ম্যাগনাম ছবি প্রসঙ্গ: নগ্নতা এবং পরাবাস্তবতা

নূরিতা নূসরাত খন্দকার
Published : 14 March 2019, 02:59 PM
Updated : 14 March 2019, 02:59 PM

এলবাম খুলে ছবি দেখতে নিজের কিম্বা অন্যের ছবি দেখতে কে না পছন্দ করে! স্মৃতি বহনকারী এই ছবিই একদিন ফটোগ্রাফারদের হাত ধরে এলবাম থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে গেলো শিল্পের জগতে। আজকের যুগে ছবি কেবল নয় ছবি। ভাবপ্রকাশক শিল্প জগতে স্থিরচিত্রও অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে গণ্য। দক্ষ ফটোগ্রাফারদের সুকৌশলে ছবিতে কেবল ছবি দেখা যায় না। ছবিতে থাকে জীবনের প্রতিচ্ছবি; জীবনের ভিতরে থেকেও যেন আরও কিছু বলতে চাওয়ার অবকাশ সৃষ্টি করে ভাবুক মনের অন্তরালে। জীবনের বাস্তবতা ছাপিয়েও ছবিতে ভেসে ওঠে কল্পনার চিত্রকল্প। বাস্তবতা মাড়িয়ে ভাবনার আড়ালে রঙ আর আলো ডানা মেলতে থাকে পরাবাস্তব আলয়ে। আর তখনই ফটোগ্রাফারদের ছবি হয়ে ওঠে জীবনের প্রতিবেদন, যাপনের কাহন। এবং ছবির অভিব্যক্তি ঘিরে জেগে ওঠে সৃষ্টির কল্পশক্তি। এমনই কোনো ছবির সামনে দাঁড়ালে মন গেয়ে ওঠে রবিঠাকুরের অমর গানটি, 'নও ছবি নও ছবি নও শুধু ছবি…'।

ঠিক তেমনি বিশ্ব আলোড়িত 'ম্যাগনাম'-এর ফটোগ্রাফারদের ছবিও কেবলই নয় ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতা ধারণ করতে করতে সেসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ভিতর দিয়ে ম্যাগনাম ফটোগ্রাফাররা আবিষ্কার করেছিলো বাস্তব চিত্রের অন্তরালেও থেকে যায় আরও কিছু। তাই ম্যাগনাম ফটোগ্রাফাররা তাদের প্রত্যেকটি প্রদর্শনীতে নিত্য নতুন বিষয়ে গবেষণা, নতুন কিছু আবিষ্কার করার প্রচেষ্টায় থাকেন।

সম্প্রতি সানসবারি সেন্টার ফর ভিসুয়াল আর্টস-এ একটি নতুন প্রদর্শনীতে কয়েক দশকের গবেষণায় দেখানো হয় কিভাবে ম্যাগনাম ফটোগ্রাফাররা মানুষের দৈহিক অবকাঠামোগত পরিচয়, যৌনতা এবং সামাজিক রীতি রেওয়াজ সম্পর্কিত বিষয়গুলি পরীক্ষা নীরিক্ষায় মেলে ধরেছেন। ম্যাগনাম ফটোগ্রাফাররা দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের বিচিত্র আচার অনুষ্ঠান যেমন পর্যবেক্ষণ করেন, তেমনি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের সাথেও ওঠাবসা করে জীবন ও জীবিকার বাস্তবতাগুলোর সমন্বয় ঘটিয়ে তা ছবিতে ধারণ করেন।

কেবল যৌন মিলনই দেহব্যবসা নয়। এর বিভিন্ন ধারা রয়েছে। স্ট্রিপটিজ নারীদের নগ্নতাও এক প্রকারের দেহব্যবসা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্যাবারে মিউজিকের তালে তালে একটু একটু করে পোশাক খুলে দেহকে অনাবৃত করার এক ধরনের রেওয়াজ আছে। কয়েকজন ম্যাগনাম ফটোগ্রাফাররা এই স্ট্রিপটিজেস নারীদের খোঁজ করে দীর্ঘদিন তাদের জীবন জীবিকা এবং দেহ অবকাঠামোর ওপর গবেষণা করেন। স্থিরচিত্রের মাধ্যমে স্ট্রিপটিজেস নারীদের যৌনতা, দেহকাঠামো ইত্যাদির মাধ্যমে বাস্তবতার ভিতর দিয়েই নির্মাণ করেন পরাবাস্তব জগতকল্পনার সেতু। ম্যাগনাম-এর সৌজন্যে নয়টি ছবির বর্ণনা তুলে আনা হয়েছে একে একে।

১.


লাউরেলে চোখ ঢাকা যুবক, এথেন্স। হার্বার্ট লিস্ট একজন ক্লাসিক্যাল শিক্ষিত শিল্পী যিনি ফটোগ্রাফির প্রেমকে আধ্যাত্মিকতা এবং ক্লাসিসিজমের জন্য মুগ্ধ করে তুলেছিলেন। তিনি ১৯৩৬ সালে জার্মান ছেড়ে চলে গিয়ে প্যারিস এবং লন্ডনে কাজ করেন। তার স্টিল লাইভসকে ম্যাক্স আর্নস্ট এবং গিওর্গিয় দে চিরিকোর অতিপ্রাকৃত চিত্রকর্মের সাথে তুলনা করা হয়।
আলোকচিত্র: হার্বার্ট

২.


এল বোতেইরো, ভিলারিনো দে কনস, গ্যালিসিয়া, ১৯৯২ ক্রিস্তিনা গার্সিয়া রদেরো লিখেছেন: 'আমি জনপ্রিয় স্পেনের রহস্যময়, সত্য ও জাদুকরী আত্মাকে তার আবেগ, প্রেম, হাস্যরস, কোমলতা, রাগ, ব্যথা, সত্যের আলোকচিত্র করার চেষ্টা করেছি; এবং যেমন সহজ তেমনি অপ্রতিরোধ্য এই চরিত্রগুলোকে অভ্যন্তরীন শক্তিমত্তাসহ তাদের পূর্ণতম এবং সবচেয়ে তীব্র মুহুর্তগুলিকে তুলে ধরেছি।"
ছবি: ক্রিস্তিনা গার্সিয়া রদেরো।

৩.


ওফেলিয়াস, বুয়েনোস আইরেস, ২০০১ সাল।
আলেসসান্দ্রা সাঙ্গিনেত্তির দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ গিল এবং বেলিন্দা সিরিজের একটি ছবি, গিল আর বেলিন্দা হচ্ছে আর্হেন্তিনার গ্রামাঞ্চলের দুই চাচাতো বোন।
আলোকচিত্র: আলেসসান্দ্রা সাঙ্গিনেত্তি

৪.


নিউ গার্ল, টুনব্রিজ, ভারমন্ট, ১৯৭৫ সাল।
নিউ ইংল্যান্ড কাউন্টির এক মেলাগুলোতে যে-সব নারীরা স্ট্রিপট্রিজ করে তাদের জীবনকে মূখ্য করেই সুজান মেইসেলেসের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্রকর্ম করেন।
ফটোগ্রাফ: সুসান মেইসেলাস / ম্যাগনুম ফটো

৫.


জোয়ান ক্রাউফোর্ড, লস এঞ্জেলেস, ১৯৫৯ সাল।
আলোকচিত্র: ইভ আর্নল্ড /

৬.


আগাটা, প্যারিস, ২০১৭ সাল।
বিকে ডিপোর্টারের চলমান সহযোগী আগাটা- প্রকল্পটি হচ্ছে ২০১২ সালের অক্টোবরে প্যারিসে স্ট্রিপটিজ বারে দেখা এক যুবতী। ডিপোটারের আগ্রহ জন্মায় এমন লোকেদের খুঁজে বের করা যারা তাদের গল্প বলার জন্য তার সাথে কাজ করতে পারে। আর সেসব গল্পগুলো সবসময় অংশত তার, আর অংশত তাদের থেকে নেওয়া।
আলোকচিত্র: বেক ডিপোটার / ম্যাগনুম ফটো

৭.


দালি অ্যাটমিকাস, ১৯৪৮ সাল।
ফিলিপ হ্যালসম্যান ১৯৪১ সালে স্প্যানিশ পরাবাস্তববাদী ব্যক্তিত্ব সালভাদর ডালির সাথে ৩৭ বছরের দীর্ঘ সহযোগিতা শুরু করেন। যার ফলে এই বিখ্যাত চিত্রসহ অস্বাভাবিক 'ফটোগ্রাফ অফ আইডিয়াস' প্রবাহের সৃষ্টি হয়।
আলোকচিত্র: ফিলিপ হ্যালসম্যান

৮.


গ্রেস কেলি এবং ফিলিপ হ্যালসম্যান, ১৯৫৫ সাল।
১৯ শ ৫০-এর দশকের শুরুর দিকে তার আলোকচিত্রের চরিত্রদেরকে প্রতিটি পর্বের শেষের দিকে ক্যামেরার সামনে তাদের লাফ দিতে বলতেন। এই অনন্য রসাত্মক ও প্রাণবন্ত দৃশ্যগুলোই্ তার আলোকচিত্রের উত্তরাধিকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
আলোকচিত্র: ফিলিপ হ্যালসম্যান

৯.


শিরোনামহীন, ভিলনিয়াস, লিথুয়ানিয়া, ২০০৪ সাল।
অ্যান্টোনি ডি'আগতা বলেন যে, "আলোকচিত্রীরা পৃথিবীর দিকে কিভাবে তাকাচ্ছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পৃথিবীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক।"
আলোকচিত্র: অ্যান্টোনি ডি'আগতা

শিল্পের জন্য বিষয়বস্তু উপাত্তের সাথেই শিল্পীর ঘনিষ্ঠতা জরুরী। ম্যাগমাম ফটোগ্রাফাররা সেটিই প্রমাণ করেছেন। পথ যত বন্ধুরই হোক না কেন, উপাত্তের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে বিষয়ের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারাতেই তাদের সার্থকতা। তাই এই ছবিগুলো জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই নগ্ন শরীরগুলোই জীবনের কথা বলে ওঠে ফ্রেমবন্দী হয়েও। এই বাস্তব জীবনের বিচিত্র সময়ের ভিতর দিয়ে একটি বিশেষ ক্ষণই ধারণ করেছে অব্যক্ত জগত।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে