতরে কিছু একটা চলছে। কিন্তু কি হতে পারে সে ধারণা নেই। গোলাগুলির শব্দে সে অনুষ্ঠান খুব তড়িঘড়ি শেষ করতে হল।

গাফফার ভাইকে নিয়ে যাওয়া হল অফিসার্স ক্লাবে। সেখানে সবার খাবারের আয়োজন। অনেকের সাথে সেখানে দেখা হল। রাশেদ খান মেনন, ইনু ভাই, আসাদ চৌধুরীসহ আরো আরো অনেকে। বিশাল খাবার দাবারের আয়োজন। বাদশা ভাইয়ের আরেক ভাই খন্দকার রাশিদুল হক নবাব। আমাদের নবাব ভাইয়ের দায়িত্বে অফিসার্স ক্লাবের সেই দুপুর ছিল একদিকে আব্দুল গাফফার চৌধূরীকে নিয়ে আনন্দ সভা, কিন্তু বিডিআর ঘটনায় সে সভা আতংক সভায় পরিণত হয়েছিল।
সেবার দেশে আরো কয়েকবার দেখা হয়েছিল। শ্রদ্ধেয় মোনায়েম সরকারের শান্তিনগরের বাড়িতেও একদিন আয়োজন ছিল। কত কথা হয়েছিল দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে, নতুন সরকার নিয়ে। তাঁর সারাজীবনের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা, দেশ ও রাজনীতির খুব কাছাকাছি থাকার, জানার ও বোঝার অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করেই তিনি ধারন করেছিলেন অসীম সাহস। দেশের প্রয়োজনে যে কোন দুঃসময়ে লিখতে পারতেন চাবুকের মত শানিত কলাম। দেশবাসী অপেক্ষা করে থাকত তাঁর লেখার জন্যে যার ভেতর দিয়ে সত্যভাষণের সন্ধান মিলত।

একটি সুদীর্ঘ রাজনৈতিক উত্থান পতন ও মেরুকরণ প্রক্রিয়ার সাক্ষী ছিলেন তিনি। জীবনযাপনে ছিলেন অত্যন্ত সহজ, ভালোবাসায় ছিলেন সুন্দর সহজ ও স্নেহময়। সমালোচকদের নিয়ে খুব একটা বিচলিত হননি। হেসে উড়িয়ে দিয়ে আবার লিখেছেন যা সত্য বলে জেনেছেন।

সম্প্রতি সন্তান হারিয়েছিলেন তিনি। সে ব্যথার ভার আর বইতে পারলেন না বোধ করি। ওনার মেয়েটি চলে যাবার পরে, উনি আর বেশিদিন থাকবেন না জানতাম। এও জানি যে 'ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি' অমন মহীরুহ আর সহসা হবে না। একটি দেশের জন্যে, একটি ভাষার জন্যে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।

তাঁর দীর্ঘ সহচর বাদশা ভাইয়ের হাসি মুখ মনে পড়ে। আজ তিনি কি আরো খুশি হলেন অনন্তধামে গাফফার ভাইকে সাথে পেয়ে। হয়ত বা।

বরিশালের সম্পর্কে তিনি ছিলেন আমার ছেলের বড় চাচা কিন্তু সংসারের সেই সম্পর্ক কোনদিন আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের উপরে যায়নি। গাফফার ভাইয়ের কাছে সন্তানতূল্য স্নেহেধন্য ছিলাম চিরদিন।

আজ আবার আরেকবার পিতৃহারা হবার বেদনা আমার।
শ্রদ্ধেয় আব্দুল গাফফার চৌধূরীর অনন্তে চলার পথ আনন্দের হোক। জানিনা কোথায় মানুষ যায়! জানিনা সে কোন অগমপার। জানিনা সেখানে কি কেবল অসীমের বীণা বেজে যায় গ্রহ থেকে গ্রহান্তর ছুঁয়ে ছুঁয়ে! শুধু জানি তিনি আছেন, তিনি আছেন। অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।
'হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে…বেদন বাঁশি উঠল বেজে বাতাসে বাতাসে…'
ছবিটি নিউইয়র্কের প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মাদ উল্লাহ ভাইয়ের বাসায় তোলা।
কে তুলেছিলেন ঠিক মনে নেই।