রবীন্দ্রনাথের একটি দুষ্প্রাপ্য ছবি

রাজু আলাউদ্দিনরাজু আলাউদ্দিন
Published : 6 August 2019, 08:02 AM
Updated : 6 August 2019, 08:02 AM

রবীন্দ্রনাথ বুয়েনোস আইরেসে এসে পৌঁছেছিলেন ১৯২৪ সালের ৬ নভেম্বর। টানা দুমাস থেকে তিনি ইউরোপের উদ্দেশ্যে এই শহর ত্যাগ করেন ১৯২৫ সালের ৩ জানুয়ারি। মূলত আরোগ্য লাভের কারণেই এই দীর্ঘবাস। তবে এই দুই মাসের সারাটা সময় কেবল রোগে শোকে কাটাননি কিংবা ওকাম্পোর আতিথ্যে কেবল গৃহবন্দী হয়েই থাকেননি। ওকাম্পো নিজেই জানিয়েছেন যে "এদেশের নির্ভরযোগ্য প্রতিভূদের সঙ্গে কবিকে মিশবার সুযোগ করে দিয়েছিলাম অনেক। যেমন ধরুন রিকার্ডো গ্যিরাল্ডেস। অবশ্য এর খ্যাত উপন্যাসটি তখনও বেরোয়নি, অর্থাৎ ওর এখনকার বিপুল প্রতিপত্তি তখন ছিলনা। ফাকুলতাদ দ্য ফিলসফিয়া ই লেত্রাস-এও একবার কবি যেতে পেরেছিলেন।" যেতে পেরেছিলেন আরও দুএকটি জায়গায়ও যেমন উরুগুয়াইয়ের চিত্রশিল্পী পেদ্রো ফিগারির প্রদর্শনীতে।

কিন্তু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে টানা দুই মাসের তুলনায় এই ঘোরাঘুরি ছিল খুবই কম। হয়তো অসুস্থ শরীরই ছিলো এতে প্রধান বাধা। কিন্তু আমাদের খটকা লাগে এই কথায় ওকাম্পো যখন বলেন "এদেশের নির্ভরযোগ্য প্রতিভূদের সঙ্গে কবিকে মিশবার সুযোগ করে দিয়েছিলাম অনেক।" এটা ঠিক যে মিশবার সুযোগ তিনি ঠিকই করে দিয়েছিলেন, কিন্তু এক রিকার্দো গুইরালদেস ছাড়া আর কারও নাম তিনি উল্লেখ করেন নি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার Tagore en las Barrancas de San Isidro বইটিতে। ৩৮ বছর বয়সী গুইরালদেস তখন খ্যাত কোন লেখক নন, কিন্তু তারপরও ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন । অন্যদিকে ৪০ বছর বয়সী পেদ্রো এনরিকেস উরেনঞার সাথেও পরিচয় ঘটেছে কবির, ওকাম্পোর মাধ্যমে বা অন্য কারোর মাধ্যমে। ততদিনে উরেনঞার পাঁচটি বই বেরিয়ে গেছে। পরিচয় ঘটেছে আর্হেন্তিনার প্রথম কিউবিস্ট ঘরানার চিত্রশিল্পী এমিলিও পেত্তরুতির সাথে যিনি ১৯২৪ সালে কিউবিস্ট ঘরানায় চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলেন বুয়েনোস আইরেসে। এমিলিওর বয়স তখন ২৬ বছর। পরিচয় হয়েছিলে লাতিন আমেরিকার রবীন্দ্রনাথের প্রথম অনুবাদক কার্লোস মুসসিও সায়েন্স পেইনঞার। পরিচয় হয়েছিলো হোর্হে লুইস বোর্হেসেরও। কিন্তু এদের কারোর কথাই ওকাম্পোর কোনো লেখাতে যেমন আমরা দেখতে পাই না, তেমননি রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও উল্লেখিত হতে দেখি না। যাদের কথা বললাম, এদের মধ্যে একমাত্র বোর্হেস ছাড়া অন্য সবারই রবীন্দ্রনাথের সাথে একটি গ্রুপ ছবি আছে। এই ছবিটির মূল্য কেবল দুষ্প্রাপ্যতার জন্যেই নয়, এর গুরুত্ব রবীন্দ্রনাথের সাথে অন্য ব্যক্তিত্বদের কারণেও। আর্হেন্তিনায় অবস্থানকালীন রবীন্দ্রনাথের ছবি খুব বেশি নেই, যা আছে তার মধ্যে কয়েকটি তার একক ছবি, দু একটি ওকাম্পোর সাথে, দুএকটি রবীন্দ্রনাথের সচিব এলর্হাস্টের সাথে। এক রিকার্দো গুইরালদেস ছাড়া আর্হেন্তিনার লেখক বুদ্ধিজীবীদের সাথে রবীন্দ্রনাথের একটি ছবিও কোখাও প্রকাশিত হতে দেখিনি এ পর্যন্ত। সুতরাং এখনও পর্যন্ত এটিই একমাত্র ছবি যেখানে রবীন্দ্রনাথ আর্হেন্তিনার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন লেখক শিল্পীদের সঙ্গে একটি ছবিতে বন্দী হয়ে আছেন। এবং এও লক্ষ্য করা যাবে যে রবীন্দ্রনাথ মাসাধিক কাল আর্হেন্তিনায় কাটালেন, সেখানে এত সব লেখকদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হলো তার, অথচ তাকে নিয়ে বাংলা বা ইংরেজি ভাষায় রচিত কোনো গ্রন্থেই ওকাম্পো ও গুইরালদেস ছাড়া পূর্বোক্তদের নামের উল্লেখ পর্যন্ত দেখা যায় না।


ছবিটি ১৯২৪ সালে সান ইসিন্দ্রোতে তোলা হয়েছিলো। মাস এবং তারিখটা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় নি। ছবিতে বসা এবং দাঁড়ানো অবস্থায় ৯ জনের মাঝে দাড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ

এবার ছবিতে উপস্থিত ব্যক্তিত্বদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। দাঁড়ানোদের মধ্যে সর্ব বাম থেকে প্রথমে আছেন প্রেদ্রো এনরিকেস উরেনঞা যিনি ১৮৮৪ সালের ২৯ জুনে দোমিনিকান রিপাবলিকে জন্ম গ্রহণ করেন। উরেনঞা ছিলেন কবি, প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক। রবীন্দ্রনাথে তার আগ্রহ ছিলো বহুদিন থেকেই। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার আদলে তিনি 'এল নিনঞ' নামে একটি কবিতাও লিখেছিলেনে। এছাড়া মেহিকোতে হোসে বাসকনসেলোসের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে যখন চিরায়ত বিশ্বসাহিত্য সিরিজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথের চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তখন উরেনঞা ছিলেন এই প্রকাশনা প্রকল্পের দায়িত্বে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তবে তার প্রধান পরিচয় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য ও সংস্কৃতির নতুন বিন্যাসকারী হিসেবে। মননশীলতা, পান্ডিত্য ও সৃষ্টিশীলতার জন্য তিনি গোটা লাতিন আমেরিকার প্রথম সারির প্রাবন্ধিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। উরেনঞার পাশেই দাড়িয়ে আছেন আর্হেন্তিনীয় চিত্রশিল্পী এমিলিও পেত্তরুতি। এমিলিও জন্মেছিলেন ১৮৯২ সালে আর্হেন্তিনার লা প্লাতায়। চিত্রকলা নিয়ে পড়াশুনার জন্য ইতালিতে কাটান দীর্ঘদিন। সেখানে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ইতালির লেখক চিত্রশিল্পী আর্দেঙ্গো সফফিচি, ফিউচারিস্ট আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় শিল্পী কার্লো কাররা এবং পরাবাস্তববাদী বিখ্যাত চিত্রশিল্পী গিওর্গিও দে চিরিকোর সাথে। দেশে বিদেশে তার বহু প্রদর্শনী হয়েছে। আর্হেন্তিনার এই বরেণ্য শিল্পী ১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর মৃত্যু বরণ করেন। এমিলিওর পাশেই রয়েছেন হুলিও বিক্তোর গনসালেস। হুলিওর জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৯ নভেম্বরে। তিনি ছিলেন স্পানঞল ভাষায় রবীন্দ্রনাথের 100 poems of Kabir গ্রন্থের অনুবাদক হোয়াকিন বিক্তোর গনসালেসের ছেলে। হুলিও মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫৫ সালের ৬ অক্টোবরে। হুলিওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন কার্লোস আমেরিকো আমাইয়া। আমাইয়া সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানা নেই আমাদের। তবে লেখালেখি করতেন, Discurso নামে তার একটি গ্রন্থ রয়েছে। আমাইয়ার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন উরুগুয়াইয়ের কবি কার্লোস রদ্রিগেস পিন্তোস। পিন্তোসের জন্ম ১৮৯৫ সালে মোন্তেবিদেওতে। শিল্পকলার ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। বহু গ্রন্থের প্রনেতা পিন্তোস ১৯৮৬ সালে মৃত্যু বরণ করেন। বা দিক থেকে সামনে বসে আছেন আর্হেন্তিনার বিখ্যাত দার্শনিক রাজনীতিবিদ আলেহান্দ্রো কর্ন-এর ছেলে গিইয়ের্মো কর্ন। ১৯০২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মূলত সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। আর্হেন্তিনায় গণনাট্য (Teatro del pueblo) দলের প্রতিষ্ঠাতা। কর্ণের পাশেই বসে আছেন উরেনঞার স্ত্রী ইসাবেল লোমবার্দো তোলেদানো দে এনরিকেস উরেনঞা। ইসাবেলের পাশে আছেন আমাইয়ার স্ত্রী এলফ্রিদা রোলেন দে আমাইয়া আর তার পাশে ডানে বসে আছেন পেদ্রো ব্লেক নামের এক কবি। তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানা যায় না।