প্রথম নারী আলোকচিত্রী অ্যানা অ্যাটকিনস

দেবাশিস চক্রবর্তী
Published : 8 June 2018, 05:02 AM
Updated : 8 June 2018, 05:02 AM

ইংরেজ উদ্ভিদবিদ ও আলোকচিত্রী অ্যানা অ্যাটকিনসকে বিবেচনা করা হয় ইতিহাসের প্রথম নারী আলোকচিত্রী হিসেবে এবং তিনিই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কিনা আলোকচিত্র সম্বলিত বই প্রকাশ করেছিলেন। এটিই ছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণার মত জটিল কাজে আলোকচিত্রের প্রথম ব্যবহার। এই অগ্রগামী বিজ্ঞানী এবং শিল্পী ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৪ পর্যন্ত তার সংগৃহীত জলজ উদ্ভিদ নমুনার আলোকচিত্র নিয়ে British Algae: Cyano type Impressions বইটি প্রকাশ করেন । পরবর্তীতে বইটির পরিবর্ধিত সংস্করণও প্রকাশিত হয়। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন আলোকচিত্রের বই প্রকাশের পথিকৃৎ। এমন এক সময় তিনি কাজটি করেন, যখন প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চায় নারীদের অগ্রযাত্রা ঠিক শুরু হয় নি। তখন এমন একটা সময় যখন মাত্রই নিপসে-ট্যালবট-দাগেরোর হাত ধরে আলোকচিত্র মাধ্যমের পথ চলা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কৌশল ব্যবহার করে মানবজাতি আলোকে বন্দী করার কৌশল রপ্ত করছে। কাছাকাছি সময়েই ১৮৪২ সালে ইংরেজ জ্যোতির্বিদ স্যার জন হার্শেল আলোকচিত্র মুদ্রণের একটি কৌশল আবিষ্কার করেন। সায়ানোটাইপ নামের এই বিশেষ বৈজ্ঞানিক কৌশলের আসল লক্ষ্য ছিল সহজ প্রক্রিয়ায় এবং কম খরচে স্থাপত্য সম্পর্কিত ড্রয়িং, স্কেচ, ডায়াগ্রাম ইত্যাদি পুনর্মুদ্রণ করা। নীলচে বা সায়ান রঙের কারণে প্রক্রিয়াটি সায়ানোটাইপ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই কারণে আজও আমরা স্থাপত্য বিষয়ক প্রিন্টগুলোকে 'ব্লু প্রিন্ট' নামেই ডেকে থাকি। সায়ানোটাইপ আবিষ্কারের এক বছরের পরে, চুয়াল্লিশ বছরের অ্যানা অ্যাটকিনস অঙ্কন পদ্ধতির অসুবিধা কমানোর জন্য সামুদ্রিক উদ্ভিদের উপর এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করা শুরু করেন। এতে করে বৈজ্ঞানিক চিত্রণকৌশলের এক নতুন দরজা খুলে যায়।

১৮৪৩ সালে স্ব-প্রকাশিত বইটি অ্যানা উৎসর্গ করেন তার পিতা এবং তার বিজ্ঞান শিক্ষক-ইংরেজ রাসায়নিক, খনিজবিজ্ঞানী, প্রাণিবিজ্ঞানী জন জর্জ চিলড্রেনকে । তিনি সে সময়ের আর সব রক্ষণশীল বাবার মত ছিলেন না মোটেই। বরং মেয়ের নানা রকমের কৌতূহলকে উৎসাহ দিয়েছেন আবার অনেক অনেক সময় উসকে দিয়েছেন। সেই সময়ের আধুনিক বিজ্ঞানের সব খবরাখবরই তিনি রাখতেন এবং মেয়ের সাথে সে সব ব্যাপারে আলোচনা করতেন। সময়ের আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক কৌশল আলোকচিত্র মাধ্যম সম্পর্কে অ্যানা তার বাবার কাছ থেকেই প্রথম জানতে পেরেছিলেন। অ্যানা পরে পারিবারিক বন্ধু হার্শেলের কাছ থেকে শিখে নেন সায়ানোটাইপের কলাকৌশল। পরবর্তী এক দশকে অ্যানা সামুদ্রিক শৈবালের সহজ কিন্তু বিস্ময়কর আলোকচিত্র সম্বলিত তিনটি ভলিউম প্রকাশ করেন। বর্তমান সময়ে মূল বইগুলো অত্যন্ত বিরল এবং মাত্র ১৭টি কপি টিকে আছে। এই কপিগুলো সংগৃহীত আছে ব্রিটিশ লাইব্রেরি এবং মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্টসের মত খ্যাতনামা কিছু প্রতিষ্ঠান এবং জাদুঘরের কাছে। তাছাড়া দুর্লভ বইয়ের নিলামে কালেভদ্রে কিছু কপির দেখা মেলে এবং বিক্রি হয় লাখ ডলার মূল্যে।


সাম্প্রতিক সময়ে নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি অ্যানা অ্যাটকিনসের বিখ্যাত আলোকচিত্রের বইগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং তৈরি করে এক ডিজিটাল সংগ্রহশালা। এতে করে তার পরিচিতি এবং গুরুত্ব অনুভূত হচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে। প্রকৃত অর্থে অ্যানার উদ্ভিদের প্রতি আগ্রহই তার বইয়ে দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি ১৮৪১ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ শৈবালের একটি গাইডের চিত্রণ দেখে এতটাই হতাশ হয়ে পরেন যে এ ব্যাপারে নিজে কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর ১৮৪৩ সালের শরতে তিনি হার্শেলের সায়ানোটাইপ পদ্ধতি ব্যবহার করে শত শত বিভিন্ন ধরনের ছবি তৈরির কাজ শুরু করেন। শুধু মাত্র এই একটি কাজের জন্য পরবর্তী এক দশকে অ্যানা ৫০০০ এর অধিক ফটোগ্রাফিক প্রিন্ট তৈরি করেন। এই কাজে জন্য প্রয়োজন ছিল সূক্ষ্ম দক্ষতার যাতে করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুকনো শৈবালগুলোকে রাসায়নিকযুক্ত কাগজের উপর রেখে সূর্যের আলোতে এক্সপোজার ( ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তোলার সময় ছবিতে কতটুকু আলো বা অন্ধকার আসবে তা যে বিষয়ের উপর নির্ভর করে তাকেই ফটোগ্রাফির ভাষায় এক্সপোজার বলা হয়ে থাকে ) দেয়া যায়। অ্যানার বইয়ের ছবিগুলো দেখলে শুধুমাত্র পৃষ্ঠা জুড়ে সুন্দর ও সূক্ষ্মতায় ছড়িয়ে থাকা শৈবালগুলোর প্রান্তরেখার প্রতি আকর্ষণ কাজ করে না বরং ছবিগুলোর উজ্জ্বল প্রুশিয়ান নীল দৃশ্যপট এক ধরণের মনলোভা ঘোরের সৃষ্টি করে। হার্শেলের পদ্ধতি তার বইয়ের পাতায় রঙ জুগিয়েছে, তাতে করে বইয়ের প্রতিটি পাতাকে শৈবালের প্রান্তরেখার সাথে রূপান্তরিত করেছে গভীর নীল রঙে। পরবর্তীতে এই পদ্ধতির ফলস্বরূপ ইংরেজি ভাষায় নতুন একটি শব্দ "ব্লুপ্রিন্ট" যোগ হয় যাকে আমরা বাংলায় নীলনকশা বলে থাকি।

অ্যানার ছবিগুলো বিস্ময়কর রকমের আধুনিক। কখনো পৃষ্ঠাজুড়ে সিহর্সের মত আকৃতি সাথে ছুঁচালো তুষারকণা। অন্য কোথাও, পালকের প্রান্তরেখা এবং ভৌতিক উদ্ভিদের গুচ্ছ। কিছু পাতায় শুধুমাত্র শৈবালের একটি বা দুটি ফোঁটা দেখা যায়, আবার কিছু পাতায় বস্তুর বিন্যাস দেখলে এক নান্দনিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির পরিচয় মেলে। আমরা বলতেই পারি যে অ্যানা ছিলেন খুব সতর্ক এবং দক্ষ। এই কাজের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন খুব ভাল মানের কাগজ, যে কারণে এখনো তার ছবিগুলো চমৎকার অবস্থায় রয়েছে। যতটা সম্ভব পরিষ্কার ছবির জন্য এই কাগজে কতটুকু সময় সূর্যালোকে রাখা প্রয়োজন সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন যথেষ্ট পারদর্শী । তাই এখন ১৭৫ বছর পরেও তার ছবিগুলোকে অনেক সজীব লাগে এবং বর্তমান সময়ের শিল্পীরাও এই একি পদ্ধতি ব্যবহার করে নিজেদের শৈল্পিক বোধ প্রকাশ করে চলেছেন। আলোকচিত্রের সফল পুনর্মুদ্রণ প্রক্রিয়া আবিষ্কারের কয়েক দশক আগেই অ্যানা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আলোকচিত্রের বহু মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার প্রবণতা। দশ বছরে অ্যানা যথেষ্ট ছবির প্রিন্ট তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে তার সহকর্মী এবং শুভানুধ্যায়ীদের মাধ্যমে বইয়ের দুই মলাটে আবদ্ধ হয়। অ্যানা নিজেই তাদের ছবি পাঠাতেন। প্রতিটি ছবিতে থাকত ছোট কিন্তু পরিষ্কার হাতের লেখায় উদ্ভিদগুলোর ল্যাটিন নাম।
আলোকচিত্র এবং এর মুদ্রণ ইতিহাসে অ্যানা অ্যাটকিনস স্পষ্টত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। যদিও তার কাজগুলো করা হয়েছিল বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যে, তবুও তার কাজের শিল্পগুণ বিন্দুমাত্র খাটো করে দেখবার উপায় নেই। আলোকচিত্রের শৈশবে তার করে যাওয়া কাজ আজও পথ দেখাচ্ছে-অনুপ্রাণিত করছে নতুন প্রজন্মকে।
নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির সংগ্রহশালায় অ্যানা অ্যাটকিনসের আলোকচিত্রের বইঃ https://digitalcollections.nypl.org/collections/photographs-of-british-algae-cyanotype-impressions#/?tab=navigation
ইউটিউবের Objectivity চ্যানেলে অ্যানা অ্যাটকিনস সম্পর্কে প্রকাশিত একটি পর্বঃ https://youtu.be/ekUUuU7whe0