কেন লেখা হয়েছিল কপিলা

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 20 Dec 2007, 05:35 PM
Updated : 20 Dec 2007, 05:35 PM

তখন দেশে চলছে স্বৈরশাসন। সে হবে গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুর দিকের কথা। ভাগ্যগুণে বা ভাগ্যদোষে আমাকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাদের কিছু প্রতিনিধির এবং তাতে আমার বিশেষ একটি কবিতা রচনার

…….
মোহাম্মদ রফিক, ছবি: শফিউল আলম সুমন……..
সুবাদে তারা বেশ জাঁক করে জিজ্ঞাসা করল এই কবিতাটি আপনি কখন লিখেছেন। আমি বললাম, উত্তর দেয়া যে দুরূহ। ওরা সামান্য চমকে উঠে চেয়ারে নড়ে বসল, কেন? আমি পালটা জানতে চাইলাম, বলুন তো হ্যামলেট শেকসপিয়র কবে লিখছেন? ওদেরকে কিছুটা বিব্রত ও উত্তপ্ত হতে দেখে, আমি আগ বাড়িয়ে আমার কথা পাড়লাম। আমরা সবাই নিশ্চয় অতি সহজেই বলতে পারব, নাটকটি কবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বইটি তো লেখকের অভ্যন্তরে লিখিত হতে শুরু হয় বহুকাল থেকে। তিনি নিজেই কি তবে খোঁজ জানেন? লেখক বা কবি তো নিমিত্ত মাত্র। দেখলাম, ওরা বেশ স্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে। একটু আলগা এবং খোলামেলা হয়ে বসার চেষ্টা করছে সবাই। আমিও বাঁচলাম হাঁফ ছেড়ে।

এই লেখাটি প্রস্তুত করতে বসেও সেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচার চেষ্টা করছি আমি। লেখালেখির গোড়া থেকেই কিছু কিছু বিশ্বাস ও প্রশ্নের দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। এখনও যে ভুগি না, তা নয়। সত্যি সত্যি কি কবি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কবিতা বা কবিতাটি লেখেন। না লিখতে তিনি বাধ্য হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে কে লেখে কবিতা বা বিশেষ কবিতাটি। মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশের টানাপোড়েনে কবির রক্তমাংসে মজ্জায় কতটা অমোঘ হয়ে দেখা দিলে, ব্যক্তিকবি হাতে তুলে নেন কলম, নিবিষ্ট হয় ধ্যানে ও নির্মাণে বা সৃষ্টিতে। বসে যান শূন্য পৃষ্ঠার মুখোমুখি; আত্মোউৎসর্গিত হয়ে পড়েন। উপলে-পাথরে-শব্দে বন্ধুর পথ পরিক্রমায় বা নির্ভেজাল খননে? প্রশ্নটি হয়তো নতুন নয়। তবে চিরপুরাতন বলে তো একটা কথা অবশ্যই চালু আছে। তাই বলে কবি কোনো অসচেতন কর্দমপিণ্ড নয়। কর্দমপিণ্ডও কি সত্যিকার অর্থে অসচেতন? কবি অবশ্যই নয় অতিসচেতন কোনো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রবিশেষ, যেমনটা কবিদের মধ্যেও কেউ কেউ প্রচার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন এক সময়ে। অসচেতন সচেতনা বা সচেতন অসচেতনা সর্বপ্রকার সৃষ্টিশীলতার আদি ও মূল প্রণোদনা কবিতারও।

একটি ঘোরের মধ্যে তৈরি হয়েছিল কপিলা। ১৯৮৩-র ১০ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি এই পনেরো দিন, আমি জানি না কী ভাবে কেটেছে আমার। স্বচ্ছন্দে বলা যায় ভূতে পেয়েছিল আমাকে। লেখা হয়েছিল আরও কয়েকটি অংশ। তবে, পরবর্তী সময়ে বিচার বিবেচনায়, উদ্বৃত্ত মনে হওয়ায় ছেটে ফেলা হয় তাদের। সে বছর ফেব্রুয়ারির বই মেলায় আত্মপ্রকাশ ঘটে কপিলার। নানান ভাষায় সচরাচর প্রকাশিত নানান কবির কবিতাসংকলন বা কবিতা সংগ্রহ বা কবিতার বইয়ের মত নয় আমার কপিলা। তার জাত সামান্য ব্যতিক্রমী। তাকে একটি সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ বলা যায়। অবশ্য তার জাত-পাতের উদাহরণ মিলবে অন্যান্য বহু মহারথীদের রচনা সমগ্রে। একটি বোধ বা বিস্ময় বা উপলব্ধিকে বিস্তৃত ও পরিপূর্ণ করার চেষ্টা চলেছে ৭৮ পৃষ্ঠার পরিমণ্ডলে। প্রয়াসটাই সেখানে উল্লেখের দাবিদার, অবশ্যই সার্থকতা বা উৎকর্ষ নয়।

বাংলা কবিতায় মূলত তিন চরিত্রের ছন্দ-প্রকরণ চালু আছে। কবিতার সংগীত বা লয়, তাল বা চলন নির্মিত হয় এই প্রকরণের ওপর ভর বা ভরসা করে। স্বাভাবিক রূপে, একই গ্রন্থের মধ্যে সংকলিত কবিতা তো বটেই, কখনো কখনো একই কবিতার বিভিন্ন অঙ্গ, গড়ে ওঠে এই তিন ছন্দ-প্রকরণের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। কিন্তু কপিলার শুধু নানান অঙ্গই নয়, প্রত্যঙ্গেরও অংশ তৈরি হয়েছে মূলত এই তিন ছন্দ-প্রকরণের তাল, লয়, মুদ্রা পরস্পরের ভিতর দিয়ে আসা-যাওয়ার পদপাতের বা পদচারণার শব্দ অনুসারে। এর বাইরে মাঝে-মাঝে উকি দিয়ে গেছে সাঁওতালী বা লোকজ মুদ্রার নাচ, গান কিংবা নিরেট গদ্যের ঢোল বা পাখওয়াজের ধ্বনিবৈষম্য ও সুষমা। নারীর যে ত্রি-ভঙ্গ মুরলীমূর্তি সেখানে বাক্যে, স্তবকে, পল্লবিত শরীরে-নিতম্বে বাঁধা আছে, তার সৌরভ কর্মের, কবিতার।

চল্লিশ-পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত বাংলা কবিতায় চর্চিত মূল ভাষা, আমরা, অন্যান্য সমৃদ্ধ বোধ ও বোধির সঙ্গে, উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে যাই। উত্তরাধিকার সূত্রে মিলে-যাওয়া সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মতোই আমরা তাদেরকে কখনো যেমন ইচ্ছে তেমন রূপে ব্যবহার করি, কখনো অতি যত্ন সহকারে তার পরিচর্যাও করে থাকি। সে ভাষা আমাদের কাছে আলনায় ঝুলিয়ে রাখা মরহুম পিতার আলখাল্লার মতো, মূল্যবান, কিন্তু গায়ে মানিয়ে যাওয়ার মতো নয়। আর বাইরের লোকের কাছে কিংবা এমন কি আত্মীয়পরিজনের কাছে প্রায় অচেনা। বাংলা কবিতার ভাষাও পাঠকের কাছে শ্রোতার কাছে, জনসাধারণের কাছে তো বটেই, দ্রুত অপরিচিত হয়ে উঠছে ক্রমেই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা নান্দনিক অর্থেই নয়, নিতান্ত ব্যবহারিক অর্থেও কবিতার সঙ্গে কবিতা পাঠকের বেড়ে চলেছে বিচ্ছিন্নতা। হয়তো এরকমই আমি ভেবেছিলাম, অন্তত সে সময়ে। তাই কপিলায় উঠে এসেছিল নানা মানুষের নানা শব্দ, ভাষা, এমন কি বাক্যগঠনের ধরন। শুধু, সে সময়ের কথাই বা বলছি কেন, এখনও কাব্যিক ভাষা বিষয়ে এরকম একটা ধ্যান-ধারণার আছর থেকে মুক্তি পাইনি আমি। তবে শুধু ক্রিয়া পদের ব্যবহারে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সে কাজটির সমাধান করা যাবে না। তার জন্যে চাই অনেক গভীরতর অনুধ্যান ও সৃষ্টিশীল কর্মবীরের মরণপ্রয়াস। তা না হলে সমস্যা শুধু বেড়েই চলবে, হয়ে উঠবে তীব্রতর, অবশেষে অলঙ্ঘনীয়। উপন্যাসের বা নাটকের বা গানের গঠনকাঠামোর পেলবতা, মদির ভঙিমা বা শুধুমাত্র ভ্রুবিলাস ধার করে চর্চিত হয়েছিল কপিলার দেহবল্লরী, অঙ্গসৌষ্ঠব।

কপিলা শুধু একা একক নারী নয়। তার বিভিন্ন জীবন ও যৌবনের স্তরে স্তরে এসে জুটেছে অন্য নারীরাও। বাঙালী বীরত্ব গাঁথার সখিনা থেকে শুরু করে ফরিদপুর সিএন্ডবি ঘাটের পতিতা হীরামন তারই সখী। এদের সবার একটিই চরিত্র-পরিচয়, তা হচ্ছে তারা শ্রমজীবী। তাদের ভালোবাসা, তাদের আকাক্সক্ষা, তাদের বাসনা ও বেদনা ঘাম ক্লেদ কাদা জল-এর এক মহিম রূপান্তরেরই নাম কপিলা।

মহামতি গ্যেটে ফাউস্ট-এর আন্তিমে লিখেছিলেন, অনন্ত নারী (বা নারীত্বের অনন্ত) আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। মানি আর না-ই মানি নারীই মানবমুক্তির অগ্রদূত। আন্না আখমাতোভা তার দীর্ঘ কবিতাটির শিরোনাম দিয়েছিলেন, 'নায়কবিহীন কবিতা'। কবিতাটির কোনো নায়ক ছিল না ঠিকই, কিন্তু নায়িকা ছিল। নায়িকার পরিচয়ও আমাদের জানা। নাম তার ওলগা সুদাইকিনা, নৃত্যশিল্পী, বহেমিয়ান চিত্রশিল্পীও। মস্কোর উচ্চবংশে তার জন্ম, অনেক পুরুষের মন কেড়েছেন তিনি, এমন কি নারীরও। আন্না আখমাতোভার তো বটেই, এবং এদের ভেতরের কাউকে কাউকে সরাসরি পাঠিয়ে দিয়েছেন নরকে। এই ধ্বংসই প্রতিচ্ছায়া অন্যকিছুর। আর কপিলা, মহাভারতের দুগ্ধদায়িনী গাই আমার 'কপিলা, কাদায় জলে, ঘামেশ্রমে অন্নদা স্বদেশ।' 'মোছো রক্ত, পইঠার ওপরে কালসিটে, এই/ লড়াই চলবেই।' কপিলা, সাক্ষাত মাতৃমূর্তি, প্রেমিকা!

স্তেফান মালার্মে লিখেছিলেন, 'সকল কিছুই প্রতীক্ষা করে থাকে একটি বইয়ে (দু'মলাটের মধ্যে) বেঁচে থাকার লক্ষে।' কথাটা সামান্য ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে যে, কবিতায়ই পুনর্জন্ম লাভ করবে, এই আশায় বসে আছে, আমদের ঘিরে থাকা 'সকল কিছু'।

‍‍‍—

কপিলা ।। মোহাম্মদ রফিক ।। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী ।। ১৯৮৩ ।। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ: কাইয়ুম চৌধুরী ।। ৭২ পৃষ্ঠা ।। ১৮ টাকা ।।

জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা ১৬/১২/২০০৭