চলে গেলেন কবি ও কথাশিল্পী কাশীনাথ রায়

সৈয়দ কামরুল হাসান
Published : 17 Jan 2021, 04:15 PM
Updated : 17 Jan 2021, 04:15 PM


চলে গেলেন কাশীনাথ রায়, আজই সকালবেলা। বেশ কদিন থেকেই তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবশেষে হাসপাতালের শয্যা ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই নিবেদিতপ্রাণ সাবেক শিক্ষক,ষাট ও সত্তর দশকের নিভৃতচারী কবি এবং 'মেমসাহেবের পা'-সহ আরো কয়েকটি কালজয়ী গল্পের স্রষ্ট্রা। সর্বসাকুল্যে প্রকাশিত ৩টি মাত্র বই তাঁর – ২টি কাব্যগ্রন্থ , অপরটি ডিভাইন কমেডির অনুবাদ। গল্পগুলি অগ্রন্থিত, এছাড়াও লিখেছিলেন সাহিত্যবিষয়ক মননশীল কিছু নিবন্ধ, এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে স্বাদু গদ্যের আরো কয়েকটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক গদ্য। সবই পেছনে পড়ে রইলো। পেছনে পড়ে থাকলো তাঁর স্বল্প ক'জন স্বজন পরিজন, প্রাক্তন ছাত্র, গুনগ্রাহী আর একমাত্র পুত্র তাঁর গৌরবময় উত্তরাধিকার-বুয়েটের অধ্যাপক অপ্রতিম রায়। না,তাঁর মৃত্যুসংবাদে কোন তোলপাড় হয়নি। সামাজিক গণমাধ্যমসূত্রে তাঁর প্রিয় ছাত্র কবি, প্রাবন্ধিক গোলাম ফারুক খানের একটি স্ট্যাটাসে তাঁর মৃত্যুসংবাদ দেখে চটজলদি আমাদের কয়েকটি সংবাদপত্রের অন-লাইন সংস্করণ ও আরো কয়েকটি দর্শকপ্রিয় টিভি চ্যানেলের স্ক্রলে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলাম। না,কাশীনাথ রায় নামে কেউই পৃথিবী ছেড়ে যাননি কিংবা গেলেও আমাদের জীবনবৃত্তে কোন শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি। সে-কথা যেন একরকম জানাই ছিলো দিব্যদ্রষ্টা কবির। তা নাহলে তিনি কেন লিখলেন – " — আমার অন্য কোনো পুণ্য নেই।/ কোনো দিব্যধাম প্রতিশ্রুতি দেবেনা আমাকে।/এ সংসার যেমন মানুষ পেলে খুশি হয়, যেমন মানুষ/চলে গেলে মধ্যদিনে নামে রাত, তেমন তো কেউ/নই আমি —– " ['যেদিন পড়বে না মোর '] । কিন্তু কবি বলেই জীবন ও প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য বন্ধন তাঁকে হতাশা থেকে ফিরিয়ে এনেছে বারবার,স্বগত সংলাপে আশ্বাসে স্থিত হয়েছে কবির আত্মা। লিখেছেন তিনি: "কিছুই না থাকে যদি তবে/ভীষণ নীরবে/থাকে এই সাদাসিধে মাটি,/থাকে পরিপাটি / শোক-দুঃখ থরে থরে সাজানো আকাশ/ যত ক্লান্ত হোক তবু থাকে / কড়া-নাড়া সহজ বাতাস,/নদীতে নদীতে ফেরা ক্ষীণকণ্ঠ জল।/ পাকে দুর্বিপাকে/ চিরকাল জেগে-থাকা এমন বিরল/বন্ধন কোথায় পাব আমি !"
বাংলা গল্পে কাশীনাথ রায় যেন জ্যেতিরিন্দ্র নন্দীর উত্তরসাধক । ১৯৬৪ সালে রচিত তাঁর 'রূপান্তর' গল্পে দেখি নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের দিনযাপনের গ্লানি ও দৈন্য কী অপরিসীম দক্ষতায় তুলে এনেছেন তিনি । পাঠকমাত্রই লক্ষ্য করবেন গল্পবয়নে তাঁর অসাধারণ সংযম ও সক্ষমতা, যা কিনা একজন তরুণ গল্পকারের ক্ষেত্রে প্রায়শ লক্ষণীয় – আবেগের প্রাবল্য ও অস্থিরতা – গল্প রচনার শৈশব থেকেই একজন জাত লেখকের মত তিনি পরিহার করেছেন। যা আরো অনেক বেশি পরিশীলিত ও পরিণত শিল্পে রূপ পেয়েছে ১৯৭৭ সালে রচিত তাঁর 'মেমসাহেবের পা' গল্পে। পূর্বোক্ত জ্যেতিরিন্দ্র নন্দীর গল্প-বলয় থেকে বেরিয়ে এখানে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর নিজস্ব ভুবনে। দীর্ঘ গল্পটি সেকালের বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা 'নিরন্তরে' ছাপা হয়েছিলো। [ নিরন্তর প্রকাশনার সাথে কাশীনাথ রায় নিজেও জড়িত ছিলেন ।] ছাপা হওয়ার পর গল্পটি নিয়ে বোদ্ধা পাঠকমহলে সাড়া পড়েছিলো । মজবুত গাঁথুনী ও সনাতন কাঠামোর মধ্যে এই গল্পে লেখক সমকালীন সমাজ,রাজনীতি,উচ্চকোটির এক অধ্যাপক পরিবার ও তার প্রেক্ষাপটে একজন গৃহকর্মীর জীবনের বিকাশ, বেদনা ও প্রতিবাদ যে মুনশীয়ানায় তুলে এনেছেন তার তুলনা সমসাময়িককালে বিরল।

কাশীনাথ রায়ের এইসব সুলিখিত রচনা-গল্প কি কবিতা নিয়ে কখনো কোথাও তেমন আলোচনা হয়নি – বড় কোন সমালোচক লিখেননি তাঁকে নিয়ে, তাঁকে নিয়ে আগ্রহ দেখাননি কোন প্রকাশক, এমনকি লেখকদের কাছেও তিনি অনেকখানি অচেনা। তাঁর কোন সাক্ষাৎকার কেউ দেখেননি কোথাও। প্রচারমাধ্যমের এ-যুগে যখন সব সাফল্য, সকল অধরা মাধুরী প্রচারকুশলতার কাছে জিম্মি – তখন পাদপ্রদীপ থেকে কাশীনাথ রায়ের এই স্বেচ্ছা প্রস্থান আমাদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় বৈকি। অথচ তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা পড়ে জানা যায় সজ্ঞানে তিনি বেছে নিয়েছিলেন এই নির্বাসিত জীবন। তাতে ছিলো একজন নির্মোহ সন্তের নিষ্ঠা আর আজন্ম-শুদ্ধাচারী এক শিক্ষকের নিষ্ঠা। সে-দেয়াল ভেদ করা কারুর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ২০০৮ সালে তাঁর লেখা "নিভৃতচারী শিক্ষকের সন্ধানে" নিবন্ধে তার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। নিবন্ধের দুটি স্তবক এখানে তুলে ধরছি:
" আমি যে বিসদৃশ তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমার সমাজের যে কারো বিচারেই আমি যে অক্ষম,তাতেও কোনো সন্দেহ নেই আমার। আমি যে কর্তব্যজ্ঞানহীন,সে-শুধু আমার দুএকজন বন্ধুবৎসল সহকর্মী নয়,আমার পরিবার,আমার স্ত্রী এবং খুব সম্ভব আমার পুত্রও সে-কথাই বলবে। অভিযুক্ত হলে,আমি তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবো না । কোনো দিন করিনি,জনসমক্ষে তো নয়ই । করিনি,কারণ বিসদৃশ,অক্ষম,কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের যা প্রাপ্য,আমি এ যাবতকাল তা-ই পেয়েছি।
আমি কি খুব পর্যুদস্ত তাতে? না। খুব বেশি অপমানিত বোধ করি আমি? না। কারণ,আমার নিজের কাছে আমার মাথাটা হেঁট হয়নি কখনো । আমার বিশ্বাসের কাছে আমার আচরিত জীবনের কোনো বড়োসড়ো বিরোধ নেই। অন্যেরা আমাকে অবজ্ঞা,অনুকম্পা,অশ্রদ্ধা যাই করুক,আমি আমাকে শ্রদ্ধা করি। পাঠশালার অঙ্কের মাষ্টার মশাইর মতো শুদ্ধ হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু তাঁর মতো হবার স্বপ্নটা আমার বুকের ভেতর আজো বেঁচে আছে। বেঁচে থাকবে।"
আপন আত্মায় লালিত শুদ্ধতার এই অঙ্গীকার যে কোন 'হঠাৎ হাওয়ায় উড়ে আসা ধন'নয় , তার শেকড় যে প্রোথিত তাঁর জন্মভিটায়, সে আশীর্বাদ যে তাঁর জন্মক্ষণে পাওয়া, সে-কথা ব্যাকুল আনন্দে ব্যক্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়ও: যদি ভুলে যাই/মনে করিয়ে দিয়ো/চলনবিলের ইচ্ছাপুর গ্রামে জন্মেছিলাম আমি/আমার সারা গায়ে পলির গন্ধ ছিল/উঠানের বাইরে প্রথম পা রাখি যেদিন/পূব থেকে পশ্চিম/উত্তর থেকে দক্ষিণ/সবদিক থেকে উঠে এসে হাততালি দিয়েছিল গোটা আকাশ/আর রাতের বেলা সেই আকাশকে ছুঁতে গিয়ে/প্রথম হাত তুলেছি যেদিন/একটি নয়/দুটি নয়/হাজার হাজার উল্লসিত তারা/আমার কপাল ছুঁয়ে বলেছিল/বেঁচে থাক বাবা । [ যদি ভুলে যাই, 'জীবনানন্দ দেখুন ।]


এই শুদ্ধাচারী কবি-গল্পকার-শিক্ষকের যাবতীয় রচনা সম্পাদনা করে সমগ্র প্রকাশ একান্তই বাঞ্চিত। কিন্তু কার গোয়াল কে দেবে ধুঁয়া! কেবলমাত্র অতিসম্প্রতি, করোনা অতিমারীর দুঃসময়ে, 'খেয়া' নামের ঢাকার একটি ছোট কাগজের সম্পাদক -পুলক হাসান 'কবি কাশীনাথ রায়' সংখ্যা প্রকাশ করে এই বিস্মৃতপ্রায় লেখককে তুলে আনার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। এতে অন্তত লেখক ও শিক্ষক কাশীনাথ রায়ের জীবন ও কীর্তি একেবারে সমূহ অবলোপনের হাত থেকে বেঁচে গেলো । কিন্তু তা কি যথেষ্ট ? আজ তাঁর প্রয়ান দিবসে আমার মন বিষন্ন ডানা মেলে কলাভবনের দিকে উড়াল দিয়েছে। আহা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বের দিনগুলি! আমার বিভাগের ঠিক উপরতলায় (দোতলায়) ইংরেজি বিভাগ । ইংরেজি আমার সাবসিডিয়ারি ছিল। কাশীনাথ রায় আমাদের 'ওথেলো' পড়াতেন। একে তো সাবসিডিয়ারি, তার উপর ২টার পর ক্লাস – ছাত্র-ছাত্রী থাকতোই না বলা যায়। কিন্তু অবধারিতভাবে স্যার ক্লাস নিতে আসতেন আর উপস্থিত হতাম আমরা ক'জন ওথেলো ও কাশীনাথ অনুরাগী শিক্ষার্থী। আমি এক দিনও তাঁর ক্লাস মিস করিনি। মনে পড়ছে সেই অনতিউচ্চ অবয়বের,স্পষ্ট অথচ নমিত কণ্ঠস্বর, সাধারণের তুলনায় একটু বেশি ফর্শা, শুভ্র পরিচ্ছদের কাশীনাথ স্যারকে। তাঁর চির অন্তর্ধানের এই সংবাদে কলাভবনে সেই ঝলমলে দুপুরের ক্লাসে আজ যেন বিষন্ন অস্তরাগের ছোঁয়া। ডানা গুটিয়ে নিয়ে বলি,স্যার যেখানে গেছেন,সেখানে ভালো থাকুন,চির আনন্দে থাকুন।
১৭-০১-২০২১/ঢাকা