উপন্যাসের শিল্পনির্মিতিতে বাস্তবতা ও তার প্রকাশের ধরনটাই বিবেচ্য বিষয়।
Published : 29 Dec 2024, 06:32 PM
বাংলা উপন্যাসেই শুধু নয়, উপন্যাসশিল্পের সূচনালগ্ন থেকেই জীবনের পরিপ্রেক্ষিতেই সমৃদ্ধ হয়েছে উপন্যাস। উপন্যাসের বিস্তীর্ণ ক্যানভাস জীবন ও তার বাস্তবতাকে অবলম্বন করে আবর্তিত হচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ, মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান, শহীদুল্লা কায়সার, আবু ইসহাক—এঁদের সকলের উপন্যাসেই জীবনের বাস্তবতা প্রধান উপজীব্য বিষয়। তাঁদের আঙ্গিক, চরিত্র ও ভাষা পরস্পর থেকে পৃথক হলেও জীবনের বাস্তবতায় তাঁরা একে অন্যের নিকট প্রতিবেশী। তবে এটিও উল্লেখ্য, সকলের জীবনের বাস্তবতা এক ধরনের নয়। শওকত ওসমান এবং শহীদুল্লা কায়সারের বাস্তবতার রূপ ভিন্ন। তাছাড়া জীবনদর্শনের ক্ষেত্রেও ঔপন্যাসিকদের মধ্যে থাকে পারস্পরিক পার্থক্য। শামসুদ্দীন আবুল কালাম এবং শহীদুল্লা কায়সার দুজনেই একটি বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও তাঁদের উপন্যাসে চিত্রিত জীবন-বাস্তবতা ও চরিত্রাদর্শ একরকম নয়। তাই উপন্যাসের শিল্পনির্মিতিতে বাস্তবতা ও তার প্রকাশের ধরনটাই বিবেচ্য বিষয়। উপন্যাসের জগতে বাস্তবতার চাইতে বড়ো অবলম্বন আর কিছু নেই। সমালোচকের ভাষায়:
সাতচল্লিশোত্তর বাংলাদেশ শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক বাস্তবতার বাংলাদেশ এবং তার শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের মাত্রা নিয়েই এগিয়েছে। সুতরাং সাহিত্যেও এ শতাব্দীর বাস্তবতাই আমাদের রূপ-রূপান্তরের পট-উন্মোচন করবে। এমনটা নিশ্চিত সত্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপ-রূপান্তর ঘটে সময়ের সূত্রে এবং বাস্তবতার অনুষঙ্গ থেকে। বাস্তবতাই আসলে তার পরিবর্তনের ক্ষেত্রকে তৈরি করে, রূপান্তর ঘটার সুযোগ করে দেয়। (১)
মাহমুদুল হকের উপন্যাস জীবনের প্রকৃত বাস্তবতার আশ্রয়ে ঔপন্যাসিকের স্বতন্ত্র প্রকাশভঙ্গিতে অনন্য হয়ে উঠেছে।
জীবন ও বাস্তবতার প্রসঙ্গে মাহমুদুল হকের তিনটি উপন্যাস বিবেচ্য: নিরাপদ তন্দ্রা (১৯৭৪), মাটির জাহাজ (১৯৯৬) ও পাতালপুরী (২০০৯)। প্রসঙ্গত স্মরণযোগ্য নিরাপদ তন্দ্রা-র প্রকাশকাল স্বাধীন বাংলাদেশে হলেও এটির রচনাকাল ১৯৬৮ সাল অর্থাৎ নয়া ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি আমলে। একইভাবে মাটির জাহাজ উপন্যাসের রচনাকাল ১৯৭৭ সাল, রচনাকালের প্রায় দুই দশককাল পরে এটির গ্রন্থাকারে প্রকাশ। পাতালপুরী-র রচনাকাল ১৯৮১ সাল, এটিরও রচনা এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশের (২০০৯) মধ্যে কালগত ব্যবধান আটাশ বছর। পাতালপুরী মাহমুদুল হকের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। এ-ধারার উপন্যাসত্রয়ের রচনাকালের ব্যাপ্তি ১৯৬৮ থেকে ১৯৮১ সাল—এক যুগ। এই যুগসীমায় রয়েছে একই দেশের পরাধীন এবং স্বাধীন জীবন ও সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপট। এক যুগের সামাজিক পরিবর্তনের নানা ছাপ উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া সমাজজীবনের মৌলিক সংকটসম্পর্কিত বিষয়বস্তু স্বাধীনতাপূর্ব এবং স্বাধীনতাপরবর্তী উভয়কালের উপন্যাসে ঠাঁই করে নেয়। তাতে এই দুই পর্বের মাঝখানে স্বাধীনতার বিভাজনরেখাটিকে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করার একটি অবকাশ সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের নানা দিক রূপায়ণে সফল মাহমুদুল হক বাস্তবতার পটভূমি বিশ্লেষণেও সমান দক্ষতার নজির রাখেন। প্রথম ধারার উপন্যাসে ব্যক্তির মনোজাগতিক প্রেক্ষণবিন্দু অধিকতর গুরুত্ব লাভ করে এবং বর্তমান ধারায় ব্যক্তি যে আয়তনে অবস্থিত সেটির বাস্তবতার উপর ঘটে আলোকপাত। এখানেও ঔপন্যাসিক প্রচলিত কাহিনিবর্ণনের পরিবর্তে কাহিনিবিচ্যুত বিন্যাসকেই বেছে নিয়েছেন। যেজন্য ব্যক্তির চেতনাস্পৃষ্ট অবলোকনে প্রভাবিত হয় কাহিনিবলয়। আখ্যানকে প্রকাশ করবার জন্য ব্যক্তি নয়, ব্যক্তি এবং সমাজের জটিল স্বরূপই আখ্যানের গতিপথ নির্ধারণ করে।
১৯৬৮ সাল তথা নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাস রচনার সময়কাল বাংলাদেশের পাকিস্তান-পর্বের ইতিহাসে ক্রমঘনীভূত এক কুজ্ঝটিকাপুর্ণ কাল-অধ্যায়। পূর্ব পাকিস্তান নামে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অংশীদার হলেও আদতে তা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের সর্বক্ষেত্রে লাভবান হওয়ার হাতিয়ার। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা ও সামরিক কর্মকর্তাদের লোভ ও লাভের বলি হয়ে চলল বাঙালিরা। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে দাঁড়াল পশ্চিম পাকিস্তানিদের পুঁজি স্ফীত থেকে স্ফীততর হওয়ার প্রকাশ্য বাজার। সমাজবিজ্ঞানী লিখেছেন:
... পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদিত দ্রব্যের একচেটিয়া বাজারে পরিণত করা হয়। পূর্ববঙ্গের গরিব জনসাধারণ বাধ্য হয় বিশ্বের খোলা বাজারে যে-জিনিসের দাম এক টাকা তাই দুটাকা অথবা তিন টাকায়, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ টাকায়, কিনতে। এভাবে পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করা হয়। (২)
সমাজবিজ্ঞানী-কথিত উপনিবেশ পূর্ববঙ্গের অবস্থা হয়ে পড়ল শোচনীয়, কেননা বাজার তথা সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে থাকায় পূর্ববঙ্গে পুঁজির বিকাশ ঘটল না বা তা হলো বাধাগ্রস্ত। ফলে সাধারণ মানুষ পড়ে রইল দারিদ্র্যসীমার নীচে। মাহমুদুল হকের নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাস পূর্ববঙ্গের বিপর্যস্ত জীবনের চিত্র। একদিকে রাষ্ট্রিক-সামাজিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং আরেকদিকে অর্থনৈতিক শোষণ—এ-সমস্তকিছুর চাপ গিয়ে পড়ল কৃষক-শ্রমিক-নিম্নবিত্ত মানুষদের উপর। সেই চাপের ফলে ব্যক্তি-সমাজ যে-পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় তার একটা বাস্তব ছবি মাহমুদুল হকের উপন্যাস এবং নিরাপদ তন্দ্রা-র পর থেকে পরবর্তী অন্য দুটি উপন্যাসেও সেই ছবির প্রতিফলন থাকে অব্যাহত। যদিও নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসের পরে অন্য দুটি উপন্যাসের আগে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ভয়ংকর রাষ্ট্রিক-সামাজিক দুর্যোগ নেমে এলে বাংলাদেশে পুনরায় ১৯৬৮ তথা নিরাপদ তন্দ্রা-র সমকালীন দুঃস্বপ্নতাড়িত অধ্যায়ের সূচনা হয়। এসবের পরিণামে এই উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটা পারস্পরিক ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত মানুষ নৈতিকভাবেও হয়ে পড়ে বিকৃত। সেই বিকৃতির প্রকাশ ঘটে নানাভাবে। তাছাড়া সমাজে-রাষ্ট্রে চলতে থাকে নানাবিধ অবক্ষয়। নিরাপদ তন্দ্রা, মাটির জাহাজ এবং পাতালপুরী—এই তিনটি উপন্যাস সামগ্রিকভাবে ধারণ করেছে এক যুগের সামাজিক বাস্তবতার এক বিদীর্ণ দর্পণকে।
প্রথম দৃষ্টিতেই নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসের চরিত্রগুলোর বিশেষত্ব স্পষ্ট। উপন্যাসটির জীবন ও বাস্তবতাকে অনুধাবন করার পক্ষে এই চরিত্রগুলোর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। সমাজের বিচিত্র সব পেশার মানুষ মাহমুদুল হকের এই উপন্যাসটিতে স্থান করে নেয় যা ইতোপূর্বে তাঁর অন্য কোনো উপন্যাসে লক্ষ করা যায়নি। ১৯৬৮ সাল পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসে একটা প্রচণ্ড আলোড়ন জাগানোর কাল। ১৯৬৬ সালের ছয় দফার তুঙ্গতম পাকিস্তান-বিরোধিতার রেশ তখনও কাটেনি এবং আর এক বছর পরে অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে ঘটবে গণ-অভ্যুত্থান যা সমগ্র পূর্ববঙ্গকে পৌঁছে দেয় এক নতুন দিগন্তের অভিমুখে। এই সময়টাতে মাহমুদুল হকের উপন্যাসে জীবন ও বাস্তবতার অভিব্যক্তি সমকালীন রাষ্ট্রিক-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ ও পুঁজি-সৃষ্টির বাজারে পরিণত হওয়ার ফলে এই অঞ্চল স্বাভাবিকভাবেই একটা অধঃস্তন অবস্থার মুখোমুখি হয়। কাজেই এখানে সামাজিকভাবে নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন মানুষের সংখ্যাই সর্বাপেক্ষা অধিক থাকে। যে বিত্তবান শ্রেণি পূর্ববঙ্গে বিকশিত হতে থাকে সেটির গাঁটছড়া বাঁধা থাকে পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা ও সামরিক কর্মকর্তা শ্রেণির সঙ্গে। যদিও উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান বরাবর সরব থাকে, তথাপি এখানকার উচ্চবিত্ত শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে ও সুবিধায় হাত মেলায় পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি শ্রেণির সঙ্গে। এর ফলে ‘এভাবে পূর্ববঙ্গকে শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প গড়ে উঠল, কৃষিক্ষেত্রে সাধিত হল প্রভূত উন্নতি। আর পূর্ববঙ্গ হল আরো গরিব। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ববঙ্গের মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হল দুস্তর ব্যবধান।’ (৩) মাহমুদুল হকের ঔপন্যাসিক শিল্পীসত্তার সংবেদনা সমকালীন ও ঐতিহাসিক বাস্তবের প্রেক্ষাপটকেই বেছে নিল তাঁর উপন্যাসের জগত বিনির্মাণে। সমালোচক কথিত ‘আরো গরিব’ পূর্ববঙ্গের সেই নামগোত্রহীন মানুষেরা অভিষিক্ত হলো মাহমুদুল হকের উপন্যাসের চরিত্রায়ণের মর্যাদায়।
এ-পর্বের তিনটি উপন্যাস মাহমুদুল হকের বাস্তবানুগ জীবনবোধের স্বাক্ষরই শুধু নয়, উপন্যাসগুলোর ভাষা-সংলাপ সবই তাঁর সমকালীন অন্য ঔপন্যাসিকদের তুলনায় স্বতন্ত্র। প্রতিদিনকার পরিচিত জীবনের রূপও তাঁর উপন্যাসে বয়ে আনে সম্পূর্ণ নতুন ব্যঞ্জনা। এখানেই মাহমুদুল হকের ঔপন্যাসিক সত্তা জীবনশিল্পীর স্পর্শে অনন্য। নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসের চরিত্রগুলো তাদের আবয়বিক উপস্থিতির মধ্য দিয়ে জানান দেয় সমকালীন বিপন্ন জীবনের সংবাদ। মাহমুদুল হকের উপন্যাসে চরিত্ররূপে চিত্রিত না হলে তাদের জীবনের গুরুত্ব আর্থসামাজিক বিচারে ইতিহাসের নিম্নতলের বৃত্তেই আটকে থাকত, কেননা নিজেদেরকে বিশিষ্ট করে তোলার মতো কোনো যোগ্যতা তাদের ছিল না। ঔপন্যাসিক তাদের হতদরিদ্র অবস্থান থেকে তাদের তুলে এনে উপন্যাসের সত্তায় পরিণত হওয়ার গৌরব দান করেছেন। চরিত্রগুলো উপন্যাসে যে-নামে রয়েছে তা একবার উল্লেখ করা যাক: হিরন, কাঞ্চন, ইদ্রিস কম্পোজিটর, কেরামত ম্যানেজার, জলিল বুকি, ফকির চাঁদ সর্দার, আকদ্দস ইত্যাদি। আর্থসামাজিক বিবেচনায় তারা সকলেই একটি শ্রেণির নিম্নবিত্ত। তাদের কেউ গ্রামত্যাগী-ভাগ্যান্বেষী, কেউ মোটামুটি শিক্ষিত কিন্তু দরিদ্র—সকলেই ভাসমান এবং তাদের জীবনের ভাসমানতা কখন কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে-বিষয়েও তারা পরিজ্ঞাত নয়। কথকের জবানিতে তার সত্যতাও উন্মোচিত হয়, ‘কেবলমাত্র টেনেটুনে এতোটুকু বলা যায়, গত পনেরো-ষোল মাসের মধ্যে আমাকে আট-দশবার আশ্রয় পরিবর্তন করতে হয়েছে, চাকরি করতে হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মোট তিনটি প্রতিষ্ঠানে।’ (৪)
এ-পর্যায়ের উপন্যাসগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য দিক এগুলোর দৃশ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপট। নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বলা যায়, এর কাহিনিবৃত্ত রাজধানী শহর ঢাকার একটি বস্তি। ফকিরচাঁদ সর্দারের বস্তি নামের এই বস্তিটির কাছেই অবস্থিত একটি গ্লাস ফ্যাক্টরি। উপন্যাসের কথক কামরান রসুল শিক্ষিত যুবক হলেও দারিদ্র্যের কারণে সেও বস্তিবাসী। পূর্বে উল্লেখ করা চরিত্রগুলোর মতো তার জীবনটাও ভাসমান। মোটকথা, সবগুলো চরিত্রই রাজধানীকেন্দ্রিক শোষিত পূর্ববঙ্গের মধ্যে নিম্নেরও নিম্ন মানুষজন। এদের সকলের মাঝখানে গ্রাম থেকে আসা এক বয়াতির মেয়ে হিরন। যুবতি হিরনের জীবন এসব উন্মূল চরিত্রের জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে এক ধরনের ওঠানামার তরঙ্গ তৈরি করলেও শেষপর্যন্ত কারও জীবনেরই কোনো উত্তরণ ঘটে না। বস্তির জীবন বদ্ধ, সম্ভাবনাহীন ডোবার জীবন। সেই বদ্ধ ডোবার মধ্যে হিরনের জীবনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। গ্রাম থেকে সে শহরে এসেছিল প্রেস বা ছাপাখানার একজন ম্যানেজার কেরামত আলীর প্রেমের আকর্ষণে। কিন্তু বাস্তবতা এমনই বৈরী যে হিরনের থাকার মতো একটু আশ্রয় পর্যন্ত জোটে না। ভাগ্যের ফেরে এবং সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় হিরন জন থেকে জনে উপনীত হয়, কিন্তু তার জীবনের চাকা আটকে যায় বদ্ধ ডোবার ততোধিক বদ্ধ কাদায়। ঔপন্যাসিক হিরনের অনিশ্চিত জীবনের শূন্যতা নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসের সমাজজীবনের এক রূঢ়বাস্তবতাকে তুলে ধরেন আমাদের সামনে।
হিরনের জীবন লেখকের কল্পনার ফসল নয়, তা বাস্তব পরিস্থিতিরই শিল্পানুকৃতি। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইদ্রিস কম্পোজিটরের উক্তিতে সেটা বোঝা যায়, ‘ওখানকার মেয়েদের মুখে শুনতাম তাদের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পাড়ার খাতায় নাম লিখিয়েছে, কাউকে গুন্ডা-বদমায়েশ বিক্রি করে রেখে দিয়েছে।’ (৫) সাধারণত দুর্ভিক্ষ, ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা চরম অভাবগ্রস্ততা, অর্থসংকট—এসবের ফলে গ্রাম্য বা শহুরে নারীরা আত্মবিক্রয়ের কঠিন পথকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। উনিশ শতকের কলকাতা বিষয়ক সমাজ-গবেষক সুমন্ত ব্যানার্জি তাঁর ডেঞ্জারাস আউটকাস্ট: দ্য প্রস্টিটিউট ইন নাইনটিস্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল (৬) গ্রন্থে লিখেছেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ইত্যাদি নানা কারণে নারীরা ঘর ছেড়ে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হতে বাধ্য ছিল। তাঁর এই বিশ্লেষণ উনিশ শতকের কলকাতার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটনির্ভর। ১৯৬৮ সালের পূর্ববঙ্গের সমাজজীবনের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সংকট এই উপন্যাসের হিরন চরিত্র এবং তার সূত্রে বর্ণিত বস্তির বাস্তবতায় ফুটে ওঠে। হিরন ও বস্তিবাসী লোকেদের যে-জীবনযাপনের ছবি ঔপন্যাসিক আঁকেন তা বিবর্ণ ও মর্মন্তুদ। দেশভাগ তথা স্বাধীনতার ফলে বাঙালি জনগোষ্ঠী একটা নতুন দেশের মালিক হয় বটে, কিন্তু তাদের জীবনের অর্থনীতি এতটাই নিম্নস্তরের যে নিজেদের অস্তিত্বকে কোনোভাবে রক্ষা করার জন্যও তাদের প্রস্তুতিকে মনে হয় অকিঞ্চিৎকর। মাহমুদুল হক তাঁর নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসে নিম্নজীবী জনমানুষের প্রকৃত সামাজিক অবস্থার ছবি এঁকেই ক্ষান্ত হননি, স্বপ্ন-প্রত্যাশা—এসব নিয়েও যে তাদের জীবনে নানা রঙের খেলা চলে এবং খেলা শেষে তাদের উপলব্ধিও, ‘বুঝলাম দুর্বলচিত্ত অক্ষম উদ্যমহীন মানুষের ধর্ম হলো অপরিণত আত্মপ্রসাদের আনন্দে নিজের কবর খোঁড়া।’ (৭)
হিরন চরিত্রটি সংকটাপন্ন সেই সময়ের একটা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতীক হয়ে উঠেছে। ২ আগস্ট ২০০৮ খ্রি. তারিখের The Daily Star পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, নিরাপদ তন্দ্রা গ্রন্থের কাহিনি গড়ে উঠেছে একটি বস্তিকে কেন্দ্র করে। সেই বস্তির জীবনচিত্র নিখুঁতভাবে তিনি অঙ্কন করেছেন। এই বস্তি তাঁর দেখা হরদত্ত গ্লাস ফ্যাক্টরির পাশে গড়ে ওঠা বস্তি। একসময় তিনি গোপীবাগ থেকে ট্রেনে করে নেত্রকোনা যাওয়ার পথে একটি আখড়ায় যান। সেখানে সার্কাস বা যাত্রা হচ্ছিল। ওই সার্কাস বা যাত্রাদলের একটি যুবতি নারী পুকুরের ঘাটে জলে পা ধুচ্ছিল। এই চিত্রটি তাঁকে আকর্ষণ করে। সেখান থেকেই এই গ্রন্থের চরিত্রসমূহের জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়। (৮) আসলে নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসটি যে-সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে সেই সময়ে যাত্রা কিংবা আখড়ায় যেসব মেয়েরা আসত, তারা স্বেচ্ছায় আসত না। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবনের রঙিন স্বপ্নের উন্মুক্ত আহ্বানে ঘর ছাড়ত, তারপর জীবনের বাস্তবতা তার উৎকট হাঁ নিয়ে গিলে নিত তাদের সেই স্বপ্ন। একের পর এক হাতবদল হয়ে তাদের শেষ ঠিকানা হতো পতিতালয়। কী সেই রঙিন স্বপ্ন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রেম। প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছেড়ে জীবনের প্রতিপদে হোঁচট খেতে খেতে শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়েই থিতু হতে হতো পতিতাপল্লিতে। ঔপন্যাসিক নিরাপদ তন্দ্রা-র মূল বক্তা ইদ্রিস কম্পোজিটরের বয়ানে তা সম্পর্কে প্রাকধারণা আমাদের আগেই দিয়ে রাখেন। ‘কিন্তু দলে ভারী কারা জানেন? পিরিতির মানুষের সাথে ঘর ছেড়ে শেষ পর্যন্ত ঐ ঘাটে এসে ভিড়েছে যারা। যেখানেই গেছি, ওই এক ধরনের কেস শয়ে শয়ে।’ (৯)
ভাগ্যকে বদলানোর জন্য, বদলে জীবনে সম্পন্ন হয়ে ওঠার জন্য তার গ্রামত্যাগ এবং পরবর্তী পর্যায়ে আর কোনোভাবেই নিজেকে এগিয়ে নিতে না পারা, ব্যর্থতায় জীবনটাকে নষ্টের মুখে ঠেলে দেওয়া—এসব অসংখ্য মানুষের হতাশার কাহিনি। ঔপন্যাসিক চাইলেও হিরনের জীবনটাকে বদলাতে পারেন না, কারণ বাস্তবে সেরকম কোনো ইঙ্গিত তাঁর নাগালে মেলে না, কিন্তু হিরনের প্রতি সহানুভূতি তিনি প্রকাশ করতে পারেন। তাঁর সেই দরদি-সমব্যথী মনের পরিচয় পাঠকের অজানা থাকে না। উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ইদ্রিস কম্পোজিটরের মধ্যে ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হকের জীবনভাবনার কেন্দ্রীভূত একটা মাত্রা পাওয়া যায়। হিরনের মতো একজন সুন্দরী-নির্দোষ যুবতির জীবনটা তার চোখের সামনে দিয়ে বিনষ্টির অতলে হারিয়ে যাবে অথচ সে এর প্রতিশোধে কিছুই করতে পারবে না—এই ভাবনা তাকে দগ্ধে-দগ্ধে পীড়ন করে। তার মনের গভীরে হিরনের জন্য থাকে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা এবং সে মনে-প্রাণে চেয়েছে হিরন যাতে সামাজিক ও বিন্যস্ত জীবনের প্রাঙ্গণে বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারে। তথাপি নিজের সংকুচিত-দ্বিধাগ্রস্ত সত্তার নিষ্ক্রিয়তা তাকে নিরুদ্যম করে রাখে। হিরনের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্টে সে নিজে যন্ত্রণা অনুভব করে। ইদ্রিস ছিল হিরনের রক্ষক। তাই তাকে রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতা তার মনের গভীরে ফেলে গাঢ় ছাপ। তার সেই যন্ত্রণাবিদ্ধ অবস্থার চিত্রণ ঔপন্যাসিকেরই সহানুভূতিপ্রবণ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশের ফল। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে:
একটা উন্মত্ত ঘোড়া, ফোঁশ ফোঁশ করে চলছে সমানে; ভয়ঙ্কর স্ফীত তার নাসারন্ধ্র। অগ্নিগোলকের মতো সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা তীব্র দ, মুহূর্তের মধ্যে যে দ জন্ম দিয়েছে অপর একটি দ-এর; এবং এই দ থেকে বেরিয়ে এসেছে দু’টি দ—যাদের প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে একটি করে দ ছুঁড়ে দিচ্ছে, অর্থাৎ দ-এর অক্ষৌহিণী অভিযান প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে, দ—দ—দ—দদদদদদদদ—দদদদদদদদ—তলিয়ে যেতে থাকে ইদ্রিস। (১০)
দ-এর নির্দয় অন্ধকারে ক্রমাগত মানবশিশু মায়ের জঠরে যে-ভঙ্গিতে গুটিয়ে থাকে তা দ-এর ভঙ্গি। আবার বিরূপ পারিপার্শ্বিকতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখাটাও দ-এর প্রতীকে তুলনীয়। হিরনকে এত চেয়েও কখনও মুখ ফুটে ভালো লাগার কথা বলতে পারেনি ইদ্রিস। আর উপন্যাসের শেষে হিরনের করুণ পরিণতি এবং তা থেকে উদ্ধারে নিজের অপরাগতাই জ্বরের ঘোরে তাকে মূলত দ-এর ‘অক্ষৌহিণী’ (১১) আক্রমণের ফলে, ইদ্রিস দ-এর মতো করেই নিজের মধ্যে নিজে সেঁটিয়ে যায়, নিজের প্রতি ঘৃণায়, বিরুদ্ধ পৃথিবীর কাছে নিজের শক্তিমত্তার পরীক্ষার হার স্বীকারে। ঔপন্যাসিক তাঁর এই দুর্মর যন্ত্রণাকে পরিস্ফুট করতে যে ভাষা এবং পরাবাস্তব পরিবেশের অবতারণা ঘটান তা তাঁর শিল্পকীর্তির অনন্যতাকে এক ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করে।
মাহমুদুল হকের হিরনাশ্রিত জীবনভাবনা নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসে প্রতিফলিত ইতিবাচক জীবনদর্শনের স্বাক্ষর। ইদ্রিসের ব্যর্থতার যৌক্তিক কারণও থাকে যা তারই জবানিতে আমরা পাই। সে তো একজন ব্যক্তিই শুধু নয়, একটা শ্রেণিরও প্রতিনিধি। সে যখন হিরনের জন্য ভাবে তখন সে একজন ব্যক্তি, কিন্তু যখন সে ব্যর্থ হয় তখন সেটা তার সমগ্র শ্রেণির ব্যর্থতা রূপেই স্পষ্টতা পায়। তার সেই ব্যর্থতার হেতু সে নিজে নয়, তার সামাজিক চৌহদ্দি, তার বহু যুগের অবদমিত অবস্থান। উপন্যাসের নায়ক বা কথক কামরান রসুলের প্রতি ইদ্রিসের সংলাপে তা একই সঙ্গে হয়ে ওঠে বাস্তবানুগ ও দার্শনিকসুলভ:
আমরা হলাম গিয়ে নিচুতলার জীব, মন দিয়ে বিলাসিতার কারবার এখানে চলে না। নিয়তই যেটা চলছে তাকে বরং দাঙ্গাহাঙ্গামা বলাই ভালো। এই দাঙ্গাহাঙ্গামা, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, ছুরি মারামারির ভেতরে কতোদূর ভালো চিন্তা করতে পারবেন আপনি, মানুষ তো আর ফেরেশতা নয়। চেয়ে দেখুন এখানকার দুঃখগুলো, দুঃখবোধগুলোও কেমন যেন ভিন্ন ধাতের। দুঃখ হয়তো উঁচুতলাতেও আছে, কিন্তু কত রকমে তা নিয়ন্ত্রিত। নিচুতলার দুঃখগুলো বেআবু, খোলামেলা কাকের অন্নের মতো ছড়ানো-ছিটানো। চোখ বন্ধ করে থাকবেন সেটি হচ্ছে না। অন্যত্র যেমন চোখ চাইলে দেখা যায়, কান পাতলে শোনা যায় এখানে তা নয়, এখানে চোখ থাকলেই দেখতে হয়, কান থাকলেই শুনতে হয়। আপনার মর্জির ওপর নির্ভর করে না কোন কিছুই, বালাই থাকে না বুচি-অরুচির। না গজাতেই ঘুণ, না উঠতেই আছাড়, এখানে এই রকম। এইভাবে এক সময় মনটা পাথর হয়ে যায়। (১২)
ইদ্রিসের এই উপলব্ধি আর্তনাদের মতো তার জীবনের দুঃখের স্বরূপকে ব্যক্ত করেছে। সে হিরনকে ভালোবাসত বলেই তার মনে এমন বেদনাজারিত বোধের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অর্থনেতিক সংকটের পরিব্যাপ্ত ক্ষতের শিকার হয়ে ইদ্রিস এবং তার সহযাত্রীরা কেবল গুমরে মরেছে অন্ধকারে।
নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসটির কেন্দ্র হিরন হলেও এটি ব্যক্তি এবং শ্রেণির জীবনভাষ্য। ব্যক্তিত্বের আলোকপাত তিনটি রশ্মির উৎস থেকে আসে: হিরন, ইদ্রিস ও কামরান রসুল। হিরন চরিত্রটির নারীসত্তা ক্রমবিপর্যস্ত হয়ে স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা অপূর্ণ জীবনের আখ্যানে গিয়ে ঠেকে। ইদ্রিস কম্পোজিটরের মধ্যে সমব্যথী মানবিক বোধের ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু তা শেষপর্যন্ত অনুকূল পরিবেশের অভাবে অপরিণতই থেকে যায়। কথক কামরান রসুল পালন করে এক ধরনের দ্রষ্টার ভূমিকা। তার সূত্রে সামাজিক জীবনের গভীরে প্রবেশ করার ক্ষেত্র তৈরি হয়। আবার সামাজিক চরিত্রবৃত্তের অনেকগুলো অবয়ব গড়ে ওঠে যারা নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসের এক বাস্তব লোকালয়ের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনিকে বিশিষ্টতায় অভিষিক্ত করে। মাহমুদুল হকের গড়া এই মানুষগুলো সমাজেরই নিত্য পরিচিত একেকটি চরিত্র, যারা হারিয়ে যায় অমনোযোগের আড়ালে। মাহমুদুল হক তাদের পেশা, তাদের সক্রিয়তা ও তাদের অবস্থানকে সমগ্র রাষ্ট্রিক-সামাজিক পরস্থিতির সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে বিচার করার চেষ্টা করেন। এতে হিরন, ইদ্রিস—এসব মানুষের স্বপ্নভঙ্গের কারণ ও পরিণামটিকে বোঝা যায়। হিরন বা ইদ্রিসের জীবনের করুণ পরিণতি দেখানোই লেখকের বা তাঁর উপন্যাসটির একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। একটি লোকালয় বা জনজীবন শেষ পর্যন্ত কোন সত্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তারও আভাস মেলে। সেই সত্য লেখকের সত্য হলেও তার উৎস তাঁর বর্ণিত সামাজিক জীবনের ক্ষেত্র। লেখক যেটিকে ‘আখড়া’ বলে অভিহিত করেন বা ‘খড়পট্টি’ নামে চিহ্নিত করেন তা সামাজিক দৃষ্টিতে অন্ধকারময় জীবনের ইঙ্গিত। হিরনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গিয়ে পরিণত হয় ‘আখড়ার সম্পত্তি’তে। সেই আখড়ার জীবন-বাস্তবতা ভয়ংকর জীবনবিমুখতা স্মরণ করে কথক কামরান রসুল বলে উঠেছিল, ‘সভ্যতা-টভ্যতা নিয়ে খামোখা মাথা না ঘামানোই ভাল।’ (১৩) উপন্যাসের নিরাপদ তন্দ্রা নামের মধ্যেই থাকে এক আচ্ছন্নতা বা ঘোরের ইঙ্গিত, তবে সেই তন্দ্রা আদৌ নিরাপদ তন্দ্রা-রূপে বজায় থাকবে কি না সেই জিজ্ঞাসার মুখোমুখি এসে উপন্যাসটি পরিসমাপ্ত হয়। উপন্যাসের শেষ দিকে একটা ভায়োলেন্সের চিত্রও আমরা পাই। ‘আখড়ার সম্পত্তি’ হিরনকে লাভ করার জন্য কাঞ্চন ও কানা হাবলুর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং তার পরিণতিতে কানা হাবলুর কাঞ্চনকে সশস্ত্র আক্রমণ নিরাপদ তন্দ্রা-র দুঃস্বপ্নতাড়িত বাস্তবের খানিকটা উদ্ঘাটন হলেও তা এক অকথিত অধ্যায়ের দিকে আমাদের ইঙ্গিত করে। ভায়োলেন্সের চিত্র আঁকতে গিয়ে ঔপন্যাসিক এমনই নির্মোহ যে একটি রক্তাক্ত কাটা হাতের প্রসঙ্গও তখন অস্বাভাবিক মনে হয় না। কানা হাবলু দা দিয়ে কুপিয়ে কাঞ্চনের হাত তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সেই রক্তাক্ত হাত ‘গুঁজে দিলো হিরনের কোঁচড়ে।’ (১৪)
মাহমুদুল হকের নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাস তন্দ্রাচ্ছন্নতার ঘোরে নয়, সচেতনভাবে প্রত্যক্ষ করা সমকালীন পূর্ববঙ্গের নিম্নবিত্ত মানুষদের রূঢ় জীবন-বাস্তবতার কাহিনি। ইদ্রিস কম্পোজিটরের বয়ানে, ‘প্রথমে কেরামত আলী, কেরামত আলী থেকে কোবাত আলী, কোবাত আলী থেকে আকদ্দস, আকদ্দস থেকে কাঞ্চন, কাঞ্চন থেকে কাশেম গুন্ডা, হিরন একটা লুটের মাল।’ (১৫) কাশেমের ঝাঁজালো কথায় যা চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা পায়, ‘আর মাগী তুইও শোন। আজ থেকে তুই কারো মাগী নস। তুই আখড়ার মাল’... (১৬)
জীবন ও বাস্তবতার নিরিখে মাহমুদুল হকের দ্বিতীয় উপন্যাস মাটির জাহাজ (প্রকাশকাল: ১৯৯৬, রচনাকাল: ১৯৭৭)। এক দশককালের ব্যবধানে এই দুটি উপন্যাসের অন্তবর্তীকালে ঘটে গেছে বিপুল পালাবদল। সেটি হলো রক্তাক্ত ইতিহাস-সোপান পেরিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। একটি জনগোষ্ঠী তার বিভিন্ন পর্বের ঔপনিবেশিক শাসন আর শোষণের অধ্যায় পেরিয়ে এসে মুক্ত জীবনের অভিসারী হয়ে উঠেছে। কাজেই ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হকের উপন্যাসের জীবন-বাস্তবতার উদযাপনও সেদিক থেকে এই রূপান্তরের পরিণতিতে ভিন্ন বাঁকের অনুগামী হওয়ার প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে। পূর্ববর্তী নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসে আমরা দেখেছি পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কঠিন জীবনসংগ্রামের প্রবাহ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এসে পূর্ববর্তী কালবৃত্তের মানুষেরা ‘পূর্ববঙ্গ’ শব্দের পরিবর্তে গ্রহণ করেছে ‘বাংলাদেশ’ নামক নতুন একটি পরিচয়কে এবং ঔপনিবেশিক শাসনের পরিণাম অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক শোষণের স্বার্থান্বেষী রাজনীতির অতিরেক একটি সুস্থতা-অন্বেষী সামাজিক কাঠামোকে তারা বরণ করে নিয়েছে। এমন প্রত্যাশা-জাগানো পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে পাঠক মাহমুদুল হকের মাটির জাহাজ শিরোনামের এই উপন্যাস পড়ে দারুণ দোটানায় পড়ে যান, কেননা তাঁর এই উপন্যাসটিতে জীবনের বাস্তবতা তাঁরই পূর্ববর্তী নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাস থেকে আরও ভয়ানক এবং আরও উদগ্র। সাধারণ মানুষ বলে সমাজে যাদের পরিচিতি, যারা সমাজ-রাষ্ট্রের অনেক বড়ো একটি অংশ, তাদের আগেকার জীবনের কষ্ট-হতাশা কমে না বরং স্বাধীন দেশে এসে তাদের অস্তিত্ব আরও প্রকাশ্য ও নগ্ন হয়ে উঠেছে।
১৯৬৮ সালে রচিত নিরাপদ তন্দ্রা উপন্যাসে যাদের জীবনচিত্র বিধৃত হয় তাদের জীবনের হতাশা আর সর্বনাশের জন্য বিদেশি আমলা বা সামরিকতন্ত্রকে দায়ী করা যায়, কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করা মানুষ তাদের হতাশা আর সর্বনাশের জন্যে বিদেশি তথা পাকিস্তানি উপনিবেশবাদকে দায়ী করতে পারে না। অর্থাৎ দেশীয় আর্থসামাজিক কাঠামোর মধ্যেই রচিত হতে থাকে দেশের আপামর মানুষের ক্রম অধঃপতনের বৃত্তান্ত। মাটির জাহাজ ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হকের গভীর জীবনবোধ আর ক্ষুব্ধ মানসের প্রতিচ্ছবি। সমালোচকের পর্যবেক্ষণ:
কীভাবে গ্রাম তস্য গ্রাম, লোকায়ত তস্য লোকায়ত গ্রাম-বাংলা থেকে ‘ভাতে মরি ভাতে বাঁচি’ বাঙালি ঘরের মেয়েরা এক মুঠো ভাতের জন্য দালাল ও ‘চামড়া’র কারবারীদের খপ্পরে পড়ে বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করে, করতে বাধ্য হয়, তার একটি মর্মন্তুদ কাহিনি শুনিয়েছেন মরমী কথাকার মাহমুদুল হক তাঁর মাটির জাহাজ-এ। (১৭)
মাটির জাহাজ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়নাল শহরের কুশলী ব্যবসায়ী, কিন্তু তার প্রকৃত ব্যবসাটি জনসমক্ষে প্রকাশযোগ্য নয়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে শহর থেকে তার গ্রামে আসার প্রয়োজন পড়ে। সে যখন গ্রামীণ জলপথের নানা পথঘাট পেরিয়ে এসে গ্রামের অন্তর্জীবনে ঢোকে তখন একটা নৈসর্গিক পরিবেশের মুখোমুখি তাকে আবিষ্কার করে পাঠক। কিন্তু অবিলম্বে পাঠকের সেই আবেগ কেটে যায় এবং পাঠকের দৃষ্টিতে আসে এক দুঃসময়খচিত কালের প্রেক্ষাপটে জয়নাল দণ্ডায়মান। শহরবাসী জয়নালের গ্রামে পৌঁছে নৌকাবতরণের মুহূর্তে লেখক এক ঝটকায় বাস্তবের রূঢ় তলে স্থাপন করেন তাঁর বিষয়বস্তুকে। একটা অস্বস্তি আর অপ্রসন্ন পরিবেশকে আমরা পাই লেখকের বর্ণনায়:
ঘিয়ে ভাজা সিঙাড়ার গন্ধ যখন এক এক লাফে রক্ষীবাহিনীর মচমচে বুটজুতো ডিঙিয়ে ধলেশ্বরীর উন্মাতাল ঝাপটায় আছড়ে পড়ে ঘপাং ঘপাং ঘাই মারা শুরু করেছে, মিড়মিড়ে রোদটুকুও গায়েব, ছাইচাপা পড়েছে সূর্য, হলহল করছে গরম, গুমোট জ’মে পাথর হয়েছে, দেখে সামনে দাঁড়িয়ে মনোহর, তার বিখ্যাত কান এঁটো করা হাসিটি অবিকল সেই রকমই আছে। (১৮)
‘রক্ষীবাহিনীর মচমচে বুটজুতো’—লেখকের এই বিবরণ দুভাবে আমাদের সংযোগ ঘটায় ঔপন্যাসিকের উপন্যাসনিহিত সমকালের সঙ্গে: প্রথমত, সময়টি ১৯৭৪-৭৫ সালের মধ্যবর্তী এবং তা খুব ইতিবাচকতা-জাগানো নয়, কেননা ‘বুটজুতো’ শব্দটি আমাদের নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কালবৃত্তে। শব্দটি জনজীবনের কঠিন বাস্তবকে ধারণ করে। তাই জয়নালের আগমন এবং তার তৎপরতায় একটা নেতিবাচকতার ইঙ্গিত আভাসিত হতে থাকে। ক্রমে জয়নালের পরিচয় পাঠকের সামনে উদ্ঘাটিত হয় এবং দেখা যায়, এক মর্মন্তুদ জীবন-অধ্যায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জয়নাল। স্বাধীনতার অভ্যুদয়ে যে-বিপুল জনগোষ্ঠীর আশাবাদী হয়ে হতাশামুক্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার কথা, বাস্তবে তাদের দুঃখের দিন ফুরায় না, বরং তাদের জন্য অপেক্ষা করে আরও হতাশা আর দুঃস্বপ্নখচিত পরিণতি। জয়নালের আগমনের সংবাদ তাদের জন্যে সুখকর নয়, তাদের অভাব-দারিদ্র্য আর সম্ভাবনার মাঝখানে দুর্ভেদ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো জয়নাল। বস্তুত জয়নালের গ্রামে আগমনের উদ্দেশ্য গ্রাম থেকে অভাবগ্রস্ত পরিবার থেকে যুবতিদের সংগ্রহ করে নিয়ে শহরে তাদের দিয়ে পতিতাবৃত্তি করানো। জয়নালের এই কাজে তার সঙ্গে থাকে দালাল মনোহর। নৌকায় করে তারা পাড়াগাঁর এ-বাড়ি ও-বাড়ি যায় এবং সুযোগমতো বাড়িয়ে দেয় স্বার্থের হাত। কুসুম, সখি, হেনা প্রমুখ মেয়েকে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের সর্বনাশের প্রান্তে নিয়ে যায় জয়নাল-মনোহর এবং তাদের মতো লোকেরা। প্রবল আর্থিক সংকটে পড়া গ্রামীণ সাধারণ মানুষ জয়নালের মতো লোকেদের অসৎ ব্যবসায়ের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কয়েক বছরের মধ্যে যুদ্ধ ও ধ্বংসের মারাত্মক ক্ষতি সামলে নিয়ে এগোতে থাকা দেশ অল্প সময়ের মধ্যেই এর আর্থিক ভারসাম্যের বিন্দুতে উপস্থিত হতে পারে না।
পাকিস্তানিদের ভয়ংকর আগ্রাসনের শিকার দেশ ও জাতি টলোমলো পায়ে সামনে পথ পাড়ি দিচ্ছিল। নয়া ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি ছাড়িয়ে দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি নিজেরা পুঁজির মালিক হয়ে নিজেদের অবস্থানকে মজবুত করার অধ্যবসায়ে নিয়োজিত। অভাব-দুর্ভিক্ষ-রোগশোক—এসব চেপে ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে। এরকম আর্থিক চরমাবস্থা আর দুর্যোগের সরাসরি শিকারে পরিণত হয় গ্রামাঞ্চলের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী। তাদের বিপন্নতার সুযোগকে ব্যবহার করে তাদের জীবনকে আরও শোচনীয় অবস্থার দিকে ঠেলে দেয় জয়নালের মতো সমাজবিরোধী লোকেরা। মাহমুদুল হক তাঁর মাটির জাহাজ উপন্যাসে নিভৃত-শান্ত বাংলাদেশের গ্রামের গহিনে যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের সময়টাতে যে ঝড়ঝঞ্ঝা আর বিক্ষুব্ধতা চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছিল তাকেই প্রাণবন্ত রূপদান করেন। এ-প্রসঙ্গে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশেরই আরেকজন কথাশিল্পী শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক উপন্যাসের কথা বলা যায়। ওই উপন্যাসে ১৯৪৭-এর দেশবিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির চিত্র প্রতিবিম্বিত হয়। রমজান নামের এক দুর্বৃত্ত গ্রামের সাধারণ মানুষের আর্থিক দুরবস্থার সুযোগে তাদেরকে নিয়ে ঠিক এমনই এক হীন ক্রীড়ায় মেতে উঠেছিল। শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই, দেশবিভাগ-নতুন দেশগঠন ইত্যাদি কোলাহলের মধ্যে চাপা পড়ে যায় দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনের দাবির দিকগুলো। মাহমুদুল হকের উপন্যাসেও আমরা দেখব ১৯৭১-পরবর্তী অর্জনের আশ্বাস দেশ-জাতির সামনে একটা স্বপ্ন-সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের বার্তা বয়ে আনে। বহু যুগের পরাধীনতার অবসানকে একটা বিশাল প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে বলা চলে, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের, দেশ বলতে যে-জনগোষ্ঠীকে বোঝায় তাদের জীবনের প্রকৃত অবস্থাকে সেই প্রাপ্তির আনন্দে অবহেলা করা বা পাশ কাটিয়ে যাওয়াটাও কাম্য নয়। বাস্তবে সেই ব্যাপারটাই ঘটেছিল। তাই একসময়ে শহীদুল্লা কায়সারকে এবং তারপর মাহমুদুল হককে কাঁধে নিতে হয় সেই জনগোষ্ঠীর অশ্রুত জীবনবাণীকে ভাষায় রূপবদ্ধ করার কাজটিকে। মাহমুদুল হকের জীবন-বাস্তবতা কেবল সমাজের দুর্গত মানুষের ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় না। একটা সময়ের প্রকৃত অবয়বগ্রন্থনা, সমস্যার সূত্রানুসন্ধান, সময়ের খাতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হওয়া চরিত্রগুলোকে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে নির্মাণ করা—সবই তিনি করেন অনুধ্যানী শিল্পীসত্তার মনোযোগ দিয়ে।
মাহমুদুল হকের নিরাপদ তন্দ্রা এবং মাটির জাহাজ উপন্যাসদ্বয়ের জীবন ও বাস্তবতার যোগসূত্রকে সমালোচকের বিশ্লেষণের আলোকে বিচার করলে উপন্যাসগুলোর শিল্পপ্রেক্ষণবিন্দুকে শনাক্ত করা যাবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী এবং মাটির জাহাজ উপন্যাসের সমকালের সামাজিকতা প্রসঙ্গে সমালোচক লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার অবসানে নব্য বাঙালির মধ্যেও জন্ম নেয় চিরাচরিত ক্ষমতাবর্গ এবং সৃষ্টি হয় মাৎস্যন্যায়ের।’ (১৯) ১৯৪৭-পরবর্তীকালেও এমন ক্ষমতাবর্গ তৈরি হয়েছিল যারা পুরোনো শোষককে সরিয়ে নিজেরা হয়ে উঠেছিল নতুন শোষক। শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক উপন্যাসে তেমনই এক চরিত্র রমজানের দেখা মেলে, যে তার পূর্বতন সামন্ত-জমিদারদের প্রতীক ফেলু মিয়ার স্থান দখল করে হয়ে ওঠে নতুন ক্ষমতাধর। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশো বছর উপন্যাসের তৃতীয় আর্কাদিও ক্ষমতা হাতে পেয়ে হয়ে ওঠে মাকোন্দার সবচেয়ে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক। ঠিক এভাবে মাহমুদুল হকের উপন্যাসেও আমরা দেখব জয়নালের আবির্ভাব ঘটে নতুন ক্ষমতাধরের প্রতিভূরূপে। তার মূল লক্ষ্য অর্থ বা পুঁজি। কুসুম, সখি, হেনা তার পুঁজি পুঞ্জীভূত করা ও পুঁজি-বিস্তারের উপায় ও মাধ্যম। জয়নালের স্বরূপটাকে তার নিজের উপলব্ধি থেকে চিনে নেওয়া যায়। উপযুক্ত যুবতি নারীর সন্ধানে নৌকাভ্রমণরত জয়নালকে মনোহরের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘পাপের জীবন। ইচ্ছে হয় সব ছেড়ে দিয়ে ভালো হয়ে যাই, এ আর ভালো লাগে না। জুয়োটা তো ছাড়লাম, এসব কাজও ছাড়বো ছাড়বো করি, কিন্তু ঐ পর্যন্ত! কি ক’রে খাবো, প্রাণে বাঁচবো, আর কিছু তো শিখি নি, আর কোনো কিছু বুঝি নি, এখন এই ঘানিকল থেকে বেরুনো সহজ নয়।’ (২০)
শহীদুল্লা কায়সারের রমজান এবং মাহমুদুল হকের জয়নালের মধ্যে কিছু পার্থক্যের কথা বলা যায়। রমজানের পরনে আটপৌরে পোশাক লুঙ্গি এবং তাকে সাধারণ মানুষদেরই একজন মনে হয়। জয়নালের পরনে প্যান্ট-শার্ট এবং তার হাতে ‘ব্রিফকেস’। এই যে রূপান্তর এবং এই যে পরিবর্তন তা কেবল কালগত দূরত্বের ফল নয়, জয়নাল আসলে নব্য ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি। সে তখনও পুরোপুরি ধনি হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ধন-নিষ্কাশনের প্রক্রিয়ার মধ্যে তার অবস্থান। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যে-নব্য ধনিক শ্রেণি তৈরি হয় তাদের কাছে একমাত্র আদর্শ ছিল পুঁজি; জয়নাল সেই শেণির প্রতিনিধি। মাহমুদুল হকের বাস্তব জীবনবোধের ফসল জয়নাল।
মাহমুদুল হকের সমগ্র উপন্যাসে নারীর রয়েছে একটি বিশেষ ও স্বতন্ত্র স্থান। অনুর পাঠশালা ও কালো বরফ— মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ ধারার এই দুটি উপন্যাসে সরু দাসী কিংবা মাধুরীর ছিল কেন্দ্রীয় অবস্থান। নিরাপদ তন্দ্রা-য়ও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিরন। মাটির জাহাজ উপন্যাসে জয়নালের কেন্দ্রিকতায় উপন্যাসের কাহিনির আবর্তন চলে। কিন্তু জীবনের স্তর থেকে স্তরান্তর যাত্রায় ঔপন্যাসিকের অবলম্বন রূপে একে-একে উপস্থিত নারীরাই: কুসুম, সখি, হেনা কিংবা শাহানা। অভাবের তাড়না আর দারিদ্র্যের লাঞ্ছনায় গ্রামীণ মানুষের বিপন্নতার কাহিনির সমান্তরালে নারীর সর্বনাশের ইতিবৃত্ত আরও এক গভীর বেদনার সঞ্চার ঘটায়। বাংলাদেশের গ্রাম তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কিংবদন্তির আড়ালে নীরবে-নিভৃতিতে যে ভেতরে-ভেতরে ক্ষীয়মান নারীর অপমান আর করুণাঘন পরিণতি, তারই একটা সামাজিক বাস্তবতা। যে-সমাজের ক্রম অধঃপতনের আলেখ্য মাহমুদুল হকের বিষয়বস্তু সেখানে নারীর বিপন্নতাকে বাদ দিয়ে সেই কাহিনিতে সম্পূর্ণতা আনা অসম্ভব। নারীর বেদনা, দীর্ঘশ্বাস আর কান্নার মধ্য দিয়ে তাই সমাপ্তিরেখার দিকে এগোয় মাটির জাহাজ উপন্যাস। গ্রামের তরুণী কুসুম যখন জয়নাল ও মনোহরের নৌকায় চড়ে গ্রামত্যাগে বাধ্য হয় তখন তার হৃদয়-নিংড়ানো কান্না চিরকালীন বাংলার নদী ও নৌকার এবং ঢেউয়ের উপস্থিতিতে এক মর্মস্পর্শী অভিঘাতের সৃষ্টি করে। ঔপন্যাসিকের বর্ণনা থেকে উদ্ধৃতি, ‘‘ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ফাঁকে নৌকোর ওপরে কপাল রেখেছিল কুসুম, এবার সে ‘মা-ওমা-মায়ো’ বলে ডুকরে ওঠে; ফলে নৌকো কিছুটা দুলে যায়।’’ (২১) নৌকোর দুলে ওঠার মধ্যে সমাজ-সংসার আর জাগতিক সুখ-দুঃখের অংশীদার মানুষের দৃষ্টির সামনে যেন আলোড়িত হলো গোটা পৃথিবীটা। তবু কুসুমের অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রাকে রোধ করা যায় না। জয়নালের ব্রিফকেসের মধ্যে থাকা পুঁজির স্ফীত হওয়ার সম্ভাবনাই কেবল বাড়তে থাকে।
১৯৮১ সালে রচিত মাহমুদুল হকের পাতালপুরী উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। জীবন ও বাস্তবতার পর্যায়ের এ-উপন্যাসটি ক্ষীণকায়, কিন্তু জীবনবোধের গভীরতায় অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের এক দশককাল সময়ের মধ্যে একের পর এক বঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়সংক্রান্তি পেরিয়ে আসা বাংলাদেশ শেষপর্যন্ত এমন একটা অবরুদ্ধ অবস্থায় এসে পৌছে যেখানে স্বাধীনতা, দেশ-জাতির স্বপ্ন-প্রত্যাশা—কথাগুলো শোনাতে থাকে উপহাসের মতো। দুঃসময়ের ছাপ-পরিকীর্ণ প্রেক্ষাপটে উন্মোচিত হয় মাহমুদুল হকের পাতালপুরী নামের এই উপন্যাস। উপন্যাসের নামকরণের মধ্যে রয়েছে একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের আবহ—‘পাতালপুরী’ শব্দের মাধ্যমে লেখক আসলে তাঁর চারপাশের বস্তুপৃথিবীর কথাই বলতে চেয়েছেন। কিন্তু বস্তুপৃথিবী যখন তুলিত হয় পাতালের সঙ্গে তখন সেটি সম্পূর্ণ বিপরীত ও উল্টো অর্থ বহন করে। মহাকবি দান্তের ডিভাইন কমেডি-তে নরকের বর্ণনা পাতালেরই বর্ণনা এবং সেখানে স্বর্গলোকের অবস্থান ঊর্ধ্বে। পাতাল তাই সর্বৈবভাবেই নিম্ন-অবস্থানের সূচক। জীবন-বাস্তবতাধারার এই উপন্যাসে এসে মাহমুদুল হক সরাসরি প্রত্যক্ষ ও খোলামেলা অবস্থান নিয়েছেন। উপন্যাসের ভাষা-দৃশ্য-সংলাপ—সব ক্ষেত্রেই তিনি সমস্ত রকমের প্রতীকতার খোলস ছেড়ে বেরিয়েছেন। পাতালপুরী-তে বিষয় যেমন প্রকাশ্য, লেখকের অবস্থানও তদ্রূপ। উপন্যাসের নায়ক আমিনুল সমকালের এক প্রত্যক্ষদর্শী। যে-সমকালের দর্শক আমিনুল তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বেনজির এবং চরমতার সীমাস্পর্শী। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং একইসঙ্গে দেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন শুধু যে দেশীয় আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটকে বদলে দিল তা নয়, বস্তুত ১৯৭৫-এর পট-পরিবর্তনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী ও দূরকালবিস্তারী। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট এই হত্যাকাণ্ডের পরিণামে উল্টো খাতে বইতে শুরু করে। এই পালাবদলের উৎস হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক অবস্থার থাকে বিশেষ গুরুত্ব। তাই উপন্যাসের বিষয় হিসেবে এই অত্যন্ত নাজুক-ঝুঁকিপূর্ণ কালপরিধিকে বেছে নেওয়া ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হকের জন্য ছিল একটা সাহসী কাজ। এটি তাঁর সাহিত্যজীবনের একটি ব্যতিক্রমী ঘটনাও। এরকম প্রত্যক্ষতাধর্মী উপন্যাস তাঁকে আর রচনা করতে দেখা যায়নি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সামরিক স্বৈরাচারের আবির্ভাব ঘটে মাহমুদুল হকের পাতালপুরী উপন্যাস রচনার বছর ছয়েক আগে। একটা অবরুদ্ধ-মানবতাবিরোধী সামাজিক প্রতিবেশের মুখোমুখি হওয়াটাও সেই প্রথম। এরকম পরিস্থিতিতে যা হয়, যা হওয়া সম্ভব তার সবকিছুই ঘটতে দেখা যায় উপন্যাসটিতে। তদুপরি গণতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিণতিতে সামরিকতন্ত্রের আবির্ভাবের ফলে রাজনৈতিক জটিলতারও সৃষ্টি হয় এই সময় থেকে। সব মিলিয়ে এক দুঃস্বপ্নতাড়িত সমকালের রেখাপথ বিস্তীর্ণ মাহমুদুল হকের ঔপন্যাসিক-মানসের সামনে। জীবন আর বাস্তবতার মিশেলে তাঁর রচিত পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলোর চেয়ে আলাদা হয়ে যায় এ-উপন্যাস। বলা যায়, সমকালীন জীবনের প্রকৃত বাস্তবতাকে তার প্রামাণিকতাসহ একের পর এক ঘটনার বিন্যাসে উপস্থিত করলেন তিনি। এসব ঘটনাধারার একদিকে থাকে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের নিম্নগামিতা। উপন্যাসের নায়ক আমিনুল তার বান্ধবী রানুকে সমকালের যে-বিবরণ তুলে ধরে তাকে উপন্যাসটির তৎকালীন পরিস্থিতির সারমর্ম বলা যায়। আমিনুলের সংলাপ থেকে উদ্ধৃতি:
এই চারদিকে সব গুমখুন, আজ শোনো অমুককে পাওয়া যাচ্ছে না, কাল শোনো ধানক্ষেতের পাশে তমুকের লাশ পড়ে আছে, দেশে আইন-শৃঙ্খলার লোমটিও নেই, কী হবে বলো তো শেষ পর্যন্ত?... ছাত্ররা ধুমসে গাঁজা-চরসে মজে আছে, ছাত্রীরা চুটিয়ে ডেটিং করে বেড়াচ্ছে, নেতারা রাতের অন্ধকারে নিজের বখরা গুনে গুনে সিন্দুক ভরছে, কতগুলো খুনি আসামি আর দাগি মাল কাঁধের ওপর সওয়ার হয়ে মেজাজ সপ্তমে তুলে যখন যেমন খুশি এক-একটা ফরমান জারি করছে আর দেশের তাবৎ লোক তাই কাঁধে নিয়ে ন্যাংটো হয়ে ধেই-থেই করে নেচে বেড়াচ্ছে! ঘেন্নায় আমার গা ঘিনঘিন করে, এরা মানুষ না জানোয়ার? এত হিংসা আর গুন্ডামির ছত্রছায়ায় মানুষ বাঁচতে পারে? কুচকাওয়াজ দেখতে দেখতে দেশের লোক রোগা-পাতলা হয়ে গেছে, ফ্যাকাশে মেরে গেছে, অথচ একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য আজ পর্যন্ত কেউ তাদের সামনে দিতে পারল না। যে দিতে পারত সে খুন হয়ে গেছে। কেবল ভেসে বেড়ানো, ভেসে যাওয়া, এই যদি হয় স্বাধীনতার মানে তবে তা নিয়ে অত বড়াই কিসের? এ দেশকে অমুক দিচ্ছে, ও দেশকে তমুক দিচ্ছে, একটার পর একটা বিপ্লবের বান ডাকছে, তাতে হয়েছে কি, পরনে যার ছিল ছেঁড়া গামছা, এখন সে ন্যাংটো উদোম হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। (২২)
উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে আছে ব্যঙ্গ-ক্ষোভ, বিদ্রূপ-ঠাট্টা—এরকম যাবতীয় ঝাঁঝালো কথকতা। নিজের জগতে, গৃহে, অন্তঃপুরের নিভৃতিতেও মেলে না শান্তি। বাইরের তীব্র আঁচে দগ্ধ হতে থাকে আমিনুলের সংবেদনার আবেগ-মসৃণ আবরণ। আমিনুলের আত্মভুবন আর সমকালের বহির্জগত, এই দুই প্রেক্ষাপট বিন্যস্ত হয়েছে অনেকটা চলমান নাটকের ধরনে। উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, চারপাশের অদ্ভুত এক নাট্যভুবনের বাসিন্দা আমিনুল আসলে একটা প্রহসনের বৃত্তে বন্দি। তার চোখের সামনে প্রতিনায়কদের উত্থান ঘটে নায়কত্বে এবং দেশের পরাজিত শত্রুরা মঞ্চে উপস্থিত হয়ে নিজ-নিজ শক্তি-প্রদর্শনরত। আমাদের মনে পড়ে, ১৯৮২ সালে অর্থাৎ পাতালপুরী উপন্যাস-রচনার সমান্তরালে প্রকাশিত হয়েছিল কবি শামসুর রাহমানের কাব্য উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। মাহমুদুল হকের উপন্যাস থেকে যে-উদ্ধৃতি উপরে দেওয়া গেল সেটিকে পাশে রেখে শামসুর রাহমানের কাব্যের শিরোনামটিতে দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্ট হয়, একই সমকালের চরিত্র একজন কথাশিল্পী এবং একজন কবি প্রায় একইভাবে কল্পনা করেছেন। বস্তুত মাহমুদুল হকের এ-উপন্যাসের জীবন-বাস্তবতা সমকালের উদ্ভটত্বের ভাষ্য। স্বাধীন স্বদেশে এমন সমকালীন বৈরী প্রতিবেশের অভিজ্ঞতাও মাহমুদুল হকের জন্য সেই প্রথম। উপন্যাসের যেটুকু কাহিনি সেটি বিন্যস্ত হয়েছে অনেকটা নাট্যিক ভঙ্গিতে। দরজা এখানে ব্যবহৃত হয়েছে দুটি জগতের মাঝখানে একটি বিভাজনরেখা হিসেবে। একটি জগৎ আমিনুলের নিজস্ব গৃহকোণ এবং অন্য জগৎ তার বৃহত্তর সামাজিকতার জগৎ, যেখানে সৃষ্ট তরঙ্গের প্রভাব আমিনুলের গৃহকোণ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু আমিনুলের বহির্জগতের তরঙ্গ এমন খরতর যে তার আছড়ে পড়ার প্রতিক্রিয়ায় আমিনুলের সত্তায় সৃষ্টি হয় কম্পমানতা, সেই কম্পমানতা অস্বস্তিকর এবং ক্ষেত্রবিশেষে শঙ্কাজাগানো। যখনই আমিনুলের ঘরের দরজায় করাঘাত পড়ে তখনই তা এক ধরনের নাটকীয় প্রতীক হয়ে আমিনুলের অস্তিত্বের বর্তমানতার সঙ্গে রচনা করে সংযোগ। পাঠক তখন আমিনুলের অবস্থা এবং বাইরের জগতের অবস্থা অনুভব করতে পারে। কিন্তু যেটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ, বাইরের জগৎ থেকে কোনো সুসংবাদ আমিনুলের জন্য বয়ে আসে না, আসে সব দুঃসংবাদ আর অপ্রত্যাশিত বার্তা। কখনও সে মানুষ-হত্যার সংবাদ পায়, কখনও পায় পুরোনো বন্ধুর দাম্পত্য-জটিলতার খবর। একই সঙ্গে আমিনুলের নিকটে সংবাদ আসে, তার পুরোনো বন্ধুরা প্রচণ্ড ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে সমাজে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাও তাদের বশীভূত। আমিনুলের জীবনদর্শন একটা চরম হতাশাকর পরিস্থিতি উদ্ঘাটন করে পাঠকের সামনে। পাতালপুরী উপন্যাসটি আমিনুলের চোখে দেখা নরকরূপী স্বদেশের এক অকল্পনীয় বাস্তবতার ছবি। অকল্পনীয় এই অর্থে, উপনিবেশিক প্রতিপক্ষকে পরাভূত করা বাঙালি জাতির জীবন পুনরায় ঢেকে যায় অপশক্তির ছায়ায়। আমিনুল জানে যে, ‘দেশের অবস্থা ভাল নয়’, কিন্তু সেটা তার পক্ষে মন থেকে ঘরের বাইরে গিয়েও প্রকাশ করা সম্ভব নয়, কেবল প্রেমিকা রানুকেই সে কথাটা বলতে পারে। দেশের অবস্থা ‘ভাল নয়’—আমিনুলের এমন অনুভূতির জন্ম হয় বহির্জগতের চলমানতা প্রত্যক্ষ করার ফলে। গুমখুন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, অস্ত্রবাজি, অসৎ ব্যাবসা, অপহরণ—এরকম সব জীবনবিরোধী তৎপরতা। মাহমুদুল হক স্পষ্ট ভাষায় শত্রু-প্রতিপক্ষের চরিত্রে আবির্ভূত তাঁর সমকালের দৌরাত্ম্যকে আক্রমণ করেন:
এদের মাঝে এমন কেউ নেই যে অচেনা, বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোখার অজুহাতে হিংস্রতাকে মাথার তাজ করে রেখেছিল এরাই, এই ফেরুপালের দল। গোটা জাতির অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বরাবরের মতো পেশাদারি কায়দায় তখনো এরা ধর্মের জিগির তুলে দেশের মানুষের গলায় গরুর-ছাগলের মতো ছুরি চালিয়েছে। (২৩)
সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি আক্রমণ করেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীন সামরিক স্বৈরাচারের আনুকূল্যে আর্থসামজিক প্রেক্ষাপটে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির উত্থানকে। ‘গুন্ডাপান্ডারাই এভাবে দেশের সবকিছু চালাবে?’—এমন সরাসরি প্রশ্ন করতে দ্বিধা করে না মাহমুদুল হকের উপন্যাসের চরিত্র। উপন্যাসটির ভাষাশিল্পের বিশ্লেষণকালে আমরা দেখব ভাষাকে তিনি অত্যন্ত ধারালো ভঙ্গিতে প্রয়োগ করেছেন। কখনও-কখনও তাঁর ভাষা ভব্যতার অভ্যস্ত সীমা অতিক্রম করে যায়, কিন্তু তা বাস্তবতার অস্বস্তিকর উপস্থিতির স্বরূপকেই মূর্ত করে তোলে:
ক্যান চলব না? মিনিস্টার হউরের পো বাকি রাখবার পারে, আমি পারুম না ক্যান? অহনেই তো, নাখাল পাড়ায় একজনরে হান্দায়া দিয়া আইলাম, দিছে আমারে কিছু, চ্যাটটাও ঠেকায় নাই, কয় কাউলকা আয়া মাল নয়া যায়ো। অহনে অগো হেভি কাম, যাইতে হইব ক্যান্টনমেন্টে। (২৪)
জীবন ও বাস্তবতার নিরিখে লেখা মাহমুদুল হকের যে-তিনটি উপন্যাস তাদের মাঝে একটি ঐক্য খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলো: অস্তিত্ববিরোধী প্রতিবেশের নিরালোক উদযাপন। এখানে একটি বিষয় স্মর্তব্য, তাঁর মনস্তাত্ত্বিক ধারার উপন্যাসে অনু (অনুর পাঠশালা) এবং আবদুল খালেককে (কালো বরফ) নিজেদের সত্তার টানাপোড়েনকে নিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। সেখানে ওই চরিত্রগুলোর কেন্দ্রিকতার অবস্থান থেকে দৃষ্টিক্ষেপ করা হয় বহির্জগতের দিকে। সেই বহির্জগতের একটি বৃহদংশ আবার সমকালীনতা নয়, স্মৃতিনির্ভরতা। জীবন ও বাস্তবতাধারার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে প্রমূর্ত সমকাল। সমকাল নিয়ন্ত্রণ করছে জীবনের বাস্তবতাকে। যে-জীবন সমকালের দৈনন্দিনতা পেরিয়ে মুহূর্তে অতীত হয়ে যায়, তার মধ্যে নিহিত জটিলতা আপাতদৃষ্টে দুষ্পাঠ্য মনে হলেও মাহমুদুল হক সেই দুরূহ ও দুষ্পাঠ্য জীবনের পাণ্ডুলিপি রচনা করেছেন। সমালোচকের বিশ্লেষণে:
সমাজ ও সময়ের পরিবর্তমান পরিপ্রেক্ষিত, ব্যক্তির অর্ন্তগত নৈঃসঙ্গ্যবোধ, মানবিকীকরণ, আর্থ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, বিশ্বপরিস্থিতি এবং জাতিগত ঐতিহ্য, ইতিহাসের মৌনবীথি, ইত্যাদি নানাবিধ ঘটনা ও অনুষঙ্গ ব্যক্তির যাপিত জীবনপ্রণালী ও শিল্পচিন্তাকে প্রভাবিত করে; আলোড়িত করে সংবেদশীল ব্যক্তির মনস্তত্ত্বর নির্জানস্তর, অনুরণিত হয় শিল্পীর নিমগ্ন হৃদয়লোক; শিল্পীর অর্ন্তদৃষ্টির অনিবার্য বিন্দুসংহত আকাক্ষা ও তীক্ষ্ণদৃষ্টির আধুনিক মনস্কতায় শিল্প হয়ে সুদূরচারী—মাহমুদুল হক ওই জীবনদৃষ্টি শিল্পকৃত্য থেকে বিযুক্ত ছিলেন না। তাঁর গল্প ও উপন্যাস ওই সুদূরস্বপ্নচারিতা ও শিল্প সৌরলোকে যাত্রা। বিষয়-নির্বাচন, কাহিনিসংগ্রন্থনা, ভাষাবিন্যাস—প্রতিটি পর্ব ও পর্বান্তরে সমাজ, পরিপার্শ্ব ও সময়সংলগ্ন হয়েও মাহমুদুল হক কথাসাহিত্যে নির্মাণ করেছেন এসবের অন্তরালে সংগুপ্ত মানবিক, নির্বেদ ও জীবনের প্রতি অন্তর্লীন প্রেমানুভব। ব্যক্তিমানুষের প্রতি এই দায়বোধ ও মানবিক আশ্রয় সন্ধানের শিল্পকৃতির জন্যেই তাঁর রচনা আমাদের আহ্বান করে অবিনাশী আয়োজনের দিকে। এই সূত্রে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে মৌলিক ও শাশ্বত ধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। (২৫)
এক অন্ধকারের বৃত্ত (নিরাপদ তন্দ্রা) থেকে আরেক অন্ধকারের বৃত্তের (পাতালপুরী) দিকে তাঁর যাত্রা। হিরনের স্বপ্নভঙ্গ থেকে আমিনুলের দুঃস্বপ্নতাড়িত জীবনের দিকে যাওয়ার পথে একের পর এক উন্মোচিত হতে থাকে জীবনের ক্লেদ-গ্লানি আর যন্ত্রণার অভিজ্ঞান। মনস্তাত্ত্বিক ধারার ঘোরলাগা আবহ থেকে এমন রূঢ় অনুভবের অভিমুখ প্রকৃত পক্ষে মাহমুদুল হকের জীবননিষ্ঠার স্বাক্ষর। কেবল কাহিনি বর্ণনার পরিচিত পথে ভ্রমণ করেন না তিনি। তাঁর চরিত্রগুলোকে অত্যন্ত সচেতন উপায়ে জীবনোপলব্ধির ভিত্তিভূমিতে দাঁড় করিয়ে তিনি জীবনের বহুতল স্বরূপকে আবিষ্কার করেন। হিরন, জয়নাল, আমিনুল—এসব চরিত্র তাই আদর্শবাদিতার স্পর্শমুক্ত থেকে যায়। বাস্তব জীবনে চরিত্রগুলো যেমন-যেমন থাকে, ঔপন্যাসিক তাদেরকে ঠিক সেভাবেই গড়ার চেষ্টা করেছেন। তাদেরকে আশ্রয় করে সমকালীন জীবনের যে-জটিল গ্রন্থি পত্রেপুষ্পে বেড়ে ওঠে তার নানা মাত্রা মাহমুদুল হকের শব্দকুশলতায় ধরা পড়ে। তাই হিরনের জীবনের কথকতায় শহরের বস্তিজীবনের একেবারে ভেতরের চিত্র আমরা পাই। জয়নালের তৎপরতায় উদ্ঘাটিত হয় গ্রামীণ জীবনের গভীরে নিহিত প্রকৃত বাস্তব এবং পাতালপুরী-র আমিনুল চরিত্রটি হিরন আর জয়নালের বাস্তবতার মধ্যে সংযোগসেতু হয়ে আসে, কেননা আমিনুলের মধ্যেই আমরা দেখতে পাই তিনটি উপন্যাসের এক দশককালের সমন্বয়ে গড়া মানববিরোধী পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ-ক্রোধের সূচনা। মাহমুদুল হকের তিনটি উপন্যাসের অস্তিত্ববিরোধী প্রতিবেশ আমিনুল তথা লেখকের জীবনদর্শনের ধরা দিয়েছে স্পষ্টভাবে। ফলে আমিনুলের প্রকাশ অনেকটাই সরাসরি। সে তার অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়ার সবটাই জানান দেয় প্রতীকতামুক্ত পরিষ্কার ভাষায়। আমিনুল এমন একটা সময় ও প্রতিবেশে নিজের সত্তার সক্রিয়তাকে প্রকাশ করে যে-সময়টা সবদিক থেকে ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। এখানেই মাহমুদুল হক তাঁর উপন্যাসশিল্পকে সচেতন সৃজনশীল শিল্পীর অঙ্গীকারের মাধ্যমে পরিণত করতে সক্ষম হন। তাঁর উপন্যাসে জীবনের বাস্তবতার স্বতন্ত্র প্রকাশ সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের মন্তব্য স্মরণযোগ্য:
ষাটের দশকে প্রচলিত সাহিত্যধারা এড়িয়ে একান্ত নিজস্ব অভিনবত্বে জীবনের অন্তর্বাস্তবতা ও বহির্বাস্তবতার এমন শিল্পিত ভাষার বলিষ্ঠ প্রকাশ আমাদের আধুনিক সাহিত্যে প্রথম ঘটালেন মাহমুদুল হক। এ কোনো প্রয়াসলব্ধ বা চেষ্টাপ্রসূত ছিল না। ছিল লেখকের অন্ত-উৎসারিত নিজস্ব আবেগছোঁয়া এক আশ্চর্য বাস্তবতারই প্রকাশ। জীবনের কঠিন বাস্তবতা এবং শিল্পের এমন দক্ষ সম্মিলনে খুব কম লেখকই সম্পূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন। (২৬)
তাঁর প্রথম দিককার এবং তাঁর মনস্তাত্ত্বিক ধারার উপন্যাসগুলোতে তাঁকে অনেকটাই জীবননির্মোহ বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। জীবনের জটিল অন্ধিসন্ধিতে অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে বাস্তবের নানা তল উপলব্ধির বিষয় সেসব উপন্যাসের নয়। কিন্তু জীবন ও বাস্তবতার পারস্পরিকতায় মাহমুদুল হকের চরিত্ররা নিষ্ক্রিয়তামুক্ত এবং সত্তার অবস্থানের জানান নিয়ে আসে তারা। তাই মাহমুদুল হকের উপন্যাসকে আর নৈর্ব্যক্তিক বা বিমূর্ত বাস্তবতার চিত্র বলা চলে না। তাঁর জীবন ও বাস্তবতার আন্তঃক্রিয়া কেবল তাঁর নিজের উপন্যাসের ধারায়ই নয়, বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারায়ও একটি স্বতন্ত্র পথ সৃষ্টি করেছে। সমকালীন জীবনকে নিয়ে এমন তীক্ষ্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ উপন্যাস রচনা করে তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লেখক বা সৃজনশীল শিল্পীসত্তার দায়বোধকেও স্মরণ করিয়ে দেন।
তথ্যনির্দেশ
১. শহীদ ইকবাল, ‘আমাদের সাহিত্য—নেপথ্যের নৈর্বক্তিকতা’, কালান্তরের উক্তি ও উপলব্ধি, চিহ্ন, রাজশাহী, ২০০৩, পৃ. ১২১-১২২
২. অনুপম সেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজ (ঢাকা: অবসর, ১৯৯৯), পৃ. ৮-৯
৩. পূর্বোক্ত পৃ. ১৬
৪. মাহমুদুল হক, নিরাপদ তন্দ্রা (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ২০০০), পৃ. ৯
৫. মাহমুদুল হক, নিরাপদ তন্দ্রা, পৃ. ২৮
৬. সুমন্ত ব্যানার্জি, ডেঞ্জারাস আউটকাস্ট: দ্য প্রস্টিটিউট ইন নাইনটিস্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল (কলকাতা: ২০০০), পৃ. ৪-৬
৭. মাহমুদুল হক, নিরাপদ তন্দ্রা, পৃ. ৩৯
৮ ‘One day everything becomes a story’, The Daily Star, 2 August, 2008
৯. মাহমুদুল হক, নিরাপদ তন্দ্রা, পৃ. ২৮
১০. পূর্বোক্ত পৃ. ১৩১
১১. একটি রথ, একটি হাতি, পাঁচজন পদাতিক ও তিনটি ঘোড়ায় এক পত্তি। তিন পত্তিতে এক সেনামুখ হয়। তিন সেনামুখে এক গুল্য। তিন গুলো এক গণ। তিন গণে এক বাহিনী। তিন বাহিনীতে এক পূতনা। তিন পূতনায় এক চমু। তিন চমুতে এক অনীতিনী। উনিশ অনীকিনীতে এক অক্ষৌহিণী হয়। পৌরাণিক ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৮২ (উইকিসংকলন https://bnwiksource.org/wiki>182)
১২. মাহমুদুল হক, নিরাপদ তন্দ্রা, পৃ. ২৯
১৩. পূর্বোক্ত পৃ. ১২৬
১৪. পূর্বোক্ত পৃ. ১১২
১৫. পূর্বোক্ত পৃ. ১১৩
১৬. পূর্বোক্ত পৃ. ১১৩
১৭. নলিনী বেড়া, ‘মাটির জাহাজ মাটির জাহাজই বটে’, গল্পকথা, মাহমুদুল হক সংখ্যা, ঢাকা, ৪র্থ বর্ষ, সংখ্যা ৫, ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ. ২৩৭
১৮. মাহমুদুল হক, মাটির জাহাজ (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৬), পৃ. ১৫
১৯. চঞ্চল কুমার বোস, ‘মাটির জাহাজ: দাহকাল ও দেহদাসীর সহজিয়া’, গল্পকথা, মাহমুদুল হক সংখ্যা, ঢাকা, ৪র্থ বর্ষ, সংখ্যা ৫, ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ. ২৪০
২০. মাহমুদুল হক, মাটির জাহাজ, পৃ. ৫০
২১. পূর্বোক্ত পৃ. ৭১.
২২. মাহমুদুল হক, পাতালপুরী (ঢাকা। সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৯), পৃ. ১৫, ১৭
২৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫
২৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২
২৫. আবু হেনা মোস্তফা এনাম, ‘জীবনবোধ ও সাহিত্যবৈশিষ্ট্য’, কথাশিল্পী মাহমুদুল হক (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০১৬), পৃ. ১৪১
২৬. রিজিয়া রহমান, ‘একজন নির্জন কথাশিল্পীর নিভৃত প্রস্থান’, আলোছায়ার যুগলবন্দি (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ২০১০), পৃ. ২০