“প্রদীপ নিবিয়া গেল” – অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ ও তাঁর সময়

ফারসীমমান্নানমোহাম্মদী
Published : 27 Oct 2021, 07:12 PM
Updated : 27 Oct 2021, 07:12 PM


আমি তখন মাঝ-দরিয়ায়, পদ্মা নদী পার হচ্ছি। ২০১১/১২'র কোনো এক শেষ-অপরাহ্ন হবে। নদীর হাওয়া উপভোগ করছি। এমন সময়ে ফোন এলো। দেখি প্রিয় হারুন স্যার ফোন করেছেন। সশব্যস্ত হয়ে ফোন ধরলাম,
'স্যার স্লামালেকুম'
'ইমন [আমার ডাকনাম] কেমন আছ?'
'স্যার ভাল।'
'আমি তোমার বইখানা পড়ছিলাম, আমাদের বইখানা'।
যে বইটির কথা স্যার বলছেন, আমি বুঝতে পারলাম, সেটি অপূর্ব এই মহাবিশ্ব বইখানা প্রথমা প্রকাশন প্রকাশ করেছিল ২০১১ সালে। এটি স্যারের সাথে আমার যৌথ লেখনি। বইটির বিষয় সাধারণভাবে কসমোলজি বা বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব। আমি অপেক্ষা করছিলাম, স্যার আর কী বলেন, শোনার জন্য।
'খুব সুন্দর হয়েছে, ইমন, খুব সুন্দর। আমি খুব খুশি হয়েছি। গুড জব।'
'জ্বী স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার'।
এই শংসা-বচনের পর আর কোনো কথা থাকে না, স্যার ফোনটা ছেড়ে দিলেন। আমি পুরো সন্ধ্যাটা মুহ্যমান থাকলাম। হারুন স্যারের কাছ থেকে এই প্রশংসা শুনবার পরম সোভাগ্য হয়েছিল। সেই সময়টায় যে-আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল, তা ভুলবার নয়। এই তুরীয়ানন্দের এক ইতিহাস আছে।

বিজ্ঞানের প্রতি, বিজ্ঞানের সাহিত্যের প্রতি আমার আগ্রহ স্কুল জীবন থেকেই ছিল। বিশেষ করে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরপর এসবের দিকে আমি বেশ ঝুঁকে পড়েছিলাম। বিজ্ঞানের বই গোগ্রাসে পড়তাম। হারুন স্যারের লেখালেখির সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছিলাম। তাঁর লেখা উপমহাদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব, মৌলিক কণা এসব বই আমার হাতে এসেছে। এই তিনটি বই নব্বইয়ের দশকে বিজ্ঞানের তিনটি আকর গ্রন্থ ছিল নিঃসন্দেহে। মনে রাখতে হবে, সে যুগ ইন্টারনেট-পূর্ববর্তী যুগ, সে যুগে কোনো গুগল ছিলনা, উইকি ছিলনা, এবং আজকের দিনের মত অত বিজ্ঞানের বইও ছিল না। আমার প্রথম ছাত্র, সে ছিল সপ্তম/অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তাকে আমি হারুন স্যারের বই থেকে দেদারসে গল্প বলতাম। পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব – বইটি আমার প্রায়-ঠোঁটস্থ ছিল। কী অসাধারণ গদ্য, কী উত্তেজনা আর কী বর্ণনা! যাঁরা সেইসময়ের ছাত্র-ছাত্রী আছেন, তাঁরাই সেই উত্তেজনা টের পাবেন। অনেক পরে ২০১৫ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ জাহিদ হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতাতে অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদের উপস্থিতিতেই জানাবেন পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব বইটির বৈপ্লবিক তাৎপর্য। এহেন পদার্থবিদ হারুন স্যারকে সামনে থেকে দেখব, পদার্থবিজ্ঞান পড়ব, হকিঙের মত বড় হব ইত্যাদি নানাবিধ কৈশোরসুলভ স্বপ্ন আমাদের ছিল। এইসব স্বপ্নে চোখ রাঙিয়ে আমরা কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলাম। ঢাকায় তখন জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা করার মত মানুষজন ছিলেন গুটিকয়েক – ছিল দুটি পত্রিকা মাত্র – 'আকাশ-তথ্য' এবং 'মহাকাশ বার্তা'। মহাকাশ-বার্তা গোষ্ঠীর আয়োজনে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাথমিক কর্মশালা আয়োজিত হত তখনকার ব্যান্সডকের মিলনায়তনে, সেটা তখন ছিল সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের এখনকার বিসিএসআইআর-এর দোতলায়। একদম মোড়ের উপর ভবন, রাস্তার পূর্বপাশে, বাস থেকে নেমেই রাস্তা পেরিয়ে চলে যাওয়া যেত। ওখানে ক্লাস নিতে আসতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই – গণিতিবিদ প্রফেসর রমজান আলী সরদার এবং পদার্থবিদ প্রফেসর এ আর খান, বুয়েটের প্রফেসর আলী আসগর, স্পার্সো'র প্রফেসর জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও এম এম চৌধুরী এবং অন্যান্য। আমার মনে আছে, সেইসময়কার কর্মশালা করছিলেন এমনদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার উজ্জ্বল ছাত্র ইশতিয়াক মুরতাজা তারীন। তারীন ভাই বুয়েটের কম্পিউটার কৌশলের বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন, কিন্তু বিষয় ভাল না লাগায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় গিয়ে ভর্তি হন বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে। এ কাজে হারুন স্যার ছিলেন অন্যতম প্রধান কুশীলব। আমরা সবিস্ময়ে দেখতাম, তারীন ভাইয়ের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বইখানি কীভাবে বাংলা কবিতায় ঠাঁসা হয়ে রয়েছে, এবং আমাদের তরুণ বয়সের নায়ক ইশতিয়াক তারীন কীভাবে কবিতার রাজ্যে নিজেকে মুহ্যমান রেখেছেন। আমরা তাঁকেই হারুন স্যারের প্রতিভূ হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছিলাম, যদিও।

এই কর্মশালা করতে করতেই , ১৯৯৩ সালে, আমি স্টিফেন হকিঙ লুকাসিয়ান প্রফেসরশিপ গ্রহণের প্রাক্কালে যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন, সেটি অনুবাদ করে ফেলি। বক্তৃতাটি বেশ বড়, সেই সাথে পদার্থবিদ্যার জটিল শব্দগুলির টীকা সমেত সে পুরো অনুবাদটি অধ্যাপক এ আর খান তিনদিন খুব ধৈর্য নিয়ে সংশোধন করে দিয়েছিলেন। পরে সেটি বাংলা একাডেমি বিজ্ঞান পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তখন তিনিই বলতেন, তোমার এত এত বাংলা তুমি হারুন সাহেবকে দেখালে পারতে। কিন্তু আমি তো তখনো বাংলাদেশের বিজ্ঞানের সেই প্রমিথিউসকে চিনি না!

পরে অবশ্য এই কর্মশালাতেই ১৯৯৪ সালে হারুন স্যারকে নিয়ে আসা হয়, এবং সেই প্রথম আমি স্যারকে চাক্ষুষ দেখি এবং তাঁর বক্তৃতা শুনি। সেইদিনের কর্মশালা শেষে স্যার শ্যামলীতে বাড়ি যাবার জন্য সায়েন্স ল্যাব বাসস্ট্যান্ড থেকে পাবলিক বাসে চড়ে শ্যামলী অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সঙ্গে ছিলাম, যথারীতি, আমি এবং সৈয়দ আশফাক নন্তু। এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়! আমিও যাব মিরপুর, ফলে একই বাসেই যাব। স্যারের সাথে সেদিন বহু কথা হয়েছিল, মূলত কথা বলছিলাম আমরা, ফল্গু স্রোতের মত প্রশ্ন করছিলাম, কারণ পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব ততদিনে আমাদের ঠোঁটস্থ। স্যার ধীরে ধীরে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন, 'এই যে জে-আই-জে ইকুয়াল যিরো, এটা জেনারেল কনভার্জেন্স, তারপর … ' [আমার নোটেশন ভুল হতে পারে, বহু আগের দিনের স্মৃতি যেহেতু, পদার্থবিদরা ক্ষমা করবেন]। কোনো বিরক্তি ছিল না। শ্যামলী বাস স্ট্যান্ডে স্যার নেমে গেলেন। সেই সুযোগে আমি স্যারের বাসার ঠিকানা যোগাড় করে নিলাম, যাতে ভবিষ্যতে যাওয়া যায়। তখন স্যার থাকতেন, শ্যামলী আদাবরের একটি চমৎকার ছায়াঢাকা গাছ-ঘেরা দোতলা বাসায়। সম্ভবত বায়তুল আমান মসজিদের কাছেই। বাড়িটির দোতলায় থাকতেন আমাদের বুয়েটের তড়িৎ কৌশলের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ জহুরুল হক। তবে তাঁর সাথে আমার পরিচয় ছিল না। কিন্তু সেই যে হারুন স্যারের বাসায় যাওয়া শুরু হল, শেষ হল ২০১৬'র দিকে এসে।


আলোকচিত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক এ এম হারুন-অর-রশীদ। বাঁ থেকে রাজু আলাউদ্দিন, প্রফেসর আরশাদ মোমেন, গাজী নাসিরুদ্দিন খোকন, হারুন স্যার, লেখক, ড দীপেন ভট্টাচার্য, এবং বিজ্ঞান-বক্তা আসিফ।
শ্যামলীর পর স্যারের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। তখন বিভাগের মূল কার্যালয় ছিল কার্জন হল লাগোয়া ফিজিক্স এ্যনেক্স বিল্ডিং-এ। তিনতলা ভবনটি সহজেই দোয়েল চত্ত্বর থেকে দেখা যায়। স্যারের সাথে দেখা করার জন্য বুয়েটের ক্লাস শেষে দুপুরের দিকে চলে যেতাম। তিন-তলার একদম পূর্ব-পাশের বোস প্রফেসরের কক্ষটি ছিল স্যারের জন্য বরাদ্দ। বহু মধ্যাহ্ন কেটেছে আমার স্যারের সাক্ষাৎ প্রত্যাশায়, করিডর দিয়ে হেঁটে গেছি স্যার ফ্রি আছেন কিনা দেখার জন্য। ছাত্র-ছাত্রী বা বড় স্যারেরা ঢুকছেন বেরুচ্ছেন, যদি সুযোগ মেলে স্যারের সাথে কিছু কথা বলার। কথা তেমন কিছু না, কেবল সাক্ষাৎ, যেন দয়িতের সাথে কিছু মুহূর্ত কাটাবার যাচনা! ভবনটির তিনতলার পাশে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন যে খোলা সিড়িটি আছে তাতে অনেক সময়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ইউনিভার্সিটির ছেলেরা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাত, কোন পাড়ার ছেলে এটা – এই ভেবে, নিশ্চয় কোনো মেয়ের সাথে দেখা করার জন্য এখানে ঘুরঘুর করছে। কে বলবে, তখন আমরা ফিজিক্সের জন্য এইরকম প্রণয়াকাঙ্ক্ষী ছিলাম!

হারুন স্যার শ্যামলী ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন ৭৭ পুরানা পল্টনে বিজয়নগর গাবতলা মসজিদের কাছের তিন তলা পৈত্রিক ভবনে। শ্যামলীর বাসাতে স্যারের জন্য একটা ছোট স্টাডি রুম ছিল, কিন্তু পল্টনে সেটা দেখিনি। সে বাড়িতে যেতে এবং স্যারের সাথে গল্প করতে খুব আনন্দ পেতাম। যাবার আগে ফোন দিতাম, স্যার আসব? স্যার গম্ভীর কণ্ঠে বলতেন, আস। যেন, আবার জিজ্ঞেস করা কেন, গেলেই তো হয়! পল্টনে গেলেই প্রীতম ভবনে সাহিত্য প্রকাশের দোকানে ঢু মারা যেত ভাল বইয়ের সন্ধানে। অনেক দিন স্যার ছিলেন সে বাসায়। পরে বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে সে-বাসা ত্যাগ করে আবারো স্যার পরিযায়ী হলেন, এবার ধানমণ্ডিতে ৪/এ সড়কে, সুধা সদনের বরাবর রাস্তায়। এখানেই স্যারের অন্তিম সময়টুকু কেটেছে। যে তিনটি ভবনে আমি স্যারকে দেখেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি সবচেয়ে খুশী ছিলেন শ্যামলীতে, যদিও সেটা বেশ দূরে। আর ধানমণ্ডিতে তিনি সাধুসঙ্গ বেশ উপভোগ করেছেন, কেননা তাঁর বয়স্য মানুষেরা সবাইই ধানমণ্ডীর আশেপাশেই থাকতেন – অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ডঃ নুরুল হক, অধ্যাপক শমসের আলী প্রমুখ। স্যারের বসার ঘরের বই ঘেরা আলমিরায় সেই ভারী গন্ধটা আমার এখনো মনে আছে!

হারুন স্যারের সাথে রয়েছে আমার ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপচারিতার স্মৃতি। কত কিছু যে আমি শিখেছি স্যারের কাছ থেকে, তার শেষ নেই। তিনি ছিলেন আমার সার্বিক মেন্টর। জীবন, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, পদার্থবিদ্যা, গবেষণা, এবং সর্বোপরি কসমোলজি। 'বাঙালি মুসলমান' নামের এই শব্দবন্ধটি তাঁর কাছ থেকেই প্রথম শোনা। যখন সমাজ কোনো উচ্চতর চিন্তার মূল্য দিতে ব্যর্থ হত, তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বলতেন, 'বাঙালি মুসলমানের দ্বারা এটা বোঝা সম্ভব না'। জ্ঞানের রাজনীতি, বিজ্ঞানের রাজনীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি নিয়েও তিনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। অনেক সময়ে পরোক্ষে ইঙ্গিত দিতেন, যা পরে বুঝতে পেরেছি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শিক্ষক সমিতির পদাপ্রার্থী হয়েছি। সত্যি বলতে কি, কোনো এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতির কক্ষে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে ভূতপূর্ব সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নামের তালিকায় হারুন স্যারের নাম দেখে আমিও লোভী হয়েছিলাম – নিশ্চয় আমিও স্যারের মতোনই অমন প্রাজ্ঞ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে লাগব। ধন্য আশা কুহকিনী!


আলোকচিত্র: অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদের বইসমূহের আংশিক সংগ্রহ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞানের হারকিউলিয়াস
হারুন স্যার আমাদের সবার মাঝে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন বাংলায় লেখা তাঁর অনবদ্য গ্রন্থগুলির কারণে। অধ্যাপক হারুন শুধু একজন আন্তর্জাতিক মানের পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বহু বাংলা বইয়ের লেখক, গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকটি পাঠ্যবই এবং রেফারেন্স বইয়ের লেখক যার অনেকগুলোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করেছে। ইংরেজিতে হারুন স্যারের ছিল অসামান্য দখল। তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই ইংরেজিতে চৌকশ, তিনি সেইকালে ইংরেজিতে লেটার মার্ক পেয়েছিলেন, ভাবা যায়!

ইংরেজিতে রচিত তাঁর সবচেয়ে জরুরি গ্রন্থখানি হল কোয়ান্টাম মেকানিক্স (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশন সংস্থা, ১৯৮৮)। বইটির একটি দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় প্রায় ষোল বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই, ২০০৪ সালে। বইটি চমৎকার ইংরেজিতে লিখিত এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির পাঠ্য। বইটি খুবই চমৎকার – ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু, জরুরি গণিতটুকু ছুঁইয়ে যাওয়া হয়েছে, এবং অবশ্যই তাতে সময়মত যুক্ত হয়েছে লেখকের নিজস্ব বয়ান-ভাবনা, টুকরো এনেকডোট, এবং দার্শনিক অবস্থান। ১৯৬৮ সালে ট্রিয়েস্টে থাকাকালীন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গোড়ার ইতিহাস বিষয়ে ডিরাক এবং হাইজেনবার্গের সরাসরি বক্তৃতা শোনার সোভাগ্য হয়েছিল, সেই থেকেই তাঁর মনে হয়েছিল এই বিষয়ক একটি পাঠ্যবই তিনি লিখবেন। খুব সুন্দর একটি পাঠ্যবই তিনি লিখলেনও, কিন্তু সেটা যদি বিদেশি কোনো প্রকাশন সংস্থা প্রকাশ করত, তবে সেটার অঙ্গ-সৌষ্ঠব কতই না চমৎকার হত! আমি যখন বইটির প্রথম সংস্করণ ক্রয় করি, টিএসসি'র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে, সেটার পাতা তখনই খুলে খুলে আসত। ১৯৯৫ সালের ২২মে শ্যামলীতে হারুন স্যারের বাসভবনে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম, বইটিতে স্বাক্ষর নেবার জন্য। স্যার নিজের হাতে যত্ন করে বইটির খুলে-আসা পাতাগুলো আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁর স্ত্রী, যূথী মীর্জাকে বলছিলেন, 'দেখ, দেখ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেমনটাই না ছাপিয়েছে, খুলে আসছে পাতা!' স্যার দীর্ঘ অপেক্ষা করে দ্বিতীয় সংস্করণটিও প্রকাশ করেন। সেটিও অবিশ্যি কদর পেয়েছিল। গোলাম দাস্তগীর কাদেরী একাজে স্যারকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। আমি দেখতাম, তিনি লম্বা লম্বা পাতাভর্তি সমীকরণ লিখে নিয়ে আসতেন, স্যারকে দেখাতেন আর সেসব রেজাল্ট বইতে আলোচিত হত। আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কেন আপনার আন্তর্জাতিকমানের বইগুলো বিদেশি প্রকাশনী যেমন ওয়াইলি বা ম্যাক-গ্র'হিলকে দেন না। স্যার জবাবে বলেছিলেন, আমি চাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা থেকে আন্তর্জাতিক বা ভাল মানের বই বের হউক। এতে পূর্ব-বাঙলার প্রকাশনা ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হবে। এরকমই হারুন স্যার কয়েকটি খুবই ভাল মানের ইংরেজি পাঠ্য বই লিখেছেন – কমপ্লেক্স ভ্যারিয়েবলস অ্যান্ড স্পেশাল ফাংশনস অফ ম্যাথমেটিকাল ফিজিক্স (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডিসেম্বর, ১৯৯৯) এবং জিওমেট্রিকাল মেথডস ইন ফিজিক্স (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্টোবর ২০০০)। দুটোরই অত্যন্ত ম্যাড়মেড়ে প্রকাশনা। এত সুন্দর দুটি বইকে এইভাবে উপস্থাপন করার কথা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ভাবতে পারল! বিশেষ করে জিওমেট্রিকাল মেথডস বইটির কথা আমি উল্লেখ করব – বইটি গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পাঠ্যবই-পর্যায়ের গ্রন্থ। হারুন স্যার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস এঞ্জেলস (ইউসিএলএ) তে ১৯৯১ সালের বসন্তে একটি কোর্স নিয়েছিলেন – মেথডস অন ম্যাথমেটিকাল ফিজিক্স, কোর্স ২৩১বি – এই কোর্স ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে নিয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী জুলিয়ান সুইংগার এবং অন্যান্য বিখ্যাত শিক্ষকেরা। সেই কোর্স-নোটের ভিত্তিতে এই বইটি লিখিত। বইটি উৎসর্গীকৃত হয়েছে হারুন স্যারের দীর্ঘদিনের সুহৃদ প্রফেসর ক্রিস্টিয়ান ফ্রন্সডালের প্রতি যিনি হারুন স্যারকে ইউসিএলএ'তে কোর্স পড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রির ওপর অমন স্ট্যান্ডার্ড টেক্সট বই বিরল, অথচ স্যারের বইখানা বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়ে কোনো প্রচারই পেল না! জটিল ফাংশন নিয়ে লেখা বইটি অবশ্য আমি নিজেও কিছুটা ব্যবহার করেছিলাম, নিজের ক্লাসের প্রস্তুতিতে। লক্ষ করুন, মাত্র এক বছরের মধ্যে গণিতের দুরূহ দুটি বিষয়ের উপর বই লেখা একমাত্র হারুন স্যারের দানবীয় ইন্টেলেক্টের পক্ষেই সম্ভব। এ বিষয়ে শ্রদ্ধেয় সুব্রত বড়ুয়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, 'স্যার প্রচুর কোর্স পড়িয়েছেন, আর প্রতিটি বিষয়ে বই লেখার মত আশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর আছে'। ভূয়োদর্শী সুবিনয় মুস্তফী যেন!

এছাড়া হারুন স্যারের আরো দুটো গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রকাশনা আছে – গ্রুপ থিওরি নিয়ে (যে এস-ইউ-থ্রি সিমেট্রি বা গাণিতিক প্রতিসাম্য সালাম-ওয়েনবার্গ-গ্ল্যাশো'র নোবেল-জয়ী তত্ত্বের গোড়ার কথা) এবং কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে – দুটোই ইংরেজিতে লেখা। এদুটোই খুবই জরুরি প্রকাশনা, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য। বিদেশী প্রকাশনা হলে, আজ এই বইগুলো সারা দুনিয়ার ফিজিক্স ছাত্রদের কাছে পরিচিতি পেত।


আলোকচিত্র: হারুন স্যারের দুটি বিখ্যাত বই

বাংলায় বিজ্ঞানের প্রমিথিউস
এরপর আসি স্যারের প্রমিথিয়ান কর্মযজ্ঞ – বিজ্ঞানের উপর লেখা বাংলা বইগুলো নিয়ে। প্রথমে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যবইগুলো নিয়ে। হারুন স্যার পদার্থবিজ্ঞানের অন্তত দশটি পাঠ্যবই লিখেছেন – চিরায়ত গতিবিজ্ঞান (বাএ, ১৯৮৯), বিদ্যুৎ গতিবিজ্ঞান (বাএ, ১৯৯৩), বস্তুর সাধারণ ধর্ম (বাএ, ১৯৯৩) , আধুনিক নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান (বাএ, ২০০৩), সাধারণ আপেক্ষিকতা ও বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব (ঢাবি, ১৯৯৬), পরিসংখ্যান বলবিজ্ঞান (বাএ, ২০০১), বিদ্যুৎ ও চুম্বক তত্ত্ব (অনন্যা, ২য় সং, ২০০২), গ্রুপতত্ত্ব ও পদার্থবিজ্ঞানে এর প্রয়োগ (বাএ, ২০০২), কণাজ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান ও বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব (বাএ, ২০১১)। পাঠ্যবইগুলির মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হল চিরায়ত বলবিজ্ঞান যেটি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলা ভাষায় এত দরদ দিয়ে এত চমৎকার লিরিকাল বাক্যে বিজ্ঞানের পাঠ্যবই লিখিত হয়নি। বাংলায় রচিত বাংলাদেশে প্রকাশিত বিজ্ঞানের গ্রন্থগুলির মধ্যে যদি চিরায়ত বা ধ্রুপদী গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়া হয়, তবে এ-গ্রন্থটি সে মর্যাদা পাবার যোগ্য। ছাপাও সুন্দর, সৌষ্ঠবও সুন্দর। মূলত এটি ক্লাসিকাল মেকানিক্সের বই, যে-বিষয়টি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্য-পাঠ্য। স্নাতক পর্যায়ের তৃতীয় বর্ষের আগে অবশ্য ক্লাসিকাল মেকানিক্স পড়ানো হয়না। এ-বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গ্রন্থ হল কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত অধ্যাপক হের্বার্ট গোল্ডস্টাইনের বই। ১৯৫০-সালে রচিত সে-বইখানা আজো ফিজিক্সের ছাত্রছাত্রীদের কাছে রত্নখনি। হারুন স্যারের বইখানা একই সিলেবাস সামনে রেখে বাংলার ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগী এবং সহজ করে লিখিত হয়েছে। বইটির মুখবন্ধে হারুন স্যার লিখেছেন, "চিরায়ত বলবিজ্ঞান পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম মূলস্তম্ভ এবং একথা হয়তো বলা যায় যে বিজ্ঞানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই নিউটনীয় বলবিজ্ঞান। গতিবিজ্ঞানের সমীকরণগুলির অনবদ্য লাগ্রাঞ্জ-হ্যামিল্টনীয় রূপ একদিকে যেমন চিরায়ত বিজ্ঞানের সুন্দরতম প্রকাশ, তেমনি অন্যদিকে তা নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টির ভিত্তিপ্রস্তর। তাই নিউটন-লাগ্রাঞ্জ-হ্যামিল্টনীয় বলবিদ্যার সম্যক জ্ঞান ছাড়া আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কোন শাখায় প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব"। গদ্য যেন ঝংকার তোলে! ফিজিক্সের কিছু না বুঝেও লাগ্রাঞ্জ-হ্যামিল্টনীয় রূপ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ জন্মায়। যেন আঠারো শতকের বিজ্ঞানের ইতিহাস উঠে এসেছে পাঠ্যের পাতায়! মুখবন্ধটি স্যার শেষ করেছেন এভাবে, "বাংলাভাষাকে যারা মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসে আরো সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী করবেন সেই অনাগত প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচেষ্টায় এই বইটি কিছুটা সাহায্য করলে আমার পরিশ্রম সার্থক জ্ঞান করব"। এই বইটি দিয়ে আমি নিজের উদ্যোগে ক্লাসিকাল মেকানিক্স শেখার উদ্যোগ নেই। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে আমার যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জিত হয়েছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম থেকে। অতএব নিজ-উদ্যোগে পদার্থবিজ্ঞান শেখার প্রচেষ্টা নেই এই বই থেকেই। এই বইয়ের মত সুন্দর বাংলা শব্দ আর কোথাওই আমি ব্যবহৃত হতে দেখিনি। পরবর্তীতে আমার নিজের লেখালেখিতেও হারুন স্যারের গদ্য আমার মাথায় ভর করেছিল অনেকদিন। বলতে দ্বিধা নেই, আমার নিজের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান পরিচিতি গ্রন্থখানি প্রায় পুরোটাই চিরায়ত বলবিজ্ঞান-এর গদ্যরীতিতে ভারাক্রান্ত। বিদ্যুৎ ও চুম্বক্ত নিয়ে স্যারের রচিত বইখানি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেখানে প্রচুর করে-দেয়া-অংক ছিল বলে, তবে অন্য বইগুলি অতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু জন-পরিসর কবেই বা শ্রেষ্ঠ কাব্যের কদর করেছিল!

এবার আসা যাক হারুন স্যারের জনবোধ্য বিজ্ঞান-গ্রন্থগুলির আলোচনায়। তিনি এক ঈর্ষাতুর তালিকা রেখে গেছেন – এতসব বই, বাংলায় লেখা, লিরিক বাংলায় আমি বলব, কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি! প্রথমে একটা তালিকা দেওয়া যাক, জনবোধ্য বিজ্ঞান বা পপুলার সায়েন্স বইয়ের একটা মোটামুটি তালিকা এখানে দিচ্ছি (এটি সম্পূর্ণ তালিকা নয়) – বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান (বাএ, ১৯৮৪), আইনস্টাইন ও আপেক্ষিক তত্ত্ব (বাএ, ১৯৮৪), পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব (বাএ, ১৯৮৭), আকাশ-ভরা সূর্য-তারা (আহমদ পাবলিশিং হাইউজ, ১৯৮৮), মৌলিক কণা (বাএ, ১৯৮৮), আদর্শ ও বাস্তবতা (আবদুস সালামের 'আইডিয়ালস অ্যান্ড রিয়ালিটিস' গ্রন্থের অনুবাদ, বাএ ১৯৮৮, দ্বিতীয় সংস্করণ ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিশার্স, ২০০১), পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকজন স্রষ্টা (বাএ, ১৯৯৫), ফিরে ফিরে দেখা আমাদের এই মহাবিশ্ব (সাহিত্য প্রকাশ, ২০০১), বিজ্ঞান ও দর্শন (বাএ, ১৯৯১), বিজ্ঞানে আমাদের উত্তরাধিকার (সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৮), নতুন শতাব্দীর নতুন দিগন্ত (বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেজ, ২০০৮), রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচেতনা (বাএ, ২০১১), স্পিনোজার জীবন ও দর্শন (শুদ্ধস্বর, ২০১৩), বিশ্বভরা প্রাণ (ছায়ানট, ২০১৫)। এছাড়াও আরো দুয়েকটি বই আছে যেগুলো আমার সংগ্রহে নেই, যেমন উপমহাদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং কমপিউটার জগৎ। এছাড়াও দুটি স্মারক বক্তৃতার ছাপা বুকলেট আছে – একটি নাজমা জেসমিন সপ্তম স্মারক বক্তৃতা (১৯৯৬) এবং অন্যটি প্রফেসর আহমদ শরীফ স্মারক বক্তৃতা (২০১১)। এই ষোলটি অসাধারণ মণিমুক্তারাজির একটা বড় অংশ আমি পড়েছি, সেটা আমার একটা আত্মশ্লাঘার বিষয়।

আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই অমূল্য মণিমুক্তারাজির মধ্যে কয়েকটিকে আলাদা করা যায় তাদের ধ্রুপদিত্ব বিচারে। সর্বাগ্রে আমি স্থান দেব পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব বইটিকে। শুধু এই একটিমাত্র বই আমাদের প্রজন্মের অনেককেই পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলেছিল। সেকথার প্রতিধ্বনি আমরা পাই প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জাহিদ হাসানের কণ্ঠে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট হলে তাঁর বক্তৃতায় অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদের উপস্থিতিতেই তিনি এই বইটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব বইটির প্রকাশকাল ১৯৮৭, অথচ বইটির কয়েকটি সংস্করণ হলে ভাল হত। কিন্তু তা না হওয়ায় ১৯৮৭'র সংস্করণটিই আজ 'ক্লাসিক' মর্যাদা পেয়েছে। বইটি মূলত আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান, তথা কণাপদার্থবিজ্ঞানের এক রস-সমৃদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ। বইটির মুখবন্ধে হারুন স্যার লিখেছেন, "আমার ধারণা বিজ্ঞান বেশ কষ্ট করে শিখতে হয় এবং এ ব্যাপারে কোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বপরিচয় বইটি লিখেছিলেন বিজ্ঞানে যাদের দাঁত ওঠেনি তাদের জন্য। পঞ্চাশ বছর পরেও দন্তহীনদের প্রশ্রয় দেয়া আমি সঙ্গত বলে মনে করি না। আর তাছাড়া আজকের পদার্থবিজ্ঞান রূপ রস বর্ণ ও গন্ধের বিচিত্র বিমূর্ত ধারণাসম্ভার নিয়ে যে অনবদ্য কারুকার্যের সূচীশিল্প গড়ে তুলেছে তার পরিচয় দেয়া আমি কর্তব্য বলে মনে করি"। হারুন স্যারের এই মত অবশ্য শুধু লেখার জন্যে নয়, তিনি তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। দীর্ঘদিন আমি লক্ষ করেছি, জনপ্রিয় বিজ্ঞানের কর্মকাণ্ড তিনি সন্দেহের চোখে দেখতেন। সম্ভবত 'দন্তহীনদের প্রশ্রয়' দেবার ভয় ছিল। তবে শেষের দিনগুলিতে স্যার এই মত থেকে সম্ভবত কিছুটা সরে আসেন, এবং জনপ্রিয় ধারার লেখকদের, আমিসহ, কিংবা বক্তাদের অকুণ্ঠ প্রশংসায় কার্পণ্য করেননি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার কি এ বিষয়ে মত বদলেছেন কিনা। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, তিনি জনপ্রিয়করণের কর্মকাণ্ডকে ভয় পেতেন কেননা সেটা তারল্যের কিংবা অতিসরলীকরণের একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে। একথায় অবশ্য আমিও একমত। কিন্তু স্যার বললেন, তবু এর দরকার আছে। সেটা ২০১৩/১৪ সাল হবে।

যাহোক, পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সত্যেন বোস নিয়ে, একদম শুরুতেই তিনি বলছেন,
"১৯২১ সালের মে মাসের কোনো এক সময়ে ঢাকায় প্রথম এলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু আর তারপর থেকে পুরোনো ঢাকা রইলো না শুধু ইতিহাসের পাতায় – উঠে এলো বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের আঙিনায়। ঐ বছরই কলকাতার এক প্রভাবশালী মহলের প্রবল বিরোধিতার মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ঈশ্বরী মিল লেনের প্রতিভাবান এই তরুণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকের পদে ইস্তফা দিয়ে হিজল-তমালের দেশে, শাপলা-শালুক আর কৃষ্ণচূড়ার মাঝে বিমুগ্ধ বিস্ময়ে উপস্থিত হলেন"।
কি চমৎকার লিরিকাল গদ্য! কে বলবে এটা বিজ্ঞানের বইয়ের প্রথম প্যারাগ্রাফ! এই কাব্যময় উপস্থাপনা কি ঢাকাবাসীর চোখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘন বৃক্ষে ছাওয়া রমনার স্মৃতি মনে করিয়ে দেবে না? আমাদের ছাত্রছাত্রীরা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই মনোরম পথগুলির কথা মনে করবেন না? এই বইটির বাক্যগুলি দীর্ঘদিন আমার কাছে বেদবাক্যের মত উজ্জ্বল ছিল। এই বইয়ে উল্লিখিত দুয়েকটি উদ্ধৃতি আমার ঠোঁটস্থ ছিল। দুটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি –
"কে এমন কথা শুনেছে যে-ঈশ্বর যে-মুক্ত মন সৃষ্টি করেছে সেই মন অন্যের স্বেচ্ছাচারী অভিলাষের কাছে ক্রীতদাসের বশ্যতা স্বীকার করে? সত্যের ব্যাপারে আত্মসমর্পণ করতে হবে এমন সব মানুষের কাছে যাদের বিচার করার কোনো যোগ্যতা নেই"? [গ্যালিলিও'র কথার অনুবাদ, পৃষ্টা ১০৯]


আলোকচিত্র: হারুন স্যারের হস্তাক্ষরে শংসাবচন সহ লেখনী। 'ফিরে ফিরে দেখা আমাদের এই মহাবিশ্ব' বইটির লেখক কপিতে উপহার-বচন

"আধুনিক বিশ্ব ১০৩৭ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় এবং প্রকৃতিস্থ কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন না যে, চতুর্মাত্রিক দেশকালের দৃশ্যমান কোনো অংশ হল স্বর্গ অথবা নরক। কোনো কোনো সৃষ্টিতত্ত্ব বিজ্ঞানী এখনও অবচেতনভাবে তাঁদের বিজ্ঞানে ধর্মীয় ছবি আনতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আমরা সরাসরি টেন্সর বিশ্লেষণ প্রয়োগ করে পাদ্রী-মহোদয়দের সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে ভয় পাইয়ে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি"। [-ই. এল. শুকিং-এর উদ্ধৃতি, পৃষ্ঠা ১০১]

প্রফেসর আবদুস সালামের নোবেল পুরষ্কার বিষয়ক প্রবন্ধে হারুন স্যার লিখেছেন, ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা থেকে,
'১৯৬৮ সালের গ্রীষ্মকাল। ট্রিয়েস্টে বেশ গরম পড়েছে। আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের দোতলার একটি ঘরে আবদুস সালামকে একলা পেয়ে গেলাম। ঘরের মালিক জি ম্যাক গিয়েছেন সমুদ্রস্নানে, তাই আর কেউ ছিল না। জানতাম দুদিন পরেই সালাম সুইডেন যাবেন। নোবেল সিম্পোজিয়ামের এক সভায় বক্তৃতা দেবেন। জিজ্ঞাসা করলাম, এবার তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু কী? জানালা দিয়ে অদূরে এড্রিয়াটিকের মায়াময় নীল জলরাশির উপর অপরাহ্নের রোদ ঝিকমিক করছে। তার দিকে ভাবুক চোখ মেলে সালাম বললেন, "তুমি তো জান, বহুদিন ধরেই আমি দুর্বল বিক্রিয়ার একটি ত্রুটিহীন তত্ত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছি। আমার এখন বিশ্বাস হচ্ছে যে, ইয়ং-মিলস জাতীয় তত্ত্বই এই সমস্যার সমাধান দেবে"। ইয়ং-মিলস জাতীয় স্থানীয় গেজ-তত্ত্ব বা পরিমাপ-তত্ত্বের মূল অসুবিধা আমার জানা ছিল। উচ্চ-শক্তির বিক্রিয়ায় এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ অবাস্তব ফল দেয়। তত্ত্বে যে অসীমরাশির উদ্ভব হয় তা দূর করার কোনো উপায়ই এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অবাস্তব এসব অসীমরাশি দূর করার পদ্ধতিকে বলে পুনঃসাধারণীকরণ। আমাদের অতি পরিচিত বিদ্যুৎ-চৌম্বক-তত্ত্বেও এসব অবাস্তব অসীমরাশি দেখা দেয়। কিন্তু সেখানে পুনঃসাধারণীকরণের নিয়ম আমরা জানি। ইয়ং-মিলস গেজ-তত্ত্বে এই ধরণের পুনঃসাধারণীকরণ সম্ভব হয়নি। তাই আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনি পুনঃসাধারণীকরণের কোনো উপায় খুঁজে পেয়েছেন কি"? সালাম তাঁর স্বভাবসিদ্ধ স্নিগ্ধ হাসি হেসে বললেন, "একেবারে পেয়েছি বলতে পারি না। তবে আমার ধারণা হিগ্স-কিব্ল এর দেখানো পথ ধরেই এর উত্তর পাওয়া যাবে"।'

– এই প্যারাগ্রাফে যে নাটকীয়তার কথা বলা হয়েছে, তার যবনিকাপাত হয়েছে ১৯৮০'র দশকে কার্লো রুবিয়ার নেতৃত্বে করা পরীক্ষায় এবং ২০১২ সালে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের হিগ্স কণা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এই পিটার হিগ্স একবার হারুন স্যারকে গাড়ি করে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন, সে গল্প স্যার আমাকে করেছিলেন।

পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব বইটির তেরোটি রচনাই চিন্তার উদ্রেক ঘটায়, সে কথা নিঃসন্দেহ। তবে কয়েকটি রচনা বিশেষ মর্যাদার দাবি রাখে, যেমন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পঞ্চাশ বছর যা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এক চমৎকার ইতিহাস তুলে ধরে। এছাড়া মৌলিক কণা এবং কোয়ার্কদের নিয়ে আছে অন্তত তিনটি প্রবন্ধ। সবচেয়ে উত্তেজনাকর অধ্যায় হল শেষেরটি – 'দেশকালের মাত্রা কি ৫০৬?'। স্পেসটাইমের ডাইমেনশন বা স্থানকালের মাত্রা বিষয়ক আধুনিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনাটি দারুণ উত্তেজনাকর ছিল সেই আশি আর নব্বুইয়ের দশকে। সেখানে যেসব প্রশ্ন তুলেছিলেন হারুন স্যার – বস্তুকণার পরিবার আসলে কয়টা, হিগ্স কণা পাওয়া যাচ্ছে না কেন, অভিকর্ষ কেমন করে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, দেশ-কালের মাত্রা কেন মোটে চার, – প্রতিটি প্রশ্ন তরুণ মনে দারুণ সংক্ষোভ সৃষ্টি করে। আমার মনে আছে, এই অধ্যায়টি বারবার পড়তাম, আর প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতাম। মনের মধ্যে এক অস্থিরতা, কখন এ-প্রশ্নগুলির উত্তর জানব, কীভাবে জানব ইত্যাদি। সায়েন্টিফিক এমেরিকান ইত্যাদি ম্যাগাজিনে যখনই এ-জাতীয় প্রবন্ধ দেখতাম, গোগ্রাসে গিলতাম। কোনো সন্দেহ নেই, ঐসব প্রবন্ধ পড়ার ব্যাপারে হারুন স্যারের বইগুলোই প্রধানতম বীজ বপন করেছিলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি থেকে সায়েন্টিফিক এমেরিকান পত্রিকার পুরানো সংখ্যা থেকে হাওয়ার্ড জর্জি, জেরার্ড এট-হুফট, স্টিভেন ওয়েনবার্গ প্রমুখের প্রবন্ধ ফটোকপি করে পড়বার চেষ্টা করতাম। সেই প্রচেষ্টার মূলে কিন্তু অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদের বই পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব, মৌলিক কণা এবং ফিরে ফিরে দেখা আমাদের এই মহাবিশ্ব
বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ে বাংলায় ভাল বই খুব কম। সেদিক দিয়ে হারুন স্যারের বিজ্ঞান ও দর্শন বইটি দারুণ পাঠযোগ্য এবং দর্শনে আনপড় বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য একটি চমৎকার প্রাইমার গ্রন্থ। আমি জানি না কেন বইটির কোনো সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি, কিংবা কেন এটা নিয়ে আলোচনাই হয়নি। বিজ্ঞানের দার্শনিক পটভূমি নিয়ে এমন চমৎকার বই বিরল, বইয়ের অধ্যায়গুলি দেখলেই পাঠকের আগ্রহ জন্মাবে – আইনস্টাইন ও কোয়ান্টাম বিতর্ক, বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের দার্শনিক পটভূমি, কার্যকারণ তত্ত্বঃ পদার্থবিজ্ঞানে দর্শনে, যৌক্তিক দৃষ্টবাদ ও বিজ্ঞান, ভাষার সীমানায় লুদভিগ ভিটগেনস্টাইন, বাস্তবতার ধারণা, বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যা, বাস্তবতার সন্ধানে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ভৌত বাস্তবতা সম্পর্কে লেখক মন্তব্য করেছেন, 'ছোটোবেলায় নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা কে না বিমুগ্ধ হয়েছি? কিন্তু তারকাপুঞ্জের এই অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের সঙ্গে তারকাগুলি শুধু আয়নায়িত গ্যাস এই বৈজ্ঞানিক ধারণার সংঘর্ষ বাধে না কি? সৌন্দর্যবোধ এবং বৈজ্ঞানিক ধারণা এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য কী করে হবে? এই সমস্যার সমাধান সম্ভব যদি আমরা আয়নায়িত গ্যাসের আইনগুলির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য সম্বন্ধে অবহিত হই। আবিষ্কৃত আইনগুলির সৌন্দর্য পৃথিবীর সব ভাষার সব কবিতার চাইতে বেশি'। লেখক দর্শনের বিভিন্ন শাখা এবং বিজ্ঞানের আধুনিক প্রপোজিশনগুলির আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি স্বীকার করেন, চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ওপর দর্শনের এবং আধুনিক দার্শনিকদের ওপর অন্তত নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞানের গভীর প্রভাব আছে। ভারতীয় দর্শনকে 'শব্দের ধুম্রজাল' বলে লেখক আমাকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানিয়েছেন, সেখান থেকে প্রকৃত ভাবনা ছেঁকে বের করা মুশকিল। বোধহয় তার জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এই বাক্যসম্ভারে আমি দীর্ঘদিন মোহিত ছিলাম। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ব্যাপক অংশই যেহেতু য়ুরোপীয় বিজ্ঞানীদের হাতে তৈরি, স্বাভাবিক যে য়ুরোপীয় ভাবধারা বিজ্ঞানকে প্রভাবিত কিংবা পরিচালিত করবে, তবে প্রয়াত স্টিফেন হকিং দর্শনকে 'মৃত' বলে সাব্যস্ত করেছেন। ভারতীয় দর্শন বা চীনা দর্শন অধিবিদ্যাকে বেশি প্রশ্রয় দেয় বলে কথিত আছে, সম্ভবত সেই বিচারে এই গ্রন্থে মূলত য়ুরোপীয় দার্শনিক প্রভাবই মুখ্য ভূমিকা পেয়েছে।


আলোকচিত্র: অপূর্ব এই মহাবিশ্ব বইটি ও হারুন স্যারের স্বহস্তে লিখিত ভূমিকার খসড়া। হারুন স্যারের গুটি গুটি অক্ষরে লেখাগুলি বিখ্যাত ছিল

অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই আছে – বিজ্ঞানে আমাদের উত্তরাধিকার – যেটি আমার বিবেচনায় হারুন স্যারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। অন্যত্র এই বইটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছি, এখানে সেটার দ্বিরুক্তি কাম্য হবে না। অতএব, আমি স্যারের অন্য দুটো বই নিয়ে আলোচনা করব – আইনস্টাইন ও আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং ফিরে ফিরে দেখা আমাদের এই মহাবিশ্ব। প্রথম বইটি নিঃসন্দেহে আপেক্ষিকতার তত্ত্বের উপর বাংলায় একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। যথেষ্ট গণিতসমৃদ্ধ। আমার নিজের কথা বলতে পারি, প্রথম সিরিয়াস রিলেটিভিটি পাঠ ঘটেছিল এই বইটি পড়ে। দ্য লিটল রেড বুক কিংবা ছোট লাল বই নামে পরিচিত এই গ্রন্থটি, আবারো বলছি, কোনো সংস্করণই হয়নি। অথচ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের উপর এর চেয়ে ভাল বই তখন ছিল না। শুধু গপ্পে গপ্পে আপেক্ষিক তত্ত্ব নয়, রীতিমত অংক কষে শেখানো হয়েছে। বইয়ের কিছু অংশ অনেকটাই স্টিভেন ওয়েইনবার্গের বইয়ের অনুসরণে লিখিত। যদিও বইটি জনবোধ্য তালিকায়, তার কারণ এটি নিখাঁদ কোনো সিলেবাস দেখে লেখা হয়নি, তারপরও অঙ্ক জানে না এমন লোকের এই বই না-পড়াই ভাল। তবে বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য এই বইটি একটি স্বর্ণগর্ভা বই। শুধু গণিত শেখার জন্য নয়, অধ্যাপক হিসেবে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আমাদের কী শেখায় সেই অন্তর্নিহিত দর্শনও আমরা এই বইতে পাই, যেটা এখনকার বইগুলোতে দুর্লভ। ২০০১ সালে হারুন স্যার যখন ফিরে ফিরে দেখা বইটি প্রকাশ করেন, আমাকেও এক কপি দিয়েছিলেন সাথে তাঁর সবচেয়ে দারুণ প্রশংস-সূচক শব্দ-সম্ভার। বইটি কসমোলজি নিয়ে। এই বইয়ের মূল ড্রাফট করা হয়েছিল স্যারের ছোট ছোট বিখ্যাত সেই নোটবুকগুলিতে। এইসব নোটবুক ঢাকার ফিজিক্সের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছিল রত্নখনি। ছোট রুলটানা খাতায় গুটি গুটি অক্ষরে স্যার কসমোলজির বহু কিছু লিখে রাখতেন। একটা খাতা আমি নিয়ে এসেছিলাম, স্টাডি করার জন্য, বহুদিন ছিল আমার কাছে, পরে স্যার ফেরত চেয়ে নেন। সেইসব নোটখাতাগুলিতে থাকত অমূল্য সব বচন, ডেরিভেশন, মূল বইয়ের প্রাক-কথন বা আর্লি-ড্রাফট। সেসব পড়ে বোঝা যেত, স্যার কী ভাবছেন, কোনদিকে ভাবছেন ইত্যাদি। সেই নোটখাতাগুলির এক্সপান্ডেড ভার্শন হল কসমোলজির দারুণ গ্রন্থ ফিরে ফিরে দেখা আমাদের এই মহাবিশ্ব। এই বইটি আজো আমাদের ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় বই। আজো ফেসবুকে দেখি শিক্ষার্থীরা বইটি নিয়ে আলোচনা করে, বুঝুক কিংবা না-বুঝুক, আজো চমৎকার, আহা! বইটির মুখবন্ধে স্যার শুরু করেছেন পিথাগোরাসের অমর বাক্য দিয়ে, 'নক্ষত্রের বৃত্তাকার গতি যে শব্দ সৃষ্টি করে তা এক ঐকতান'। এবং তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, 'প্রাচীনদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এই যে আমরা শুধু নেপথ্যের আবহসঙ্গীত কল্পনা করেই সন্তুষ্ট থাকি না, আমরা সেই ঐকতানসঙ্গীতের অস্তিত্বও প্রমাণ করতে চাই। ফিরে ফিরে দেখা আমাদের এই মহাবিশ্ব আসলে আধুনিক মিউজিক অব দ্য স্ফিয়ার্সের সামান্য কিছু পরিচয়'। 'বর্তুলের সঙ্গীত' বিষয়ে বাংলায় এই বইটি সত্যিই অধ্যয়ন-যোগ্য।

হারুন স্যারের লেখালেখি আরো বিস্তৃত, তিনি বহু সারস্বত সভায় বহুবার অনেক মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান সংস্কৃতি পরিষদ, বিজ্ঞান লেখক সম্মেলন, এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমিতে তিনি অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন। সেসব রচনার একটা বড় অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাঁর প্রকাশিত বইগুলিতে, আর কিছু কিছু রয়ে গেছে আজো অপ্রকাশিত। আমার স্মরণে আছে, আমার ন্যানো (পড়ুয়া, ২০১০) বইটির প্রকাশনা সভায় তিনি একটি লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেছিলেন, যেটি পরে আহমদ মাযহার সম্পাদিত 'বইয়ের জগৎ' ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে তিনি খুব চমৎকারভাবে বহু-শ্রুত একটি লোকায়ত শ্লোককে কিঞ্চিৎ বদলে এক চমৎকার ব্যঞ্জনা তৈরি করেছিলেন – 'ঋণং কৃত্বা বহিং পঠেৎ' অর্থাৎ ঋণ করে হলেও বই পড়! এরকম হারুন স্যারের পক্ষেই সম্ভব হত!
হারুন স্যারের লেখালেখির একটা বড় গুণ ছিল বাক্যের ঝংকার, তদ্ভব শব্দের ব্যবহার, জটিল বাক্য, এবং রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি। তাঁর গদ্য ছিল অসাধারণ! জটিল বাক্যের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি আমাকে বলেছিলেন, দীর্ঘ বা জটিল বাক্যও যে বাংলা ভাষায় লেখা যায়, সেটাও তো ভাষার একটা গুণ, সেটার আমরা মূল্য দেব না কেন! এটা নিয়ে অবশ্য পরে আমার হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল এক বড় প্রকাশনীর এক সুসাহিত্যিকের সাথে। তিনি ছিলেন পাণ্ডুলিপি সম্পাদক, যিনি হারুন স্যারের বড় বাক্যগুলিকে কেটে দিচ্ছিলেন। এতে ছিল আমার ঘোরতর আপত্তি, কেননা তাতে হারুন স্যারের সেই বিখ্যাত, আমার অতিপ্রিয়, লিরিকাল গদ্যের যথেষ্ট হানি হচ্ছিল। হারুন স্যার বাংলা একাডেমির পরিভাষা কোষ কমিটিরও সভ্য ছিলেন। ছিলেন বাংলা একাডেমি পাঁচ-খণ্ডের বিজ্ঞান বিশ্বকোষের অন্যতম প্রধান সম্পাদক। সে সম্পাদনা কর্মের সাথে আমার বেশ ভালই পরিচয় ছিল, আমি নিজেও সংকলক ছিলাম। স্যারের প্রেরণাতেই সে বিশ্বকোষে আমি অন্যান্য ভুক্তির সাথে ন্যানো-ইলেকট্রনিক্স বিষয়ক আমার বহু সময় কেটেছে সেই বিশ্বকোষের সম্পাদনা কর্মের জন্য বাংলা একাডেমি স্বরোচিষ সরকারের সাথে। এই পাঁচ খণ্ডের বিশ্বকোষ এ. এম. হারুন-অর-রশীদ, অজয় রায়, এ. কে. এম. নুরুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম প্রমুখদের এক অবিস্মরণীয় কাজ।

হারুন স্যারের সাথে আমার সবচেয়ে অবিস্মরণীয় কাজ অপূর্ব এই মহাবিশ্ব বইখানি সহ-লিখন। এটা এবং এর পরবর্তী সংস্করণ সংশোধন ইত্যাদি কাজে হারুন স্যারের সাথে আমার প্রচুর আলাপচারিতা ঘটেছে। বইটি যথেষ্ট পাঠক-প্রিয়তা অর্জন করেছিল। প্রয়াত প্রফেসর এ. আর. খান বইটির প্রথম সংস্করণ পড়ে খুব খুঁটিয়ে কিছু সংশোধন করতে বলেছিলেন। আমি একদিন খান স্যারকে সঙ্গে নিয়ে হারুন স্যারের ধানমণ্ডিস্থ বাসায় গিয়ে তিনজনে বসে তিন ঘন্টা আলোচনা করে শেষে দ্বিতীয় সংস্করণের সংশোধনী প্রস্তুত করি।

হারুন স্যারের প্রতিটি বইয়ের উৎসর্গ আমি খুব খেয়াল করে পড়ি। যেকোনো কারণে সেটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ-প্রসঙ্গে স্যারের সবচেয়ে সুন্দরতম প্রেমময় উৎসর্গপত্রটি তাঁর স্ত্রীর প্রতি ছিল, তাঁর নতুন শতাব্দীর নতুন দিগন্ত [বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেজ, ২০০৮] বইটি উৎসর্গ করেছেন এভাবে:
'এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে-
সবচেয়ে সুন্দর করুণ:
সেখানে সবুজ ডাঙ্গা ভ'রে আছে
মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে
রূপসীর শরীরের 'পর
শঙ্খমালা নাম তার: এ-বিশাল পৃথিবীর
কোন নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো
বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার
ঘাস আর ধানের ভিতর"।
– আমি এই শঙ্খমালাকে যে নামে জানি সেই হলুদ শাড়ির
যূথী মীর্জাকে
এই বইটি উৎসর্জন।'

এমন কাব্যময় উৎসর্জন কবির পক্ষে সম্ভব, বিজ্ঞানীর পক্ষে কি?
আমাদের শিক্ষিত সমাজের অবস্থা সম্পর্কে প্রফেসর এ. এম. হারুন-অর-রশীদ লিখছেন:
'বাংলাদেশের শিক্ষিত মহলের মূল্যবোধ প্রধানত 'হেডোনিস্ট। প্রত্যেকেরই অন্তরের ধারণা যে, ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর অর্থসম্পদ অর্জন করতে পারলেই তার এবং তার পরিবার-পরিজনের ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ত। এই ধরনের চরম স্বার্থপর মনোভাব থেকেই দেখা যায় যে, গ্রামের ছেলে দেশে অথবা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরী অথবা ব্যবসায়ের মাধ্যমে বিত্তশালী হয়ে নিজেকে গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক অস্তিত্বের অধিকারী হয়ে যায়। এই ধরনের শ্রেণী উত্তরণ বা সোশাল ক্লাইম্বিং যদি দেশের দশকোটি মানুষের সকলের পক্ষেই সম্ভব হতো তাহলে কিছু বলার থাকত না। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ইঁদুর-দৌড় বা র‌্যাট-রেস সকলের জন্য মোটেই উন্মুক্ত নয়। সুতরাং একদিকে সীমাহীন, অতলস্পর্শ দারিদ্র্যের নির্মমতা এবং অন্যদিকে মুষ্টিমেয় কিছু ভাগ্যবানের আকাশচুম্বী বিলাসবহুল জীবনযাত্রার দাপট বাংলাদেশে যেমনভাবে পাশাপাশি বিদ্যমান, কবির ভাষায় "তেমনটি আর পৃথিবীর কোথাও পাবে না কো ভাই"।' (-পৃ. ৭, 'একবিংশ শতাব্দীর মুখোমুখি বাংলাদেশ: নতুন শতাব্দীর নতুন দিগন্ত', বাংলাদেশ একাডেমী অব সায়েন্সেস, ঢাকা)।

হারুন স্যারের কথা উদ্ধৃত করে আমি লিখেছি,
'মূল্যবোধের এই দৈন্য নিয়ে আমরা ভাবি কি? বঞ্চনার উপর প্রতিষ্ঠিত এই চরম বৈষম্য কি বাংলার মানুষ এই ডিজিটাল যুগেও মেনে নেবে? প্রফেসর হারুন বলছেন, "বাংলার মানুষ পরম ধৈর্যশীল, ধীর, স্থির এবং শান্ত। দুঃখকে মেনে নিতে, তার পিছনে যুক্তি খাড়া করতে তাদের ঐতিহ্য, ধর্ম, জীবনাদর্শ সব কিছুই সাহায্য করে। এইভাবে অবশ্য যুগযুগ ধরে বাঙালি সমাজের আপাত-সঙ্ঘবদ্ধতা রক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বঞ্চনার উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট এই সামাজিক 'শান্তি' একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত হয়ত টিকবে না। এটা ভেঙে পড়তে বাধ্য, কারণ ১৫ কোটি মানুষ যেকোনো ঐতিহ্যের যেকোনো নীতিবাক্যের যেকোনো ধর্মীয় অনুশাসনের উর্ধ্বে তাদের বেঁচে থাকার দাবীকে একমাত্র দাবী বলে মনে করবে এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।"
'এরকম সামাজিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হলে তার জন্য চাই চমৎকার চিন্তাশীল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। দুর্ভাগ্যক্রমে এই ঐতিহ্য আমাদের একেবারেই নেই। এক সরকারের সুন্দর কল্পনা পরের সরকারী আমলে ডাস্টবিনে ঠাঁই পেলে উন্নতিটা হবে কী করে? আমার মনে হয়, আমাদের প্রতিবাদী হতে হবে। প্রতিবাদ করলে ভালো কিছু টেকসই পরিকল্পনা নিতান্ত মাঠে মারা যাবে না। আমাদের সুশিক্ষিত আমলাতন্ত্র এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। মেঘনাদ সাহা ১৯৪৭ সালে লিখেছিলেন, "একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সৌখিন রাজনীতিবিদ শিল্পপতির কাজ নয়, যারা এই কাজটা ছুটির মনোভাব নিয়ে শুরু করতে চান এবং একটা বিরাট কিছু করেছেন দেখাতে চান। এটা একটা আমলার কাজ নয় যার কল্পনা এবং চিন্তাশক্তি ক্রমাগত নথি ঘেঁটেঘেঁটে ভোতা হয়ে গিয়েছে"। কাজেই আমাদের এই বিরাট জনশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে সামাজিক চেতনার পাশাপাশি বুনিয়াদি শিক্ষায় জোর দিতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এতেই আমাদের উন্নতি নিহিত। আমরা একেবারে নৈরাশ্যবাদী অবস্থায় নেই, যদি আমরা আমাদের তরুণদের দেখি। যদিও তাদের অনেকেই 'ডিজুস সংস্কৃতিতে' ভুগে মুহ্যমান কিংবা কর্মহীন উদ্যমহীন বসে রাস্তার দৃশ্য দেখে চলেছেন অবলীলায় (ঢাকা শহরের ফুটব্রিজগুলোর রেলিঙে অনেক তরুণকে কর্মহীন বসে রাস্তার দৃশ্য দেখতে দেখা যায়), কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে তারা দীর্ঘদিন স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে থাকবে না বলেই মনে হয়। আবারো বর্ষীয়ান পদার্থবিদ প্রফেসর হারুনের একটি চিত্ররূপময় কথা দিয়ে শেষ করছি,
"শহীদ মিনারের সামনে জনাকীর্ণ রাস্তায় সেদিন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার একটি যাত্রী বোঝাই বাস বিকল হয়ে গেল। কিছু তরুণযাত্রী নেমে পড়ে বাসটি ঠেলতে শুরু করলেন এবং বেশ কিছু বলপ্রয়োগের পর বাসটি আবার চলতে শুরু করলে সকলে হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলেন। আমি শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যকে আবার অভিনন্দন জানালাম।"এই 'অপরাজেয় তারুণ্যই'আমাদের একমাত্র আশা-জাগানিয়া। আমার তো মনে হয়, তারা সঠিক কাজটিই করবে যেটা তাদেরকে অবশেষে বৃহত্তর জীবনের দিকে নিয়ে যাবে। কাজেই তারা জেগে উঠবে না স্বপ্নাচ্ছন্ন থাকবে, সেটা তারাই ঠিক করুক'। [ – ঢাকা শহরের 'গড় মুক্ত পথ' এবং চৌদ্দ কোটি মানুষ, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/3688]

হারুন স্যারের এমন জ্বলজ্বলে প্রচুর বাক্য আছে। তাঁর যেকোনো প্রবন্ধ খুলে দেখলেই এমন অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়। যত না শিখিয়েছেন স্যার, লিখে রেখে গেছেন তারও চেয়ে বেশি। এটাই তাঁর প্রকৃত শিক্ষকসুলভ গুণ। স্যার নিজে অনেক নতুন শব্দ তৈরি করেছেন, ব্ল্যাকহোলের বাংলা কৃষ্ণবিবর তাঁর তৈরি। আমার 'জ্যোতির্বিজ্ঞান শব্দকোষ' লিখবার সময়ে স্যারের কাছে বাংলা পরিভাষা সম্পর্কে অনেক আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম যখন দেশে ফিরতে চাইলেন, তিনি হারুন সাহেবের স্মরণাপন্ন হলেন। হারুন স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই ভাবছিলেন, কিন্তু জামাল নজরুল চাইছিলেন চট্টগ্রামে থিতু হতে, যেটা অবশ্য হারুন স্যারের মনঃপুত হয়নি। হারুন স্যার নিজে একদিন টিকিট কেটে সোজা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন, উপাচার্যের সাথে কথা বলতে। বুয়েটের ছাত্র ফিজিক্স পড়তে চায়, কিন্তু ভর্তি কমিটি নেবে না, উপায় কী? হারুন স্যার আছেন না। পদার্থবিজ্ঞান অন্তঃপ্রাণ ছিলেন হারুন স্যার। হারুন স্যার যেসব উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী তৈরি করে গেছেন, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছেন। আমাদের প্রফেসর আরশাদ মোমেন, বা গোলাম দাস্তগীর কাদেরী এবং আরো অনেকে আজো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর যোগ্য 'প্রোতেজে'।


আলোকচিত্র: লেখকের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ। বাঁ থেকে, লেখক, ফারহানা মান্নান, হারুন স্যার, প্রয়াত বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক শফিউল্লাহ, মাননীয় বিজ্ঞান মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, অধ্যাপক আমিনুল হক, বুয়েটের তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান

টুকরো স্মৃতি
হারুন স্যার তাঁর ছেলেবেলার অনেক কথা বলেছেন। তিনি কৃষ্ণনগরে মানুষ হয়েছেন, ফলে কৃষ্ণনগরের ভাষায় কথা বলতেন, পার্টিশনের পর এদেশে আসার পর, ঢাকাইয়া ভাষা বুঝতে তাঁর সময় লেগেছিল। কৃষ্ণনগর তিনি অনেক মিস করতেন, সেটা তাঁর সাথে কথা বললে বোঝা যেত। কিন্তু কৃষ্ণনগরেই তিনি হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার চিত্র দেখেছেন। একবার পানি খাবার জন্য একটা হোটেলে গিয়ে পানি চাইতে গেলে তাঁকে পানি দিতে চাইল না হিন্দু দোকানী। তাঁর সাথের হিন্দু বন্ধুটির কল্যাণে তিনি যাওবা পানি পেলেন, কিন্তু দোকানী সে গ্লাস ভেঙ্গে ফেলে দিল, মুসলমানের ছোঁয়া বলে। প্রথম আলোর কোনো এক সংখ্যায় ঈদের স্মৃতি নিয়ে তিনি কিছু লিখেছিলেন, সেটা কৃষ্ণনগরের স্মৃতিই মূলত। স্যারের ইংরেজি জ্ঞান প্রখর ছিল। তাঁর কাছে একটি বিশেষ ইংরেজি শব্দ শিখেছিলাম, সেটা ভোলার নয়, শব্দটি 'নিনকম্পুপ', রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা বোঝাতে তিনি শব্দটির উল্লেখ করেছিলেন।

স্যার একদিন কথা-প্রসঙ্গে বললেন, আমাদের এখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে একবার নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিলেন। আমি খুবই আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলাম, 'তাই নাকি স্যার, কীভাবে?' স্যার বললেন, তিনি তখন ইতালির ত্রিয়েস্তে, নোবেল-বিজয়ী প্রফেসর আবদুস সালামের ইনস্টিটিউটে কাজ করছি। তখন সেখানে প্রয়াত বিজ্ঞানী ড এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া সপরিবারে থাকছিলেন। এক দুপুরে, কী কারণে কথা বলতে হারুন স্যার তাঁদের বাসায় গেলেন। দুপুর হয়ে গিয়েছে, ড. ওয়াজেদ মিয়ার স্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বললেন, খেয়ে যেতে হবে। অধ্যাপক হারুন খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বিদেশে কারো বাড়িতে অমন হুট করে যাওয়া তদুপরি খেতে বসে যাওয়া একটু দৃষ্টিকটু। কিন্তু বাঙালি বলে কথা, আর দুপুর বেলা যদি পেট-ভর বাঙালি খাবার পাওয়া যায়, প্রবাসী বাঙালির জন্য সে এক পরম পাওয়া। শেখ হাসিনা ছাড়বার পাত্র নন। টেবিল-ভরা খাবার সাজালেন। হারুন স্যার আমাকে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, এত খাবার দেখে বুঝতে পারছিলেন যে বঙ্গবন্ধু কন্যা বেশ পরিশ্রম করে অতসব রান্নাবান্না করেছেন। শেখ হাসিনা এমনিতেই ভাল রাঁধেন, তার ওপর হারুন স্যার ছিলেন ক্ষুধার্ত। তিনি বললেন, বুঝলে ইমন, সাধারণ খাবার-দাবারই ছিল। কিন্তু সেটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মধ্যাহ্ন-ভোজ, শেখ হাসিনা খুব কষ্ট করে এতসব অল্প সময়ের ভেতরে রেঁধেছেন, কিন্তু এসব তিনি না-করলেও পারতেন। কিন্তু তিনি তবুও খুব যত্ন করে আমাকে খাওয়ালেন, দ্যাট ওয়াজ মাই বেস্ট লাঞ্চ এভার!

অধ্যাপক এ. এম. হারুন-অর-রশীদ ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় হারুন স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের হারুন স্যার ছিলেন এক-অদ্বিতীয়ম্ নাম, ফিজিক্সের হারুন সাহেব বা হারুন স্যার এইভাবেই তিনি পরিচিত এবং সম্মানিত ছিলেন। ঢাকার ফিজিক্সের এই একমেবাদ্বিতীয়ম্ মানুষটি বিদায় নিলেন ৯ই অক্টোবর ২০২১ সালে ৮৮ বছর বয়সে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন, ছিলেন বোস প্রফেসর, ছিলেন ইউজিসি অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদক জয়ী। কিন্তু তাঁর প্রয়াণে আমরা দেশের মহারথীদের তেমন চিত্তচাঞ্চল্য দেখি নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি শোকবার্তা জানিয়েছেন, তার মৃত্যুর পরের দিন। কিন্তু তাঁর শেষকৃত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাউকে না দেখে বেশ হতাশই লেগেছে। এত বড় একজন বিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যাঁর ধমনীর চেয়েও নিকটতর, তাঁর জানাযার নামাযে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের দেখা গেল না। বাংলা একাডেমির ফেলো বা এশিয়াটিক সোসাইটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কিন্তু তাঁদের কোনো ভূমিকা চোখে পড়ে নাই। দৈনিক পত্রিকার তৃতীয় অথবা চতুর্থ পাতায় দায়সারা শোকবার্তা,তাও সকালের খবর বিকেলে, কোনো পত্রিকায় দুদিন পর। এই উপেক্ষা ছিল মনোঃপীড়াদায়ক, এমনকি যে পত্রিকা-পরিবারের তিনি লেখকও বটে, সেখানেও। কেবল 'বিজ্ঞানচিন্তা' পত্রিকাটি একটি মনোঃপুত শ্রদ্ধাঞ্জলি ছাপিয়েছে। এমনকি আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞানীদের নিয়ে যাদের কারবার, এমন মহান বিজ্ঞানীর প্রয়াণে তাঁরা কোথায়? আমাদের সূর্যসন্তানদের আমরা যেভাবে অবহেলা করি তা দুনিয়ার খুব কম জাতিই করে। আমাদের হারুন স্যার ছিলেন সেই ব্যক্তি যাঁকে এ-বাংলা সত্যিই 'একবার পায় তারে, পায়নাকো আর'।
আমি হারুন স্যারের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম প্রথম আলো পত্রিকার জন্য ২০০৯ সালে। সেখানে স্যার অনেক কথার মাঝে বলেছিলেন, 'প্রকৃতির নিয়মকানুন জানতে পারাই সব বিজ্ঞানের ছাত্রের মূল প্রেরণা হওয়া উচিত'। এটা খুব দারুণ একটা শিক্ষা। পদার্থবিজ্ঞান আমরা শিখি কেন, আমরা আনন্দ পাই বলে, জানার আনন্দ, প্রকৃতিকে স্যারের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম, অস্তিত্বের রহস্য কী? স্যার মুচকি হেসে বলেছিলেন, পড়লেই জানতে পারবে। বলেছিলেন, দেখ, ফিজিক্সের ছাত্র হিসেবে প্রকৃতির নিয়ম-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত, নইলে আর ফিজিক্স পড়ছি কেন। তখন অস্তিত্বের নানা রহস্য তরুণ-মাথায় অবিরত খেলা করে। জিজ্ঞেস করলাম, স্যার তাহলে ঈশ্বরের ব্যাপারটা? স্যার স্মিত হেসে, ভারী মাথাটি দুলিয়ে বললেন, দেখ এই প্রশ্নের উত্তর আমি তোমাকে দেব না, আমি তোমাকে প্রভাবিত করতে পারি, তুমি নিজেই খুঁজে পাবে। তবে তিনি বলেছিলেন, অনেক পরে অবশ্য, আমি নিয়মিত প্রার্থনাদি করি না বটে, কিন্তু আই লাভ মাই প্রফেট। হারুন স্যারের বেশভূষা অনেকটাই য়ুরোপীয় ঢঙের ছিল, দীর্ঘদেহী ছিলেন, মনে হত জার্মান স্টাইলে পোশাকাদি পরিধান করেছেন।

হারুন স্যারের সাথে আমার শেষ দেখা ২০১৬ সালের দিকে, কোনো এক অপরাহ্নে আমি এবং আমার স্ত্রী গিয়েছিলাম স্যারের সাথে দেখা করতে। স্যারের বাড়ির নিচে দেখা হল। স্যার সোফায় বসে অনেক গল্প করলেন, সেদিন মূলত গল্প হচ্ছিল স্টিভেন ওয়েইনবার্গ নিয়ে। ওয়েনবার্গের কত বছর বয়স হয়েছে, তবু কত অ্যাকটিভ, এই বয়সেও বই লিখছেন। স্যার বলছিলেন, 'দেখ ইমন, আমরা তো অত কিছু জানতাম না রিয়াল ফিজিক্স সম্পর্কে। যখন ট্রিয়েস্ট গেলাম, দেখলাম ওয়েইনবার্গ এসেছেন, তাঁর বক্তৃতা শুনলাম, মনোমুগ্ধকর। তাঁর গ্রাভিটেশন বইটা থেকেই আমার যা-কিছু শিক্ষা। নিজেই শিখেছি'। স্যার ওয়েইনবার্গের বই টু এক্সপ্লেইন দ্য ওয়ার্ল্ড নামের বিজ্ঞানের ইতিহাসের বইটা দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলেন। বললেন, আমাকে কপি করে দাও, আমি অনুবাদ করব। আমি কপি দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু স্যারের সাথে এরপর আর দেখা হয়নি। তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ছিল, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে আসছিল। আমার স্মৃতিতে সদা হাস্যোজ্জ্বল গম্ভীর-কণ্ঠের হারুন স্যারকেই ধরে রাখতে চাই যাঁর সাথে আমার কেটেছে বহু মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা-দুপুর এবং কোনো কোনো বিকেল। হারুন স্যারের সাথে আমার এই সকল স্মৃতি হিরণ্ময়। যেন বাগদাদের খলিফা হারুন আল রাশিদ যেমন ফররুখ আহমদের কবিতায় শোনায়-
অপূর্ব কাহিনী সেই – মনে হয় সে নিশির ডাক
কারা যেন ডেকে গেল মধ্যরাত্রে, 'হারুনার রশিদ।'
'কারা ডাকে?' – শুধাল না চাহিল না ফিরিয়া বারেক
প্রাসাদ ছাড়িয়া নিচে নেমে এল হারুনার রশিদ।।
কালঘুমে, মোহে, স্বপ্নে আচ্ছন্ন, নিমীল দুনয়ন –
বাগ্দাদের সৌধশিরে আলোছায়া চাঁদ দেয় পাড়ি –
মাটির নিঃশ্বাস পড়ে, শোনা যায় বুকের স্পন্দন,
ছায়ামূর্তিদের পিছে চলে একা হারুনার রশিদ।।
অনেক অনেক রাত্রি পার হয়ে চলেছে হারুন
বাগদাদের রাজপথ, স্বপ্ন, তন্দ্রা আলিফ-লায়লা,
সম্মুখে চলেছে ছায়া, কোনো কথা কেউ শুধাবে না,
উত্তর দেবে না। শুধু দেখে যাবে হারুনার রশিদ।।
অপূর্ব কাহিনী সেই, সে কাহিনী অসংখ্য অশেষ।
ছায়ামূর্তিদের পিছে চলে একা হারুনার রশিদ।।