হীরক খনির দেশে

ফারসীমমান্নানমোহাম্মদী
Published : 3 Jan 2019, 03:45 PM
Updated : 3 Jan 2019, 03:45 PM

আমরা যখন জোহানেসবার্গ নামলাম, তখন শরীর ক্লান্ত। আট ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিটের দুবাই-জোহানেসবার্গ ফ্লাইট আমাদেরকে অত্যন্ত ক্লান্ত করে ফেলেছে, বড় এমিরেটস এয়ারবাস হওয়া সত্বেও। কেননা তার আগে দুবাইতে প্রায় ৫ ঘন্টা ট্রানজিট এবং তারও আগে ঢাকা-দুবাই পাঁচ ঘন্টার ফ্লাইট ছিল। ব্যাপারটা ক্লান্তিকর এজন্য যে ঢাকা থেকে রাত একটায় আমাদের উড়াল দিতে হয়েছে, ফলে রাত্তিরে কোন ঘুম আমরা দিতে পারিনি। জোহানেসবার্গে তখন বেশ বজ্রসহ বৃষ্টি হয়েছে। প্লেনে বসেই সেটা দেখতে পেয়েছি। ওপর থেকে বুঝতে পেরেছি যে শহরটা বেশ বড় আর ছড়ানো। আফ্রিকার দক্ষিণে এটাই আমাদের জীবনের প্রথম পদচারণা। কাজেই চিত্তে রয়েছে অজানা দ্বিধা। দ্বিধা এবং সংকোচ আরেকটু বাড়ল যখন আমরা সদলে এগুলাম 'ট্রানজিট' দেখানো তির চিহ্ন বরাবর। দক্ষিণ আফ্রিকায় আমাদের রাষ্ট্রদূত শাব্বির আহমদ চৌধুরী আমাদের পইপই করে জানিয়ে দিয়েছেন, ১৬ বছরের কম হলেই সবাইকে জন্মসনদ এবং পিতামাতার এভিডেভিট দেখাতে হবে, যদি বাবামা সঙ্গী না হন। আমার সঙ্গে ৬টি কিশোর যাদের বয়স ১৫'র নিচে। আমি এই দলটির নেতা এবং খালিদ ইসলাম আমার সহ-দলনেতা। জোহানেসবার্গ আমাদের লক্ষ্য নয়, আমরা সেখানে বেরবোও না, আমরা উড়াল বদলাবো মাত্র। আমরা যাচ্ছি বতসোয়ানায়, সেখানে আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডের (আইজেএসও)আসর বসবে ২-১১ ডিসেম্বর। ঢাকা থেকে একাধিক পথে বতসোয়ানা যাওয়া যায়, তবে সেসবের অনেকগুলোতে অজানা দেশ পড়ে, নয়ত বিশেষ টিকা নিতে হয়। তাই আমরা জোহানেসবার্গই পছন্দ করেছি, কেননা বড় এয়ারলাইনগুলোর জন্য এটা একটা পরিচিত ডেস্টিনেশন।
অনেক ঘোরাপথে আমরা ট্রানজিট পাসপোর্ট কন্ট্রোল পৌঁছলাম, মামুলি প্রশ্ন করে আমরা ছাড়াও পেলাম। হাঁফ ছেড়ে আমরা গিয়ে পড়লাম ট্রানজিট লাউঞ্জে। খুবই সমৃদ্ধ এয়ারপোর্ট বলতে হবে। চমৎকার দোকান-পাট। দুটো বড় এবং সমৃদ্ধ বুকস্টোর, লোভনীয় বই সাজানো থরেথরে। কয়েকটা শর্টলিস্ট করে ফেললাম, ফেরার পথে কিনতে হবে। দুবাই টার্মিনাল-থ্রি'তেও এত চমৎকার বইয়ের দোকান দেখিনি, যেটা ছিল খুবই আশ্চর্যের। ঘন্টা দেড়েক বাদেই আমাদের উড়াল বতসোয়ানার রাজধানী গাবোরোনি'র দিকে। তবে দুশ্চিন্তা তখনো ছাড়েনি। আসবার পথে ঢাকাতেই বোর্ডিং ব্রিজে এমিরেটসের এক কর্মকর্তা জানিয়ে দিলেন, জোহানেসবার্গে কিন্তু ব্যাগ কাটে, ফেরার পথে যেন কোন ইলেকট্রনিক্স বা মূল্যবান জিনিস না রাখি। মনটা দমে গিসল। কিন্তু জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টের ঝক্কিকার দেখে কিন্তু খুব ভালই লাগল। এরা যে সত্যিই লাগেজ কাটে, সেটা ফেরবার পথে টের পেয়েছিলাম।
জোহানেসবার্গে আমরা যখন নামি তখন বিকেল। ঝিরঝিরে বৃষ্টস্নাত সন্ধ্যে তখন সমাগত। হাল্কা ঠান্ডা, যদিও দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মকালই বলতে গেলে। আমরা গিয়ে চড়লাম সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজের একটি টারবো প্রপ (বম্বার্ডীয়ার) প্লেনে। এধরনের প্লেন আমাদের অতি পরিচিত, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইউএস বাংলা বা নভোএয়ার এরকমই প্লেন চালনা করে। এয়ারবাস ভ্রমণের পর এই ছোট প্লেন অবশ্য আমাদের মন খারাপই করে। তবে ব্যাপারটা যৌক্তিক, কেননা জোহানেসবার্গ থেকে গাবোরোনি মাত্র ৪৫ মিনিটের ফ্লাইট যা প্রায় ১২০০০ ফুট ওপর দিয়ে ভ্রমণ করে। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য তখন পাটে বসছে, দিগন্ত জোড়া গাঢ় লাল রঙের ছিটে। দক্ষিণ গোলার্ধে সূর্যাস্ত সেটাই আমার প্রথম দেখা। আমরা চলেছি ছোট্ট টার্বো প্রপে চেপে অজানা একটি দেশে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর।


গাবোরনির রাস্তাঘাট

১৯৬৬ সালে যখন বতসোয়ানা ব্রিটিশদের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বাধীনতা পায়, তখন সাকুল্যে তাদের ১২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, মাত্র ২২ জন বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক এবং ১০০ জন মাধ্যমিক পাশ মানুষ ছিল। সেইসময়ে তাদের জিডিপি চিল মাত্র ৭০ ডলার। সেই সময় তাদের নেতা ছিলেন স্যার সেরেৎসে খামা। এই নেতার এমনি দূরদ্রষ্টা ছিলেন যে তিনি বা তাঁর হাত ধরে দেশটি এখন আফ্রিকার অন্যতম ধনী দেশে পরিণত হয়েছে। এখন তাদের জিডিপি (ক্রয়ক্ষমতার সমতায়) ১৮০০০ ডলার। সত্যি বলতে কি, যেকোন উন্নত দেশের রাস্তাঘাট বা শপিং মল যেমন হয়, গাবোরনির রাস্তা বা মলগুলি তার তুলনায় কোন অংশেই কম নয়। ফলে দেশটির নেতৃবৃন্দ দেশটিকে একটি চমৎকার উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন মাত্র অর্ধ শতাব্দী সময়ের মধ্যেই।জনসংখ্যা কুল্লে ২২ লাখ, অথচ দেশটির আয়তন প্রায় ৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ আমাদের বৃহত্তর মিরপুর আর মোহাম্মদপুরের সকল বাসিন্দা নিয়ে একটা দেশ গঠন করলে যেমন হয় আরকি! আফ্রিকার মধ্যে বতসোয়ানা সবচেয়ে হাল্কা বসতিপূর্ণ দেশ, এখানে জনসংখ্যার ১০-শতাংশই রাজধানী গাবোরনির বাসিন্দা। সমুদ্রবন্দরহীন সম্পূর্ণ ল্যান্ডলক্‌ড এই দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার্জনের মূল উৎস হল হীরক খনি, মাংস (দেশটি গোমাংস রপ্তানিতে সারাবিশ্বে দ্বিতীয়) আর পর্যটন। এখানে কয়েকটি বিশ্বমানের সাফারি আছে, আছে ওকোবাংগা বদ্বীপ যা ইকোটুরিজমের জন্য বিখ্যাত।
এমন একটি দেশে কিশোরদের জন্য আয়োজিত বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নিতেই আমাদের আগমন। আমরা গত চার বছর ধরে এই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান আয়োজনে অংশ নিচ্ছি। এখানে ১৫ বছর চলছে বা তার কম বয়েসী বাচ্চারা অংশ নিতে পারে। প্রায় পঞ্চাশটি দেশের বাচ্চারা এই অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়। এবার ২০১৮ সালে বতসোয়ানা আয়োজনটির স্বাগত দেশ এবং এতে অংশ নিয়েছে ৪৪টি দেশ, আর ৪টি দেশ ছিল 'অবজার্ভার' অর্থাৎ চাইলে তারা ২০১৯ থেকে পূর্ণ দল পাঠাতে পারবে। একটি পূর্ণ দলে থাকে ৬জন প্রতিযোগী, আর ৩জন শিক্ষক। ২০১৮ সালের এই পঞ্চদশ আইজেএসও আয়োজনে বাংলাদেশ থেকে আমরা গিয়েছি ৮ জন। সাকুল্যে ২৯/৩১ ঘন্টা উড়াল-ট্রানজিট সময়, সাথে যোগ করুন বাসা/হোটেল থেকে রওনা দিয়ে চেক-ইন/ইমিগ্রেশনের সময়। ফলে চারটি এয়ারপোর্ট, তিনটি প্লেন, তিনটি ইমিগ্রেশন, দুটি ট্রানজিট, চারটি চেকিঙের ধকল বড় ভয়াবহ।


আমাদের বিজয়ী দল

বতসোয়ানার প্রকৃতি বন্ধুত্বপূর্ণ। তেমন কোন রহস্য নেই। ভূমিরূপ রূক্ষ্ম, লাল মাটির। গুল্মজাতীয় গাছ বেশী। বড় বৃক্ষ নেই বললেই চলে। কিছু পাহাড় আর চড়াই উৎরাই চোখে পড়বে। গাবোরনির কিছু দূরেই ভয়ংকর কালাহারি মরুভূমির শুরু। কাজেই ভূমিরূপও তেমন ইঙ্গিত দেয়। ফলে আফ্রিকার বিস্তৃত সাভান্না বা তৃণভূমি বলতে যা বোঝায়, বতসোয়ানার প্রকৃতি ঠিক তাই। কাজেই এইরকম প্রকৃতিতে জেব্রা, জিরাফ, বাইসন, ইমপালা এবং তজ্জাতীয় অন্যান্য আফ্রিকান সিগনেচার জন্তু জানোয়ারই দেখা যায়। শামসুর রাহমানের কবিতায় "ঝাঝাঁলো রোদ্দুর" কথাটা বারবার এসেছে। বতসোয়ানার রোদ্দুর, এই ডিসেম্বরে, সেইরকম ঝাঁঝালো। অত্যন্ত কড়া। অতিবেগুনিও থাকে। তাই শ্বেতাঙ্গদের দরকার সানসক্রিন। কিন্তু এখানের আবহাওয়ায় আদ্রতা এত কম যে ঘাম খুব কম হয়। আর সুপ্রচুর বাতাস। চমৎকার হাওয়া. কাজেই প্রচণ্ড গরমেও ছায়ায় দাঁড়ালেও অস্বস্তি লাগে না। কাজেই সুপ্রচুর বাতাস, সুনীল স্বচ্ছ আকাশ, বিস্তীর্ণ সাভান্না – আফ্রিকার যেসব 'টেক্সটবুক' বৈশিষ্ট্য আমরা জেনে এসেছি, সেসবই এখানে বর্তমান। আর এখানকার মানুষ, তাঁদের ট্রাডিশনাল যাপিত জীবনের ঢঙ এবং ছন্দ, এবং উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীকুল একই ধারায় বহমান। বায়োস্ফিয়ারের যে এক নিজস্ব ছন্দ আছে, মানুষ প্রকৃতি ফ্লোরা-অ্যান্ড-ফোনা যেন সেই একই ছন্দে দুলছে। কোন ছন্দপতন নেই, বরঞ্চ দর্শক আমি যেন সেই ছন্দের বাইরে। 'ক্রেডল অব লাইফ' বলে আফ্রিকার জন্য প্রযোজ্য যে কথাটা আছে, সেটা বতসোয়ানার প্রকৃতি দেখলে আপনাই অন্তরে প্রতিভাত হয়। আর তাই এদেশের মানুষও সেই একইরকম – ভণিতাশূন্য, সরাসরি, আর মৌলিক। তাঁরা সোজাসাপ্টা, আনন্দপ্রিয়, খোলামেলা, কিছুটা গোয়ার, হাসিখুশি, সম্ভবত শ্রমবিমুখও। তবে এদেশের নেতৃবৃন্দ পড়াশোনার গুরুত্বটা খুব ভালভাবে বুঝেছিলেন। তাই শিক্ষার হার ৮০% এর বেশী। শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি, তাঁরা জিসিএসই, ও/এ-লেভেল ইত্যাদি অনুসরণ করে। এ বিষয়ে তাঁদের কোন দ্বিধা নেই। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার ফলে এখানে ইংরেজির ভাল চল রয়েছে। ছুতোর মিস্ত্রি কিংবা প্লাম্বার ভাল পরিষ্কার, চলনসই, জড়তাহীন ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদেশের সরকার দেশটাকে এত সুন্দর সাজিয়েছেন, মনেই হবে না আপনি আফ্রিকান কোন দেশে আছেন। আফ্রিকানদের মত এত নৃত্যুপটু জাতি কমই দেখেছি। এঁদের দেহভঙ্গি দারুনভাবে নৃত্যসংগত। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বয়সভেদে নাচতে পছন্দ করেন, কোন জড়তাই নেই। নাচের সময়ে এঁদের দেহে যে অনুপম বিভঙ্গ খেলা করে, যেন নাচ এঁদের অত্যন্ত সহজাত এক জীবনছন্দ। সকালে রসায়ন আর জীববিদ্যার যে দুজন অধ্যাপকের সাথে নম্বর নিয়ে আমাদের রীতিমত হাতাহাতি পর্যায়ের ঝগড়া হল, রাতে তাঁরাই আমাদের সাথে যেমন জড়তাহীনভাবে নাচলেন, তাতে আর রাগ পুষে রাখাই গেল না। এমনই নাচ তাঁদের। প্রসংগত বলে রাখি, এই অলিম্পিয়াডে প্রথম দিন উদ্বোধনের পরদিন প্রতিযোগীদের একটি বহুনির্বাচনী পরীক্ষা দিতে হয়। এর পরের দিন ওরা ঘোরে, আর শিক্ষকরা পরেরদিনের তাত্ত্বিক পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে মডারেশনে বসে। এখানে রীতি হল স্বাগত দেশের সায়েন্টিফিক কমিটি প্রশ্ন তৈরি করে রাখবে আর তা নিয়ে সকল দেশের শিক্ষকবৃন্দ চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রচুর তর্কবিতর্কের শেষে প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করে। এটা খুবই দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক প্রক্রিয়া। উপস্থিত সকলে ঐকমত্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত হয়না। ফলে যতক্ষণ না প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত হচ্ছে ততক্ষণ বসে থাকতেই হয়। তারপর সেই প্রশ্ন ছয় প্রতিযোগীর জন্য দলনেতাদের নিজেদেরকে ছাপিয়ে প্যাকেটবন্দি করে স্বাক্ষর করে সায়েন্টিফিক কমিটির কাছে জমা দিতে হয়। এভাবে দ্বিতীয় পরীক্ষার পর ফাঁকা পায় প্রতিযোগীরা। তৃতীয় অর্থাৎ শেষ পরীক্ষাটি হল প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা যেটা তিনজন করে দুটো দলে দিতে হয়। প্রথম দুটো পরীক্ষা ৩০-শতাংশ করে, আর শেষেরটি ৪০-শতাংশ। ফলে যে দল প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা ভাল করে তাদের রেজাল্ট ভাল হয়। স্বভাবতই আমাদের প্র্যাকটিকাল বিষয়টি আর বায়োলজিতে দারুণ দুর্বলতা আছে। পরীক্ষা শেষে স্বাগত দেশের সায়েন্টিফিক কমিটি প্রতিটি প্রতিযোগীর খাতা পরীক্ষা করে নম্বর দেবেন। সেই নম্বর দেখে প্রতিটি দেশের দলনেতারা কৌশল ঠিক করবেন কার কত নম্বর বাড়ানো যায়, আর এই নিয়ে পরীক্ষা কমিটির সাথে চলে তুমুল দরকষাকষি। যদি আপনি এই তর্কাতর্কিতে জিতে পরীক্ষা কমিটিকে বোঝাতে সক্ষম হন, তবে আপনার দলের নম্বর বাড়ল, নচেত নয়। এই হাড্ডাহাড্ডি তর্কাতর্কির কথাই আমি বলছিলাম।


বতসোয়ানার পরিচিত পশু – জেব্রা, আফ্রিকার বিস্তীর্ণ সাভান্না

বতসোয়ানায় যে বাংলাদেশীরা থাকছেন সেটার কিছুটা আঁচ পেয়েছিলাম। কিন্তু গাবোরনি গিয়ে ঘটনাক্রমে পেয়ে গেলাম বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব বতসোয়ানার (ব্যাব) প্রেসিডেন্ট তরিকুল ইসলাম বাবুলকে। বাংলাদেশ থেকে টিম এসেছে খবর জেনে তিনি নিজেই চলে আসলেন শুক্রবার। আমাদের সহ আরও কয়েকটি দেশের শিক্ষকদের নিয়ে গেলেন নিকটস্থ মসজিদে। চমৎকার ছিমছাম সুন্দর স্থাপত্যের একটি মসজিদ। এরকম আরও কয়েকটি মসজিদ আছে এবং সেসগুলো গাবোরনি মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের মালিকানাভুক্ত। এমন একট বেশ বড় মন্দিরও দেখলাম। বাবুল ভাই সূত্রে বেশ কয়েকটি বাঙালি পরিবারের সাথে দেখা হল। জানা গেল, প্রায় ৫০০ বাংলাদেশী বতসোয়ানায় আছেন। এঁরা মূলত ব্যবসায়ী, তাছাড়া স্বাস্থ্যখাতে সরকারীভাবে নিযুক্ত ডাক্তার বা ইউনিভার্সিটি বতসোয়ানায় শিক্ষকতা করতে এসেছিলেন এমন অনেকেই আছেন। ব্যবসা বলতে সুপারমার্কেট, হোটেল, মাংসের ব্যবসা ইত্যাদিতেই তাঁরা খুব ভাল করেছেন। বাবুল ভাই আমাদেরকে গাবোরনি সম্পর্কে ভাল একটা ধারণা দিলেন, ঘোরালেনও খানিকটা, তারপর নিজের বাসায় নিয়ে গিয়ে ঘরোয়া বাঙালিখাওয়া খাওয়ালেন। তাছাড়া পরে আমাদের প্রতিযোগীদের নানাভাবে যত্ন নিয়েছেন, একটা ছোট সম্বর্ধনার ব্যবস্থাও করেছিলেন। বিদেশে দেশী ভাই-ব্রাদার পেলে যে আনন্দ হয় সেটা উভয়পক্ষের জন্যই অনির্বচনীয়।


গাবোরনির বইয়ের দোকান

গাবোরনি থেকে আমাদের যেকয়টি ঘোরাঘুরির জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে দুটি সাফারি পার্ক, একটি শকুন পার্ক অন্যতম। এর মধ্যে মোকোলোদি নেচার রিজার্ভ অন্যতম। প্রায় ৪৫ মিনিটের ট্যুর, নানান জন্তু জানোয়ার দেখা গেল। ইমপালা, জিরাফ, জেব্রা, হায়েনা, বাফালো, উটপাখি ইত্যাদি দেখা গেল। একটা বিষয় খুব পরিষ্কার – প্রকৃতির সাথে এই জন্তুগুলোর অভিযোজন চমৎকার। আশপাশের বালির রঙ, গুল্মের প্রকৃতি, কাঁটাঝোঁপ, রূখাসুখা প্রকৃতির সাথে এদের বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াগুলি চমৎকার খাপ খায়। আফ্রিকার বিস্তীর্ণ প্রকৃতি চোখে না দেখলে বায়োস্ফিয়ারের এই অসাধারণ সহাবস্থান বোধগম্য হয়না। পৃথিবী নামক গ্রহটির প্রতি যত্ন নেবার ব্যাপারটা তখনই প্রতিভাত হয়। এদেশে হীরক খনিগুলিতে প্রবেশ অত্যন্ত সংরক্ষিত। ফলে আমাদের পক্ষে হীরক খননের ব্যাপারটা বা এর ভূতাত্ত্বিক বা ব্যবসায়িক ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব হয়নি। তবে এদেশের সরকার হীরক খনিগুলির ব্যাপক নিরাপত্তা গ্রহণ করছেন। একই সাথে পোচিং বা বন্যপ্রাণী শিকারের ব্যাপারেও সরকার অত্যন্ত কঠোর। বতসোয়ানার প্রধানতম সাফারিগুলো গাবোরনি শহর থেকে হাজার মাইল দূরে থাকায় সিংহ বা হাতি কিংবা লেপার্ড দেখা গেল না বলে আমাদের একটা হাহুতাশ রয়েই গেল। দক্ষিণ গোলার্ধের রাতের আকাশ দেখবার আমার খুব ইচ্ছে ছিল। আমাদের রাতের নক্ষত্রগুলি সব উত্তর গোলার্ধের। এদের আমরা আজন্ম চিনি। কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধে এমন সব নক্ষত্র দেখা যায় যাদের উত্তর থেকে দেখা যাবার কথা নয়। কয়েকদিন আমি রাতের আকাশ দেখলাম, গাবোরনিতে রাতের আকাশ ঢাকার মত দূষিত নয়, পরিষ্কার, দূষণমুক্ত। সেখানে আমি চিরপরিচিত কালপুরুষ আর লুব্ধককেই দেখতে পেলাম। বড় এবং ছোট ম্যাজেলানীয় মেঘপুঞ্জ, যাকে শুধু দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে দেখতে পারা যায় এবং যারা আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের দুটো স্যাটেলাইট গ্যালাক্সি, দেখতে পেলাম না। তবে এমনিতে আফ্রিকার দিনের আকাশ অত্যন্ত সুনীল, পরিষ্কার, ঝাঁঝালো।
গাবোরনিতে যে ক'টি শপিং মলে আমরা যেতে পেরেছি (এয়ারপোর্ট জাংশন, রিভারওয়াক মল, গেইম সিটি, মাইন মল) সবকটি অত্যন্ত আধুনিক। যেকোনো পশ্চিমা দেশের সাথে প্রায় কোন পার্থক্যই নাই। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চেইন ও ফ্রাঞ্চাইজির সরব উপস্থিতি চোখে পড়ল। খাবার দোকানের মধ্যে কেএফসি, নান্দোস, ম্যাকডোনাল্ডস, ইত্যাদি চোখে পড়েছে। মলগুলি ঝকঝকে, অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, দেশের রাস্তাঘাটগুলিও দারুণ পরিচ্ছন্ন। দেখেশুনে মনে হয়, এদেশের মানুষের রুচি প্রশংসারযোগ্য। একটি মলে আমি একটি দারুণ সমৃদ্ধ বুকস্টোর পেলাম। দারুণ সব টাইটেল সেখানে, ফলে কিছু বই কিনতেই হল।


বতসোয়ানার তিন নায়ক

এ যাত্রায় অলিম্পিয়াডে আমরা বেশ ভাল করতে পেরেছি। আমাদের দুজন রৌপ্য পদক, এবং চারজন ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে। আমরা চারটি পর্যায়ে বাছাই করে প্রতিযোগীদের নির্বাচন করেছি, প্রায় আড়াই মাস প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছি। কোন কোন দেশ (যেমন তাইওয়ান) সারা বছর ধরেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে পেরেছে। এটা অবশ্য তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই করা যায়। ভারত একইরকম সুকঠোর বাছাইপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিযোগী নির্বাচন করে থাকে। তবে আমাদের মূল খামতি বায়োলজি আর প্র্যাকটিকাল পরীক্ষণের দক্ষতায়। আমরা হয়ত আরও ভাল প্রশিক্ষক দেবার প্রচেষ্টা করতে পারি (আমাদের শু-স্ট্রিং বাজেটে সেটা করতে পারাও দুরূহ), কিন্তু যেটা স্কুল থেকে আসার কথা, যেটা দীর্ঘদিনের একটা একাডেমিক দক্ষতা, সেই প্র্যাকটিকাল পরীক্ষণের দক্ষতা আনতে আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে। আপাতত আমাদের একাডেমিক স্ট্রেংথ নির্ভর করছে আমাদের একদল নিবেদিতপ্রাণ ঝকঝকে তরুণ-তরুণী যাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন, পাশাপাশি বিশুদ্ধ স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে আমাদের এই অলিম্পিয়াডগুলোকে চাঙ্গা রেখেছেন।