পক্ষীপ্রেমীর পসরায়

সেঁজুতি শোণিমা নদী
Published : 9 July 2010, 05:05 AM
Updated : 9 July 2010, 05:05 AM


মেটে হাঁস

ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলছে কালো মাথার রাজহাঁস—যেন জল নয়, বাতাসের সাগরেই তাদের কালো রেখার সাদা ডানা সাঁতরাতে পারে বেশি। ওদিকে

………
নিয়াজ রহমান
……….
আবার সবুজশির পাতি হাঁস, মেটে রঙা ভূতি হাঁসেরা জলের নিচে ডুব দিয়ে জলদুনিয়ার সঞ্চিত খাবার সংগ্রহে মত্ত।

এদিকে গাছের ডালে গম্ভীর মুখে বসে আছে গো-বক। যেন কত বছরের তপস্যায় মগ্ন সে। দৃক গ্যালারির তিন তলার দেয়াল জুড়েই সাজানো এমন ৭৬টি ছবি। জলের পাখি, ডাঙার পাখি, এদেশের পাখি, ওদেশের পাখি, পড়শি পাখি, অতিথি পাখি—সব ধরনের রঙ-বেরঙের পাখির আলোকচিত্র প্রদর্শনী। আষাঢ়ের


ভাত শালিক

সন্ধ্যায় ভিজে মেঘ গায়ে মেখে সেখানে ঢুকতেই যেন পাখিদের ডানার ছন্দে স্পন্দিত হলো হৃদয়। প্রদর্শনীর নামও হয়তো একারণেই 'পাখায় পাখায় ছন্দ'।

একজন নিয়াজ রহমান
প্রদর্শনীর ছবি দেখতে দেখতে কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো স্বয়ং আলোকচিত্রী নিয়াজ রহমানকে। প্রদর্শনী কক্ষের মাঝখানে কাঁচা-পাকা চুল দাঁড়ির চশমা চোখের নিপাট এই ভদ্রলোকটি তখন নিবিষ্ট সামনের ল্যাপটপে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ সম্পাদনে। কাজ সেরে হাসিমুখে সম্ভাষণ জানিয়ে শুরু করলেন আলাপচারিতা। স্বল্প সময়ের হলেও সেই আলাপচারিতায় উঠে এলো, তার প্রদর্শনী, আলোকচিত্র এবং অবশ্যই পাখি সংক্রান্ত অনেক তথ্য।

নিয়াজ রহমান পেশায় একজন চিকিৎসক। চিকিৎসায় বহু মানুষের চোখে আলো ফুটিয়েছেন তিনি। তবে তাঁর নেশা ছবি তোলা। এই ছবি তোলার নেশা তার আবাল্য। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে ছবি তোলার তালিম পেয়েছেন আর সেখান থেকেই ক্যামেরার সাথে তাঁর সখ্য। ক্যামেরার সাথে গভীর বোঝাপড়া তাঁর রয়েছে বহু আগে থেকেই। ছবির ব্যাকরণ তাই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ভালোমতো রপ্ত হয়ে গিয়েছে তাঁর। এই বোঝপড়ার ছাপ রয়েছে প্রদর্শনীর প্রায় প্রতিটি ছবিতেই। ছবি অনেকদিন ধরে তুললেও প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে গত ১৫ বছরের তোলা ছবির নির্বাচিত একটি অংশ। ছবিগুলোতে তাই সাম্প্রতিক প্রযুক্তির ঝা-চকচকে ব্যবহার লক্ষণীয়। তবে প্রযুক্তির অতি ব্যবহার করে তিনি যে ছবিগুলোর বারটা বাজিয়ে দেননি, সেজন্য প্রশংসার দাবি অবশ্যই রাখেন এই শখের আলোকচিত্রী। 'ফটো এডিটিং'-এর নামে এখনকার আলোকচিত্রীরা সেভাবে ছবির প্রাকৃতিক আবহ নষ্ট করে কৃত্রিমতা হাজির করেন, সেই দোষ থেকে বহুলাংশেই মুক্ত নিয়াজ রহমানের এই প্রদর্শনী। আর তাতেই যেন উন্মুক্ত পরিবেশে অকৃত্রিম প্রকৃতির সন্তান পাখিদের ছবি জীবন্তই হয়ে উঠেছে সবার চোখে।

……..
গো-বক
……..
এছাড়াও ছবির ফোকাসিং, অ্যাপারচার এবং ছবি তোলার জন্য পারফেক্ট ডিসাইসিভ মোমেন্টের নির্বাচনেও মুন্সিয়ানার ছাপ রয়েছে ছবিগুলোতে। ভোরবেলায় গাছ থেকে চুঁইয়ে পড়া খেজুরের রস পানরত কাঠশালিক কিংবা বিলের পানিতে পাতিহাসেদের মাথা ডুবিয়ে খাবার খোঁজার দৃশ্য—একনজরে দেখলে যা মনে হবে বার্ডস-আই-ভিউ থেকে দেখা এক ঝাঁক এলোপাথাড়ি নৌকা—ছবিগুলো অবশ্যই চোখ এবং মন দুটোই জিতে নেওয়ার মতো। ছবির বিষয় নির্বাচনেও সেই একই অসাধারণত্ব বজায় রেখেছেন তিনি। দেশে বিদেশের বিলুপ্তির পথে কিংবা বিপদাপন্ন প্রজাতির পাখির ছবিগুলো তারই প্রমাণ।

বাঁচাতে হবে পাখিদের
নিজের প্রথম একক প্রদর্শনীর মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে পাখি বিষয়ক সচেতনতা তৈরির মহৎ উদ্দেশ্যও রয়েছে নিয়াজ রহমানের। জানালেন আমাদের নিজেদের দেশ তো বটেই বাইরের দেশেরও বেশ কিছু প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে। এর অন্যতম কারণ সংরক্ষণহীনতা এবং এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মানুষের অসচেতনতা।

……..
নিকোবার পিজিয়ন
……..
'আমাদের নিজেদের দেশেই প্রতিবছর অসংখ্য অতিথি পাখি আসে শীতের সময়। ওই সময়টাতেই কেবল তাদের সংরক্ষণের জন্য কিছু আওয়াজ তোলা হয়। পরবর্তী সময়ে পুরো বিষয়টাই সবাই ভুলে যায়। শুধু কি অতিথি পাখি? আমাদের অতি পরিচিত হরিয়াল, গো-বক, নানান জাতের শালিক—এদের সংখ্যাও তো দিন দিন কমে যাচ্ছে! সংরক্ষণ না হলে তো এরাও একদিন বিপদাপন্ন প্রজাতির খাতায় নাম লেখাবে।' এ বিষয়ে উল্লেখ করলেন তিনি বালি ময়নার কথা। বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় পাখি এই বালি ময়না। শুভ্র পালকের অনিন্দ্যসুন্দর এই পাখিটির চোখের চারপাশ থেকে ঠোঁট অব্দি অংশ উজ্জ্বল নীল রংয়ের। পা দুটি নীলাভ আর ছোট লেজের শেষে কালোর ছোঁয়া—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব সুষমাময় মূর্তি যেন এই পাখিটি। অথচ কেবল বালি দ্বীপের বাসিন্দা এই প্রজাতির পাখির সংখ্যা এখন কেবল ১২টি। ২০০১ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়। এই ক' বছরে তা বেড়েছে কিছুটা। সঠিক সংরক্ষণ না হলে হয়তো আমাদেরই পরিচিত কোনো পাখির দশাও হবে এমন। পাখি সংরক্ষণে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষণে তাই এখন থেকেই সচেতন হতে হবে আমাদের।

………
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় পাখি বালি ময়না
………
প্রদর্শনীর আরেকটি ছবিও বেশ ভাবিয়ে তোলে আমাদের। ছবিটি এদেশের বিরল দর্শন অতিথি পাখি ব্ল্যাক নেক্ড স্টর্ক বা কালো গলা মানিক জোড়-এর। এই পাখিটিকে এই কিছুদিন আগে দেখা গিয়েছে হাকালুকি হাওরে। তার আগে সর্বশেষ এই জুটিকে দেখা গিয়েছিল ৬২ বছর আগে ১৯৪৮ সালে চিটাগাংয়ে। 'আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে কেন এতদিন এই প্রজাতির পাখি আমাদের আতিথ্য নেয়নি? পরিবেশগত বিপর্যয়ই হয়তো এর কারণ।' বললেন আলোকচিত্রী।

তিনি আরও বললেন, 'আন্তর্জাতিকভাবে বেশ কিছু সংস্থা পাখি তথা জীববৈচিত্র সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। আই ইউ সি এন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিওন ফর কনসারভেশন অব নেচার) তেমনই একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা।

বাইরের দেশের সরকারও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেবল আমাদের দেশেই সেরকম কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

পক্ষী বিশ্বে স্বাগতম
এই প্রদর্শনীর জন্য ছবি নির্বাচন করতে গিয়ে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন শিল্পী। আর তা হলো—দেশীয় পাখি, দেশে আসা অতিথি পাখি এবং বিদেশী পাখি।

……
হলদে ঝুটির ব্ল্যাকবার্ড
……
দেশী পাখির তালিকার হড়িয়াল, নীলকণ্ঠী, হলদে পাখি, গো-বক, ভাত শালিক, কাঠ-শালিক, বড় ঝুঁটি বুলবুলি, বাতাবি কাঠ ঠোঁকরা, ছোট মাছরাঙা, শঙ্খ চিল, হুতোম প্যাঁচা ইত্যাদি পাখি যেন প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলার অফুরন্ত পক্ষীভাণ্ডারকে। অন্যদিকে পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে, চখা-চখি, মেটে হাঁস, ভূতি হাস, নিশির, কালো গলা মানিক জোড়, কালো শির রাজহাঁস—এদের সবাই ফ্রেমবন্দি হয়েছে তাঁর ক্যামেরায়। সেদিক থেকে বিদেশী পাখিরাও কম যায়নি। পেশার খাতিরে নানান দেশে ঘুরতে হয়েছে তাঁকে। সেই সুযোগে রথ (পড়ুন পাখি) দেখা, কলা বেচা দুটোই সেরেছেন এই পক্ষীপ্রেমিক। বিদেশী পাখিদের তালিকাটা তাই অলংকৃত করেছে ইয়েলো হুডেড ব্ল্যাকবার্ড। গ্লসি এমারেল্ড স্টারলিং, ব্লু স্ট্রিকড রেড লরি, অ্যামেরিকান ফ্লেমিঙ্গো, উড ডাক, অস্ট্রিচ, নিকোবার পিজিওন, ভিক্টোরিয়া ক্রাউনড পিজিওন, বালি ময়না প্রভৃতি বিভিন্ন জাতের আর বিচিত্র সাজের পাখিরা।


নিয়াজ রহমান

ছবির জন্য ভালোবাসা, পাখির জন্য ভালোবাসা
ছোটবেলায় বাবা মশিহুর রহমানের কাছে আলোকচিত্রে হাতেখড়ি। সেই থেকে ছবির প্রেমে মজে আছেন এই প্রবীণ চিকিৎসক। ছবি সংক্রান্ত সকল বিষয়েই তার উৎসাহ। এদেশের আলোকচিত্রী এবং তাদের মান নিয়ে গর্বিত তিনি। 'এ দেশের আলোকচিত্রের মান বিশ্বমানের। দু বছর অন্তর অন্তর হওয়া ছবিমেলা সেটারই প্রমাণ। আমাদের আলোকচিত্রীরা বর্হিবিশ্ব থেকে অনেক পুরস্কার, অনেক সম্মান কুড়িয়ে আনছেন। এটা নিঃসন্দেহেই গর্ব করার মতো বিষয়।' জানালেন তিনি।

……
অস্ট্রিচ
………
ক্যামেরার সাথে সখ্যের সময় থেকেই তাঁর প্রণয় গড়ে উঠেছিল এদেশের শ্যামল প্রকৃতির চপল পাখিদের সঙ্গে। আর তাই গত বিশ বছর ধরে অনেক কিছু নিয়ে ছবি তুললেও পাখির ছবি রয়েছে এক বিশাল জায়গা নিয়ে। 'পাখি আমি ভালোবাসি। পাখি নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনাও আছে আমার। পাখিকে আমি চিনি, পাখি আমাকে চেনে। এখনো বাতাসে উড়ে যাওয়া একটা সাধারণ হাঁস দেখেও আমি বলে দিতে পারি তা কোন প্রজাতির, কোথায় থাকে, কী খায়, পাখির সঙ্গে আমার এই ভালোবাসার জন্যই আমার ছবির বিশাল অংশ জুড়ে পাখি।' পাখি নিয়ে নিজের গভীর আবেগ এভাবেই তুলে ধরলেন তিনি।

ঢাকার ধানমণ্ডির দৃক গ্যালারীতে পক্ষীপ্রেমী মানুষের এই প্রদর্শনী জুনের ২৫ তারিখ থেকে জুলাইয়ের ২ তারিখ পর্যন্ত পাখির প্রতি মানুষের ভালোবাসার নিদর্শন হয়েই রইলো। যান্ত্রিকতার এই শহরে ছবির জন্যে, পাখির জন্যে ভালোবাসা ছুঁয়ে গেল শহরবাসীর হৃদয়।

২/৭/২০১০