লীনা দিলরুবার লেখার প্রতিক্রিয়ায় শাহাদুজ্জামান: একজন কমলালেবু বইয়ে তথ্য ব্যবহার প্রসঙ্গে

শাহাদুজ্জামান শাহাদুজ্জামান
Published : 20 Nov 2018, 12:42 PM
Updated : 20 Nov 2018, 12:42 PM


জীবনানন্দ দাশের জীবনকে ভিত্তি করে লেখা আমার একজন কমলালেবু নামের ডকুফিকশন ধারার বইটি প্রকাশিত হবার পর প্রিন্ট এবং অনলাইনে পাঠক-পাঠিকাদের বিবিধ প্রতিক্রিয়া আমি লক্ষ্য করেছি। পাঠক-পাঠিকারা যার যার রূচির ভিত্তিতে একটি বইকে গ্রহণ-বর্জন করবেন, সেটাকেই আমি সমীচীন মনে করেছি। ফলে পাবলিক পরিসরে নানাধরনের পাঠক-পাঠিকার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে, ডকুফিকশন ধারাটির ব্যাপারে অনভ্যস্ততার কারণে, বইয়ের কোথায় ডকুমেন্টেশনের শেষ আর কোথায় ফিকশনের শুরু– এই নিয়ে পাঠক-পাঠিকাদের ভেতর নানা সংশয় লক্ষ্য করেছি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আলাপচারিতায় বইটি বিষয়ে উত্থাপিত নানা প্রশ্নের জবাব আমি আমার সাধ্যমত দেবার চেষ্টা করেছি। তারপরও পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অনেক জীবনানন্দ-প্রেমী মানুষ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ফোনে, সামনাসামনি, ইমেইলে, ফেসবুক-মেসেজে যোগাযোগ করে তাদের মতামত, পরামর্শ জানিয়েছেন। আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গেই সেসব মতামত শুনেছি; আমার মতও তাদের জানিয়েছি। বইটি প্রকাশিত হবার পর এমনি অনেক পাঠক-পাঠিকার মাঝে লীনা দিলরুবা নামের একজন পাঠিকাও অনলাইনে বইটি বিষয়ে তার পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছিলেন এবং আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক-মেসেজেও বইটি বিষয়ে তার মতামত জানিয়েছিলেন। স্মরণ করতে পারি, তার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গির কথা তাকে জানিয়েছিলাম। এমনি অনেক পাঠক-পাঠিকার সাথে একজন কমলালেবু বিষয়ে বিবিধ মতবিনিময় হয়েছে। বইটির বিষয়ে পাঠকের এমন আগ্রহ সত্যিই তাদের ব্যাপারে আমাকে কৃতজ্ঞ করেছে। নানাজনই নানান পরিসরে অব্যাহতভাবে বইটি বিষয়ে বিবিধ আলোচনা-সমালোচনা করে চলেছেন, যার সবগুলো হয়ত আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি দেখছি, লীনা দিলরুবা বিডিনিউজ ২৪ পত্রিকায় একজন কমলালেবু বইটিতে কিছু তথ্য-বিচ্যুতির অভিযোগ করেছেন। যেহেতু একটি জাতীয় পত্রিকায় আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি অভিযোগগুলো তুলে ধরেছেন ফলে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো জরুরি মনে করছি:
১. একজন কমলালেবু বইয়ে আমি এক জায়গায় উল্লেখ করেছি, সিটি কলেজে পুজা উদযাপনকে কেন্দ্র করে এক জটিলতায় জীবনানন্দের জীবনের প্রথম চাকরিটি চলে যায়। তিনি কলেজের সবচেয়ে জুনিয়ার শিক্ষক ছিলেন বলে আরো অনেক শিক্ষকের ছাঁটাইয়ে সঙ্গে তিনিও ছাঁটাই হন। ভূমেন্দ্র গুহের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লীনা অভিযোগ করেছেন জীবনানন্দ দাশ সিটি কলেজের সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন আমার দেয়া এই তথ্যটি ভুল।
গবেষণায় 'ট্রায়াঙ্গুলেশন' বলে একটি ধারণা আছে। এতে সর্বাধিক সম্ভাব্য সুত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পরিপ্রেক্ষিতের সাথে মিলিয়ে সে তথ্য ব্যবহারের নিয়ম আছে। একজন কমলালেবু বইটি ডকুফিকশন ঘরানার বলে তথ্যের ব্যাপারে গবেষণার সেই পদ্ধতি আমাকে ব্যবহার করতে হয়েছে। এইটুকু বলি, অন্তত তিনটা সূত্র আমি পেয়েছি, যেখানে স্পষ্ট বলা আছে জীবনানন্দ দাশ সে সময় সিটি কলেজের সবচেয়ে জুনিয়র শিক্ষক ছিলেন-
* জীবনানন্দের জীবনীকার প্রভাতকুমার দাস তাঁর "জীবনানন্দ দাশ" বইয়ে নির্দিষ্ট করে লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ কলেজের সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন (পৃষ্ঠা-২৭)
* ক্লিন্টন বি সিলি তার "অনন্য জীবনানন্দ" গ্রন্থে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন জীবনানন্দ ছিলেন সিটি কলেজের সবচেয়ে জুনিয়র শিক্ষক (পৃষ্ঠা- ৮৬)।
* সবচেয়ে মোক্ষম প্রমাণটি আছে ক্লিন্টন বি সিলির বইয়ের ফুটনোটে, যেখানে সরোজেন্দ্রনাথ রায়ের বরাত দিয়ে তৎকালীন সিটি কলেজের শিক্ষকদের একটি তালিকা দেয়া আছে শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে এবং সন্দেহাতীতভাবে সেই তালিকায় জীবনানন্দকে সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (পৃষ্ঠা-৯৭)।
গবেষণায় একটি সুত্রকে একমাত্র সুত্র ভাবার কোন সুযোগ নেই। এটি অনেকের জানা নেই হয়ত। ফলে, আমি যে তথ্যসুত্রগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, সেগুলোর খোঁজ না করেই লীনা দিলরুবা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন এবং লেখককে কিছু শুধরে নেবার পরামর্শ দিচ্ছেন। তার আত্মবিশ্বাসটি কৌতুহলোদ্দীপক। আশা করি এখন তিনি বিষয়টা ধরতে পারবেন।

২. একজন কমলালেবু বইটির প্রাথমিক মুদ্রণে জীবনানন্দের কবিতা, গ্রন্থপঞ্জী ইত্যাদিতে বানান এবং যতিচিহ্নের বেশ কিছু ত্রুটি ছিলো। অগণিত পাঠক-পাঠিকা বইটির মুদ্রণত্রুটির কথা ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে ( মুলত ইমেইল এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারে) আমাকে জানিয়েছিলেন। তার ভেতর লীনা দিলরুবাও ছিলেন। যেহেতু যোগাযোগ ব্যক্তিগত পরিসরে ছিল, তাই আমি লীনা-সহ সবাইকে অনলাইনের সেইসব ব্যক্তিগত পরিসরেই ধন্যবাদ জানিয়েছি। পরবর্তীতে আমরা লেখক-প্রকাশক যৌথভাবে চেষ্টা করে সেই ত্রুটিগুলোকে যথাসম্ভব শুধরে নিয়েছি। বইটির এখন সপ্তম মুদ্রণ চলছে এবং এই মুদ্রণে যে ত্রুটিগুলো নেই, তার কথা এই পাঠিকাও উল্লেখ করেছেন। এই মুদ্রন ত্রুটি শোধরানো অব্যহত আছে। যদি ত্রুটি থেকে যায় ধারাবাহিক মুদ্রণে তা শুধরে নেয়াই প্রকাশনার রেওয়াজ। যে অগণিত শুভানুধ্যায়ী কোন বইয়ের মুদ্রণ-ত্রুটি বিষয়ে পরামর্শ দেন, বইয়ের নতুন সংস্করণে তাদের তালিকা সংযুক্ত করে দেবার কোন রেওয়াজ নেই। থাকলে আমিও সেটা দিতে বলতাম প্রকাশককে। তাছাড়া, অনেকেই আছেন, যারা ব্যক্তিগত পরিসরের এই উপকারকে জনপরিসরে স্বীকৃতি দিলে অস্বস্তি বোধ করবেন। লেখক-পাঠক-প্রকাশক মিলে মুদ্রণ-ত্রুটি শুধরে নেবার এই সমবায়িক প্রক্রিয়াটি উল্লেখিত পাঠিকার সম্ভবত জানা নেই ফলে তিনি সরল বিশ্বাসে ভেবে বসেছেন যে বইটির ত্রুটি শোধরানোর একক কৃতিত্ব হয়তো তার।

৩. জীবনানন্দের বহুল-আলোচিত "বনলতা সেন" কবিতাটির একটি বিতর্কিত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন আলি আকবর খান, যেখানে তিনি এই ধারণা প্রস্তাব করেন যে, বনলতা সেন একজন বারবণিতা। লীনা অভিযোগ করেছেন যে, আমি আলি আকবর খানের এই প্রস্তাবকেই একজন কমলালেবু বইয়ে গ্রহণ করেছি। ধারণা করছি, একজন কমলালেবু বইটির অসতর্ক পাঠের কারণেই পাঠিকার এমন একটা বিভ্রান্তির জন্ম হয়েছে। আমি বস্তুত "বনলতা সেন" কবিতা বিষয়ে নানা-ধারণার ল্যান্ডস্কেপের পরিচয় দিতে গিয়ে জীবনানন্দের উপন্যাস, সেইসঙ্গে আকবর আলি খান এবং অশোক মিত্রের মতামত তুলে ধরেছি মাত্র। আমি তাদের কারো মতকেই চুড়ান্ত হিসেবে উপস্থাপন করিনি। আকবর আলির প্রস্তাবটিকে আমি বলেছি কৌতুহলোদ্দীপক। এ বিষয়ক আলাপের সুচনা অংশে আমি লিখেছি:
"বনলতা সেন বাস্তব কোন চরিত্র ছিলেন কিনা এ নিয়ে দুর্মর কৌতুহল দেখা গেছে পাঠক-পাঠিকার ভেতর। জীবনানন্দের কারুবাসনা উপন্যাসে বনলতা সেন নামে এক চরিত্রের উল্লেখ আছে। অশোক মিত্র জানাচ্ছেন, জীবনানন্দ তাকে একদিন বলেছেন যে পত্রিকায় বনলতা সেন নামে রাজশাহীর জেলে আটক এক রাজবন্দীর খবর তিনি পড়েছেন। নামটা সেখান থেকেই নেয়া। তবে বনলতা সেন চরিত্রের উৎস রহস্যই রয়ে গেছে। সম্প্রতি "বনলতা সেন" কবিতার এক কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন আকবর আলি খান।" ( পৃষ্ঠা ১২৬)
এরপর আমি আকবর আলি খানের প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছি এবং লিখেছি যে, বনলতা সেন গণিকা কিনা সেটি একটি কৌতুহলোদ্দীপক প্রশ্ন হতে পারে; কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে এই কবিতাটির আবেদনের হেরফের হবার কোন কারণ নেই। অশোক মিত্রের তথ্যটি আমি যুক্ত করি বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে। আমার বইয়ের প্রথম সংস্করণ প্রকাশের পর এই বইটির খোঁজ পাই আমি একাধিক সূত্র থেকে।

৪. ভূমেন্দ্র গুহ একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য জীবনানন্দের কাব্যের সঙ্গে শেলি-কীটস-হুইটম্যান, ইয়েটস-রিলকে-এলিয়ট, ডিলান টমাস পর্যন্ত কবিদের কবিতার প্রভাবের কথা বলতেই জীবনানন্দ বলেছিলেন- "একজন সচেতন কবিকে এতজন অগ্রজ বা সমসাময়িক কবি একই সঙ্গে প্রভাবিত করতে পারেন?"

লীনা দিলরুবা অভিযোগ করেছেন, আমি একজন কমলালেবুতে জীবনানন্দের এই সংলাপকে বদলে দিয়ে এর অর্থ পাল্টে দিয়েছি। ডকুফিকশনে সংলাপের প্রামাণ্যতা ব্যাপারটি ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সংকট মুলত পাঠের ভিন্নতা নিয়ে। আমি জীবনানন্দের এই সংলাপকে এভাবেই পাঠ করি যে, জীবনানন্দ সচেতন কবির উপর অন্যান্য কবির প্রভাবের কথা কবুল করেই নিয়েছেন। কারণ, সচেতন কবির উপর অন্য কবির প্রভাব থাকবে না এমন অর্বাচীন ভাবনা ভাবার কোন কারণ নেই। বরং সঞ্জয়ের কথিত বিভিন্ন ধারার অসংখ্য কবির নামের প্রেক্ষিতে জীবনানন্দের প্রশ্ন: 'এতজন' এবং 'একই সঙ্গে' প্রভাবিত করতে পারে কিনা। ফলে আমি জীবনানন্দের মুখে একটি নুতন সংলাপ জুড়ে দিয়ে একটি 'না' উত্তরকে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থে রূপান্তরিত করেছি– লীনার এমন দাবি অসার বলেই মানবেন অনেকে। এমনি আরেকজন পাঠক এই বইয়ে ব্যবহৃত শব্দ 'সিন্দাবাদ' এবং তার সঙ্গে 'সিন্দাবাদের দৈত্য' শব্দ দুটোর পার্থক্য নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন আমার কাছে। সেটাও ছিলো বস্তুত পাঠের ভিন্নতার সংকট। মুল ভাবনার কোন পরিবর্তন হবে না নিশ্চিত হয়েই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে কিছু সংলাপ এবং বাক্যবন্ধ আমি বদলে দিয়েছি এমনিতর আন্তরিক এবং সরলমনা পাঠক পাঠিকার কথা বিবেচনা করেই।

এইটুকু বলার যে, একজন কমলালেবু জীবনানন্দের মত অনন্যসাধারণ একজন মানুষকে মোকাবেলার একটি সামান্য চেষ্টা। চেষ্টা সফল হয়েছে, সে দাবি করি না, এর বিচার পাঠক করবেন। কেবল বইটি লিখতে গিয়ে জীবনানন্দের সাথে যে রূদ্ধশ্বাস সময়টুকু কাটিয়েছি, তার সুখস্মৃতি স্মরণ করি। এই বইয়ের সুত্র ধরে জীবনানন্দ অনুরাগীরা যে তর্ক বিতর্ক অব্যাহত রেখেছেন তাতেই আনন্দ বোধ করি।