খান সারওয়ার মুরশিদ: জিয়াউর রহমান আমার সঙ্গে এক ব্যক্তিগত আলোচনায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বাঙালির আসক্তিকে রূঢ়ভাবে দায়ী করেছিলেন

admin
Published : 17 Jan 2020, 03:51 AM
Updated : 17 Jan 2020, 03:51 AM


'শ্রাবণ' নামক সাহিত্য পত্রিকায় সাক্ষাৎকারের জন্য অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের সঙ্গে পত্রিকার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে তিনি এতে সম্মত হন। তখন পত্রিকার সম্পাদকীয় বৈঠকে কী প্রশ্ন করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। সম্পাদক মনজুরে মওলা সহযোগী সম্পাদকদের কাছ থেকে প্রশ্ন আহবান করেন। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কয়েকটি প্রশ্ন বলেন, পরে লিখিত প্রশ্ন দেন। আমি ৬১ সালের পাকিস্তানের এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ও শতবার্ষিকী উদযাপনে এর প্রভাব বিষয়ে দুএকটি প্রশ্ন লিখে সম্পাদককে দেই। পরে সব প্রশ্ন নিয়ে সম্পাদক মনজুরে মওলা নিজে সমস্ত প্রশ্ন লিখে অধ্যাপক মুরশিদকে পাঠান। অধ্যাপক মুরশিদ সকল প্রশ্নের লিখিত জবাব দেন। সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক যোগাযোগের সময় 'শ্রাবণ' এর পক্ষ থেকে দুতিনবার আমি অন্যান্যের সাথে অধ্যাপক মুরশিদের সঙ্গে দেখা করি প্রশ্নাবলী দেয়া এবং পরে উত্তর সংগ্রহ করার সময়। — আবেদীন কাদের

শ্রাবণ: রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন আপনি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছিলেন কেন?

খা. সা. মু: গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করার অনেকগুলো কারণ ছিলো: প্রধান কারণ ছিল সাংস্কৃতিক এবং এ কারণে রাজনৈতিক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আমার ব্যক্তিগত মূল্যবোধজনিত কিছু তাগিদ। বাংলা ভাষার মহত্তম কবি-প্রতিভাকে এই উপলক্ষে সম্মান জানানো এবং তাঁকে নতুন করে দেখা এবং উপলদ্ধি করা আমার কাছে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ব'লে মনে হয়েছিলো। পৃথিবীর অন্যান্য সভ্য দেশেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই সময় আলোচনা হবে, তাঁর মূল্যায়ন হবে, আর ব্যতিক্রম হবে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীর দেশ পাকিস্তানে? পাকিস্তানী শাসক মহল তা-ই চেয়েছিলো। তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বাধা ও নিষেধের ফলে আমাদের একটি স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক আকাঙক্ষা একটি রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়লো। সময়টি ছিলো আইয়ুবের শাসনের চতুর্থ বৎসর। পাকিস্তানের ধর্মীয় জাতীয়তার সংকীর্ণতা, সামন্ত এবং স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা, তখন সামরিক একনায়কত্বের অখন্ড শিলায় পরিণত হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র নেই, তার উপর আবার সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। এ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে প্রত্যাখ্যান করার শর্তে আমরা পাকিস্তান গ্রহণ করিনি এ কথাটা শাসকদের যথাযোগ্যভাবে জানিয়ে দেয়া আমি জরুরি মনে করি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে কি, আমাদের সংস্কৃতিতে কি, এটা সুন্দর এবং স্পষ্ট করে 'বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন আমি বোধ করি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিয়ে সংঘাতের পটভূমিকে ভালো করে বুঝতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। আমরা তরুণ বয়সে পাকিস্তানকে যেমন রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করেছি, পাকিস্তান যেমন রাষ্ট্রটি হয়ে উঠবে বলে আশা করেছি, বাস্তবে তা হযনি, অল্প দিনের মধ্যে আমাদের আশা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, সেই হতাশা ও জিজ্ঞাসার আবহাওয়ায় ১৯৪৯ সালে 'নিউ ভ্যালিউজ' নামে আমার সম্পাদনায় একটি পত্রিকা বেরোয়। পত্রিকাটি অনিয়মিতভাবে ১৯৬৫-৬৬ সাল পর্যন্ত টিকেছিলো। এ কাগজের অন্বিষ্ট ছিলো একটি সেকুলার ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র, যার ভিত্তি হবে দেশের দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের যৌথ জাতীয়তা এবং মিলিত উত্তরাধিকার। যে উত্তরাধিকারে ভাষা, ভাষাগত সংস্কৃতি এবং সাহিত্য, একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। হিন্দু-মুসলমানের এ মিলিত উত্তরাধিকার পাকিস্তানের জাতীয়তা থেকে বাদ পড়বে না। বরং পাকিস্তানী
জাতীয়তার অংশ হবে। সুতরাং আমার বাঙালিত্ব ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য সংস্কৃতিগত স্বকীয়তা এগুলোর ঠাঁই হবে পাকিস্তানী জীবনধারায় এবং সে চেতনা পাকিস্তান রাষ্টের সার্বিক চেতনার অংশ হবে। এটা পাকিস্তানের শাসকদের মনঃপূত হওয়ার কথা নয় এবং তা হয়ও নি। রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে বাঙালিদের দুর্বলতাকে সরকার ভালো চোখে দেখেনি। সে কারণে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হোক সেটাও চায়নি। 'নিউ ভ্যালিউজ' এর কথাটা এলো এ জন্যে যে, এ শুধু আমার জীবন কাহিনীর অন্তর্গতই নয়। পত্রিকাটি প্রমাণ করে ওই, তখন থেকেই পাকিস্তানের সংকীর্ণ পশ্চাৎমুখী রাষ্ট্রাদর্শের বিকল্প একটি রাষ্ট্রীয় ধারণা পূর্ববাংলায় ক্রমে দানা বাঁধছিলো। আমরা একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট চাই যেখানে ধর্ম জাতীয়তার নিয়ামক নয়, যেখানে সব সম্প্রদায় এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠি বিনা অন্তরায়ে বিকশিত হবে, এবং এভাবে একটি সত্যিকারের জাতি গঠিত হবে। হয় তো তোমরা প্রশ্ন করবে আপনারা কি সেই জেনারেশনের মানুষ নন যারা পাকিস্তানকে গ্রহণ করেছিলো? আমি ব্যক্তিগতভাবে এটুকু বলতে চাই যে আমি দেশ বিভাগকে মেনে নিয়ছিলাম শুধু একটি কারণে। সাম্প্রদায়িক হানাহানি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে মানুষ মনুষত্বের সব গুণাবলী খুইয়ে বসে পশুর স্তরে নেমে যায়। তখন আমরা চেয়েছিলাম এর চেয়ে বিভক্ত হয়ে সভ্য জীবন যাপন করা ভালো। আমরা, অন্তত আমি, বুদ্ধির দিক থেকে অনুভূতির দিক থেকে, দেশবিভাজন চাই নি। আমরা একজন আর একজন মানুষকে হিন্দু বা মুসলমান বলে হিংস্রভাবে হত্যা করছি, এই ঘৃণা ও ভয়ের আবহাওয়া এমন মর্মান্তিক ছিলো যে বোঝাতে পারবো না। দেশ বিভাগ হওয়ার পর ভাবলাম রক্ষা পাওয়া গেলো। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার অল্পদিনের মধ্যে পাকিস্তানী জাতীয়তার সংকীর্ণতা আমাদের পীড়া দিতে লাগলো। আরও দেখলাম, এমন একটি দেশ পেয়েছি যেখানে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। সাত-আট মাসের মধ্যেই জিন্নাহ সাহেব বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এসব কারণে স্বপ্নভঙ্গ দ্রুত হলো। আমরা জিজ্ঞাসার পথে গেলাম, নিজেদেরকেই নানা প্রশ্ন করলাম। এলো নির্বাচন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, তথাকথিত গণতান্ত্রিক বিপর্যয়, মার্শাল ল. আইয়ুব খানের পেশীর রাজত্ব। সঙ্কীর্ণতা এবং পাঞ্জাবী আত্মম্ভরিতার সাথে যুক্ত হলো সেনাবাহিনীর এমন এক মানসিকতা ও চিন্তা যেখানে অন্য কোনো চিন্তার স্থান নেই। সবকিছুই একরোখা, অসহিঞ্চু, এবং অনাধুনিক। পাকিস্তান শাসকদের মনে বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা এমন ছিলো যে বাঙালি হয়েই আমরা পাকিস্তানী থাকতে চাই এটা তাদের বোঝানো সম্ভব ছিলো না। আমরা নিজের মতো কিছু করতে চাইলে তারা বাধা দেয়, অন্যদিকে ডিক্টেটরশিপ মেনে নেয়াও সম্ভব নয়। যেখানে যুক্তির মূল্য নেই, শক্তিই শেষ কথা, সেখানে প্রতিটি মানুষ অন্তরে অন্তরে অপমানিত বোধ না করে পারে না। মানুষের গণতান্ত্রিক সম্ভ্রমের ব্যাপারে আমি ছিলাম এক্সট্রা সেনসিটিভ। রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বার্ষিকী পালনের মতো একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে যখন বাধা এলো, তখন এটা হয়ে উঠলো একনায়কত্ব এবং অন্ধকারের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ। পাকিস্তানের শতকরা ৫৫ জনের ভাষা বাংলার ইতিহাসের মহত্তম স্রষ্ট্রা রবীন্দ্রনাথ। সে কারণে আমি তার সাহিত্য পড়বো এবং অন্যরাও পড়ুক তা চাইবো। তাঁকে অস্বীকার করার অর্থ নিজ সাহিত্যে এবং মহৎ সাহিত্যে বাঙালির অধিকার হারানো। আর রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বাঙালির আকর্ষণ ভাবালুতার ব্যাপার নয়। পৃথিবীর অনেক বড়ো প্রতিভার তুলনায়ও তিনি বিশিষ্ট। খুব কমই সার্থক শিল্পী আছেন যিনি সাহিত্যের এবং শিল্পের এতগুলো বিভাগে একই সঙ্গে এমন তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আমরা এই ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির যে অংশের সঙ্গে পরিচিত সেটার ব্যাপ্তি নেহায়েত কম নয়। ভেবে দেখো, রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় উপনিষদের ঐতিহ্য থেকে আরম্ভ করে ইসলামী মরমীবাদ, পাশ্চাত্যের রেনেসাঁস মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান ইত্যাদি মিলিয়ে ভারতীয় ও আধুনিক সংস্কৃতির কি বিরাট এলাকা তাঁর রচনায় প্রকাশ করেছেন। ঠিক অতখানি কি আর কেউ করতে পেরেছেন ভারতীয় উপমহাদেশে? রবীন্দ্রনাথ তার সংস্তৃতির সবচেয়ে পূর্নাঙ্গ মানুষ এবং একই সঙ্গে, স্ববিরোধ সত্ত্বেও, একজন বড়ো মাপের আধুনিক মানুষ। তাঁর কালের, আমাদের কালের পরিপ্রেক্ষিতেও, ভাবুক হিসেবে তিনি উপেক্ষণীয় নন। তার সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা এবং শিক্ষাধর্ম সম্পর্কে ভাববার মতো অনেক কিছু, আছে। কবি হিসেবে তার অন্যান্য দিকের মধ্যে তাঁর বিবর্তন ও পরিণতিতে বিস্ময় ও আকর্ষণ আছে। ইয়েটসেও এরকম দেখতে পাই। অনেক দিন পর্যন্ত তিনি বদলান নি, তারপর পরমাশ্চর্য বাঁক নেন।

রবীন্দ্রনাথের বর্ণাঢ্য বিচিত্রমূখী অবদান বাঙালি সত্তাকে ঋদ্ধ করেছে। পাকিস্তানী হয়েও আমরা তার অংশীদার। সুতরাং সে মহৎ সাহিত্য আমার এবং আমার উত্তরাধিকারীকে আমি তা থেকে বঞ্চিত হতে দেবো কেন?

নিষেধ কেনো? অন্যরা নিষেধ, বিশেষ করে স্বৈরশাসকের নিয়ন্ত্রণ সহ্য করা, অমার্জিত কল্পনাহীন অহংকারের হুকুম তালিম করা আমার পক্ষে অসহনীয় ছিলো। আর একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো, একজন ডিক্টেটর ক্ষমতায় এলে কিছুদিনের মধ্যেই সাংস্কৃতিক নায়ক হতে চান। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটা যেমন ঘটছে, তেমন আইয়ুবের আমলেও ঘটেছে। শক্ত মানবদের সংস্কৃতির পয়গম্বর হওয়ার এই ধৃষ্টতা আমি কখনো মেনে নিতে পারিনি। কিছুদিনের মধ্যে তারা দেশের সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজাতে চান। এই চিন্তায় আইয়ুব খান বি, এন, আর তৈরি করলেন। এর কার্যকলাপে ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন বলতে যা বোঝায় ঠিক তা ছিলো না, এর কাজ ছিলো গোয়েন্দাগিরি করা। বাঙালিরা যেন বাঙালি না থাকতে পারে,বাঙালির মতো চিন্তা করতে না পারে, এসব দেখা। বাঙালি সংস্তৃতির ব্যাপারে যারা উৎসাহী তাদের নানাভাবে হয়রানি করা। এমন সমস্ত উদ্যমকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া যেগুলো সংকীর্ণ পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী যা ছিলো ধর্মভিত্তিক এবং একপেশে। আইয়ুব শাহীর জাতীয় পুনর্গঠনের মর্মার্থ ছিলো বাঙালিরা নিকৃষ্ট শ্রেণীর, নিকৃষ্ট সংস্কৃতির লোক এবং তারা রবীন্দ্রনাথ, বাংলা ভাষা, ভারতবর্ষ সম্পর্কে অত্যন্ত দুর্বল, এদেরকে মানুষ করতে হবে। এ রকম পটভূমিতে নিষেধটা এলো গণতন্ত্রের শত্রু একজন লোকের কাছ থেকে। মিলিটারির যে জগৎদৃষ্টি অথবা ওয়াল্ডভিউ আমি কখনো তা গ্রহণ করতে পারিনি। মনে পড়ে ভোরবেলা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে ভাবতাম আজো দেখছি না কেনো হেডলাইন যে লোকটার পতন হয়েছে? সুতরাং বুঝতেই পারো, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উৎযাপন আমার কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

শ্রাবণ: আপনিইি কি জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগ প্রথম গ্রহণ করেন? নাকি অন্য কেউ এ বিষয়ে প্রাথমিক উদ্যোগ নেন এবং পরে আপনি তার সঙ্গে যুক্ত হন ও তাকে পুর্ণাঙ্গ রূপ দেন?

খা. সা. মু: অবশ্য আমি প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করিনি। তবে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই আমি ছিলাম। দু'জন তরুণ আমার কাছে এসেছিলো। একজন পরে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে যথেষ্ট যশস্বী হয়েছে। সে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আর একজন মোশতাক, ভারিক্কি ধরণের চেহারা, চোখে পুরুলেন্সের চশমা, ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র ছিলো। বোধ হয় এখন বিদেশে কোথাও আছে। ওদের প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, হাসি-হাসি আর চোখে মুখে মনে হয় কিছু বলতে চাইছে, একটা মতলব নিয়ে এসেছে। হাবভাবে বোঝা যায় আমাকে সম্পূর্ণ সত্য কথা বলবে না। ওরা আমাকে বললো, স্যার আমরা রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি, বিচারপতি মুর্শেদ কমিটি গঠন করবেন। তিনি সভাপতি হতে রাজি হয়েছেন। আপনাকে সম্পাদক হতে হবে। পরবর্তী সময়ে জেনেছিলাম বিচারপতি মুর্শেদের সঙ্গে তখনো ওদের আলোচনা হয় নি। আমাকে রাজি করানোর জন্য এই কৌশল নিয়েছিলো। যাই হোক, কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বুঝলাম ছেলেগুলো সিরিয়াস, যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আটঘাট বেঁধে নেমেছে। ওদের কথার সুরে একটা ডেসপারেশন ছিলো, বুঝলাম আমাকে রাজি হতেই হবে। আমি একটু অবাক হলাম, ছেলেগুলো এত জোর দিয়ে কেনো বলছে? দেশে কি আর যোগ্য ব্যক্তি নেই? আজ থেকে অত বছর আগে আমিও নিজেকে এমন প্রবীন এবং যোগ্য ভাবিনি যে এই দায়িত্বের জন্য আমি অপরিহার্য। আমি ওদের কাছে একদিন সময় চাইলাম। ওরা পরদিন এলে আমি ওদের আমার সম্মতির কথা বললাম। প্রশ্ন উঠতে পারে, একদিন পরে কেন রাজি হলাম? এ বয়সে সত্যটাই বলা উচিত- আমার প্রথম চিন্তাটা ছিলো, যে রাজনৈতিক পটভুমিকায় ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে তা বেশ গোলমেলে, প্রতিকূলতা যথেষ্ট আছে, কাজটি সম্পাদন করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে কি না? সে জন্য বাড়িতে এসে স্ত্রীর সাথে কথা বললাম। মনে হলো আমার তো পারা উচিত। সুতরাং রাজি হয়ে গেলাম।


এইসব ছেলেদের সঙ্গে ছিলো মনজুরে মওলা, আতাউল হক। এরা সব সময় নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করতো। একটা ব্যাপার এখানে বলা প্রয়োজন। তা আমি পরে জেনেছিলাম, আমার কাছে আসার আগে ওরা অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের কাছে গিয়েছিলো। তিনি ওদেরকে না করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোমরা আমাকে এ ব্যাপারে জড়াতে এসো না। তবে এই তথ্য থেকে তার ভূমিকা সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া উচিত নয়। তিনি প্রথম দিকে এ উদ্যোগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে চান নি, কিন্তু পরে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিলেন। আমাদের এক দুটো অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বও করেছিলেন। যাই হোক, ছাত্ররা এ ব্যাপারে প্রাথমিক উদ্যোগ নেয় এবং আমি তার সঙ্গে যুক্ত হই।

(শ্রাবণ: উপরে উল্লিখিত মোশতাক কাজী মুশতাক হোসেন, সে সময় ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পি এইচ. ডি. পড়তে লন্ডন যান, পি. এইচ. ডি. শেষ করেন নি, দেশেও ফিরে আসেন নি। এখনও যুক্তরাজ্যে কর্মরত।

শ্রাবণ: সেই সময় বাংলাদেশে সরকারি মহলে বুদ্ধিজীবীদের ভেতরও সাধারণ মানুষের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কি ধরনের আবহাওয়া ও চিন্তাভাবনা বিদ্যমান ছিলো?

খা. সা. মু: সরকারি মহলে বাঙালি আমলাদের মধ্যে রবীন্দ্রপ্রীতি ছিলো না একথা আমি বলবো না। কেননা ব্যক্তিগত জীবনে অনেকে রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন। যেমন মোকাম্মেল হক, একেএম আহসান, সানাউল হক। এরা রবীন্দ্রচর্চা করতেন, গান শুনতেন, বিদগ্ধ আলোচনায় সক্ষম ছিলেন। আমলাদের মধ্যে রবীন্দ্রপ্রীতি কতখানি ব্যাপক ছিলো বলতে পারবো না। তবে আমার ধারণা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনুকূল মনোভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিলো। কিন্তু এই দেশ যারা শাসন করতো তাদের মধ্যে তা ছিলো না। একসময় পাকিস্তানের এক শিক্ষা সচিব আরবী হরফে বাংলা লেখাতে আদাজল খেয়ে লেগেছিলো। পাকিস্তানী আমলারা বেশির ভাগই বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধী ছিলো। এদিক থেকেও আবহাওয়া যথেষ্ট প্রতিকূল ছিলো। উচ্চ পর্যায়ে বাঙালি আমলা আর কজন? অবাঙালিদের মধ্যে আমার জানামতে, আসগর আলি শাহ বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ঠিক সে সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন কি না আমার মনে নেই। উপরন্তু আইয়ুব খান জাতীয় পুনর্গঠন বলতে বুঝতেন বাঙালিদের পাকিস্তানের মানসিকতার সঙ্গে পুরোপুরি এক করা। সেটা বাঙালিদের শর্ত অনুযায়ী নয়, পাকিস্তানের শর্ত অনুযায়ী। আইয়ুব খানের এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাঙালিরাও যুক্ত ছিলেন। তারা আবর্তিত হতেন প্রধানত আজাদ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। তার কর্ণধার ছিলেন মওলানা আকরম খাঁ, সহগামী ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, কবি বেনজীর আহমদ, মজিবর রহমান খান এবং আরো অনেকে। এরা সংকীর্ণ ধর্মভিত্তিক ইসলামভিত্তিক জাতীয়তার ব্যাখ্যা দিতেন এবং তার পক্ষে কথা বলতেন। তারা কখনোই রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানী সংস্তৃতির অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হননি। রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গী কতখানি বিরূপ ছিলো। বুদ্ধিজীবীরা কতখানি বিভক্ত ছিলো তার প্রমাণ মেলে ১৯৬৭ সালের একটি ঘটনা থেকে। সে বছর পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রী খাজা শাহবুদ্ধিন বেতার ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করে। আমরা কাগজে এর প্রতিবাদে একটা বিবৃতি দিয়েছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথকে আমরা বাংলা ভাষাভাষী পাকিস্তানীর সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করি। আমরা যা বলতে চেয়েছিলাম তার যুক্তি ছিলো এই যে বাঙালি সংস্কৃতি যদি পাকিস্তানী সংস্তৃতির অন্যতম উপাদান হয় বাংলা ভাষা যদি পাকিস্তানী সংস্কৃতির উপাদন হয়, তা হলে রবীন্দ্রনাথ পাকিস্তানী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমাদের এ বিবৃতিতে ডক্টর কুদরত-ই-খুদা, কাজী মোতাহার হোসেন, জয়নুল আবেদিনসহ সম্ভবত ১৯ জন শিল্পী-সাহিত্যিক অধ্যাপক সই দিয়েছিলেন। ঢাকার বাইরে থেকে যাঁরা সমর্থন দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের প্রাক্তন র্স্পীকার খুলনার আব্দুল হাকিম এবং চট্টগ্রামের অধ্যাপক আবুল ফজল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে যে পাঁচজন এর বিরোধিতা করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন এবং খোন্দকার মুনিম। বাইরে থেকে প্রতিবাদ করেন মুহম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, ইব্রাহীম খান, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ ও হাসান জামানসহ আরও অনেক ব্যক্তি। ডক্টর শহীদুল্লাহ, ডক্টর এনামুল হক, শওকত ওসমান ও আবুল হোসেন এ বিতর্কে যোগ দেননি। পাক-ভারত যুদ্ধের পরবর্তী আবহাওয়ার এবং বি.এন. আরের সেই দাপটের যুগে বেশ ক'জন রবীন্দ্র-প্রাণ ব্যক্তি রবীন্দকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংঘর্ষ এড়াতে চেয়েছেন। রেডিও পাকিস্তান থেকে রবীন্দ্র-সঙ্গীত প্রচারের বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে মুন্সী রইসুদ্দীনও অন্যান্যরা যে বিবৃতি দেন তাতে রবীন্দ্র-সঙ্গীতের বোদ্ধা শিল্পী আবদুল আহাদ সই দেন নি। আবার রবীন্দ্র-সঙ্গীতের যথাযোগ্য স্থান রেডিও পাকিস্তানের প্রোগ্রামে হোক এটা চেয়ে যে বিবৃতি প্রকাশিত হযেছিলো তাতেও তিনি সই দেননি। সেই সময় বুদ্ধিজীবীদের ভেতর রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কি মনোভাব ছিলো এসব থেকে তা' খানিকটা বোঝা যায়। অবশ্য রবীন্দ্র-সাহিত্য ও সঙ্গীতের জ্ঞানও বিদগ্ধ বোধ এবং উপর থেকে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, এ দু'টো জিনিসকে একটু আলাদা করে দেখা উচিত। আর সাধারণ মানুষের কথা? সাধারণ মানুষের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিলো ঢাকা ও কলকাতা থেকে প্রচারিত রবীন্দ্র-সঙ্গীতের মাধ্যমে। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ কে এবং কি এ খবর সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত সরস এবং জোরালোভাবে পৌঁছে দেয় ইত্তেফাক এবং সংবাদ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে আজদের সঙ্গে সেই লোমহর্ষক বিতর্কের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া সাধারণ শিক্ষিত মানুষ রবীন্দ্র সাহিত্যের সঙ্গে কম-বেশি পরিচিত ছিলো। কিন্তু রবীন্দ্র-চর্চার মান, প্রসার ও গভীরতাকে বাড়িয়ে দেখা ঠিক হবে না। তবে এ-ও ভুলে যেও না, এই মধ্যবিত্ত শেষ পর্যন্ত 'ছায়ানট' সৃষ্টি করেছিলো। এই ঘটনাটি ঘটেছিলো আমাদের রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উযদাপনের পরে উৎসবে অংশ গ্রহণকারী শিল্পীদের একটি প্রতিষ্ঠানে একত্রিত করার জন্য। এই ছায়ানটের অবদান বাঙালি নিন্ম এবং মধ্যবিত্তের জীবনের বেশ বড়ো।

শ্রাবণ: শতবার্ষিকী উৎসবে যুক্ত-হওয়া কি আপনার পক্ষে সাহস ও ঝুঁকির কাজ ছিলো? আপনাকে কি কোনো ব্যক্তিগত ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়েছিলো? যদি না হযে থাকে কেনো হয় নি? ঝুঁকির বিষয়টি কি আসলে অমূলক ছিলো?


খা. সা. মু: সত্যি কথা বলতে কি ভয় পাওয়ার ক্ষমতায় তারতম্য আছে। আমি খুব ভয় পেতে তৈরি থাকি না। সে সময় আমি ভয় পেয়েছিলাম একথা বলতে পারি না। আমার শুধু মনে হয়েছিলো, আমি যোগ্য ব্যক্তি কিনা। আর একটা ব্যাপার বলতে পারি আবহাওয়াটা এমন ছিলো যে, কেউ ভয় পেলেও পেতে পারতো। আমার আবছা মনে পড়ে যে, '৬১ সালে কিংবা তার কাছাকাছি সময়ে দু'তিন জনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো! যাদের আগে পরিচয় ছিলো মার্ক্সিস্ট হিসেবে, বাঙালিত্বের পক্ষে ওকালতি করে, লেখাপড়া করে এমন ব্যক্তি হিসেবে। যেমন আলাউদ্দিন আল আজাদ, কে. জি. মোস্তফা এদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। আনোয়ার জাহিদকে তো '৬১ সালে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সুতরাং একটা সন্ত্রাসের আবহাওয়া ছিলো। এটাকে ছোট করে দেখা চলবে না। আমার আবার আর একটি ব্যাপার ছিলো। সেটা হলো আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়ে ঢোকার অল্প সময়ের মধ্যে 'সংস্কৃতি সংসদের' সভাপতি নির্বাচিত হযেছিলাম। এটি ছিলো একটুখানি বামপন্থী সংস্কৃতিমনা ছেলেমেয়েদের সংগঠন। এই সংগঠনে আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ এ'রা সব ছিলো। ব্যক্তিগত ঝুঁকির সম্মুখীন হ'তে হয়েছিলো কিনা? না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে চাকুরি থেকে সরিয়ে দেয়া একটু কঠিন, তখনও ছিলো, এখনও। বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে আমি কোনো বাধা পাইনি। তবে আমার বিভাগীয় অধ্যক্ষ রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করতেন। তাঁর চিন্তা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানী সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে ধরা যায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে একটি বড় প্রতিভা এবং বাংলা সাহিত্য থেকে তাঁকে বাদ দেয়া অচিন্তনীয় এটা তিনি মানতেন। কিন্তু পুরোপুরি ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী ছিলেন ব'লে পাকিস্তানী সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ এ ভদ্রলোকের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। অপর দিকে আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই পাকিস্তানী থাকতে চেয়েছিলাম।

ব্যক্তিগত ক্ষতির সম্মুখীন না হলেও ঝুঁকির বিষয়টি কিন্তু অমূলক ছিলো না। ভয়ের কথা আমার মনে আসে নি, সেটি অন্য ব্যাপার। একটা মজার কথা বলি, বাহান্নর যে তারিখে মুনীর চৌধুরী, মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, অজিত গুহ এবং আরো অনেককে ধরে নিয়ে গেলো, তার পরদিন খবরের কাগজে ছাপা হযে গেলো যে এ'দের মধ্যে আমিও আছি। হ্যাঁ, রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালনের সময়ে একটা ঝুঁকির আবহাওয়া অবশ্যই ছিলো। নইলে উৎসবের সক্রিয় উদ্যোক্তা হ'তে কেউ-কেউ রাজি হলেন না কেন ? তবে আমি ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত। তা না হলে আমি কেন জীবনের প্রথমেই 'নিউ ভ্যালিউজ' বের করতে গেলাম ? এই পত্রিকা সম্পর্কে আমাদের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তাঁর এক বন্ধুকে আমার সম্পর্কে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, এই যে ছোকরাকে দেখছো, ও একটা কাগজ চালায়, 'রাইপ ফর সাপ্রেশন', এ অবিশ্যি পঞ্চাশের দশকের কথা। যেহেতু আমি কোনো-কোনো জিনিসকে ভয় করিনি, সেজন্য আমার কাছে ভয়ের দিকটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।

[শ্রাবণ: বিভাগীয় অধ্যক্ষ ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন।]

শ্রাবণ: জন্মশতবার্ষিকী উৎসব কি ভাবে সংগঠিত হয় ?

খা. সা. মু : এ ব্যাপারে ঢাকা শহরে তিনটি উদ্যোগের কথা আমি জানি। একটি হলো কেন্দ্রীয় উদ্যোগ, যার প্রধান ছিলেন বিচারপতি মুর্শেদ আর একটি ছিলো ডাকসুর উদ্যোগ, যার প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে সভানেত্রী ছিলেন বেগম সুফিযা কামাল। তৃতীয উদ্যোগটি ছিলো প্রেস ক্লাবের। তারাও একটি বড় রকমের প্রোগ্রাম নিযেছিলো। আমাদের উদ্যোগটি কিভাবে সংঘটিত হয়েছিলো তার কথা তোমাদেরকে বলেছি। কমিটিতে কারা কারা ছিলেন তাদের সবার নাম আমার মনে নেই। যতদূর মনে করতে পারছি গোবিন্দ দেব, মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক হাই, নীলিমা ইব্রাহীম, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, এ'রা ছিলেন। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, মোশতাক এমন সংকল্প করেছিলো যে প্রয়োজন হলে এই উৎসব করতে গিয়ে ওরা একটা একাডেমিক ইয়ার নষ্ট করবে। ছেলেগুলো একটা বিশেষ কঠিন সময়ে দারুণ কাজ করেছিলো। সংস্কৃতিমনা ব্যবসায়ী জনাব মুখলেছুর রহমান এবং তাঁর বন্ধুরা অনুষ্ঠানের মহড়া এবং মঞ্চায়নের খরচ বহন করেছিলেন।

শ্রাবণ : সভাপতি হিসেবে বিচারপতি মুর্শেদকে নির্বাচন করা হয়েছিলো কেনো ?
খা. সা. মু : প্রথমত তিনি একজন উদার সংস্কৃতির মানুষ ছিলেন। সে সময়ে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক হচ্ছিলো সে বিতর্কে তাঁকে কেউ জড়াতে পারতো না। সরকার পক্ষের ব্যক্তিরা এবং বি.এন. আর. এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা রটনা করেছিলো যে এই উৎসবের পেছনে ভারতীয় দুতাবাসের অর্থ রয়েছে। সুতরাং এমন একজন ব্যক্তির প্রয়োজন ছিলো যাঁর নিষ্ঠা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা সহজ হবে না। তা ছাড়া তিনি রবীন্দ্র-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তাঁকে ভালোবাসতেন এবং একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিচারপতি মুর্শেদ শুধু বাঙালি ছিলেন না, তিনি ইংরেজী ভাষা ভালো করে রপ্ত করেছিলেন, সুন্দর করে বলতেন, জার্মান সাহিত্যের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। ফারসী সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ ছিলো। হাফিজ ও রুমী, বিশেষ করে রুমীর ভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের যে অংশটি মরমী, তার ওপর তার অনুরাগ ছিলো। আমার মনে আছে তাঁর বক্তৃতায় এই চিন্তা এই অনুভূতি প্রকাশ পেয়ে ছিলো।

শ্রাবণ : আপনার স্মৃতি থেকে উৎসবের সঙ্গে জড়িত বিষয়ের কিছু বিবরণ দিন।

খা. সা. মু : অনুষ্ঠানমালায কারা জড়িত ছিলেন এটা না বললে তাঁদের প্রতি অবিচার করা হবে। শিল্পী, অভিনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে তারাও ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তাঁদেরকেই আমরা বলবো সত্যিকারের রবীন্দ্রনুরাগী। কেননা তাঁরা চর্চা করতেন।

শিল্পী কামরুল হাসান চমৎকার নিমন্ত্রণ লিপিটি এঁকে দেন। ২৪ বৈশাখ সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয় এঞ্জিনীয়ার্স ইন্সটিটিউটে। শামসুর রাহমান কবিতা পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের প্রধান আন্দালিব মাদানী উর্দু কবিতা পাঠ করে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আমার মনে পড়ে, তাঁর কবিতার বক্তব্য অনেকটা এরকম ছিলো যে রবীন্দ্রনাথের কাব্য যেন দেবরাজ ইন্দ্রের সভার সঙ্গীত। তারপর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার একটি ক্ষুদ্র ভাষণ ছিলো। শামসুন্নাহার মাহমুদ বক্তৃতা করেন। সভায় সভাপতি ছিলেন বিচারপতি মুর্শেদ। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী।

বিকেল তিনটায় ফজলুল হক হল মিলনায়তনের রবীন্দ্র-সাহিত্যের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অধ্যাপক আবদুল হাই, ড. হাসান জামান ও রশীদ করীম অংশ গ্রহণ করেছিলেন। একটা কথা বলে নেয়া ভালো, সে সময হাসান জামান রবীন্দ্রবিরোধীদের একজন ছিলেন না। যতদুর মনে পড়ে, সভাপতিত্ব করেছিলেন শওকত ওসমান।

সন্ধ্যার অনুষ্ঠানকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছিলো। প্রথমে সঙ্গীতানুষ্ঠান, পরে নাটক। সঙ্গীতে অংশ নিয়েছিলেন আতিকুল ইসলাম, ফজলে নিজামী, বিলকিস নাসিরুদ্দীন, জাহিদুর রহিম, ফাহমিদা খাতুন, সনজীদা খাতুন, নাসরীন চৌধুরী, রাবেয়া খাতুন, ওয়াহিদুল হক প্রমুখ শিল্পী। 'তাসের দেশ' বোধ হয় এই সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হয়।
২৫ বৈশাখ আলোচনা সভার সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবদুল হাই। সৈয়দ আহমদ হোসেন, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা আলোচনায় অংশ নেন। বলুবুল ললিকতলা একাডেমীর উদ্যোগে পরিবেশিত হয় চিত্রাঙ্গদা ও চন্ডালিকা। চিত্রাঙ্গদা পরিচালনা করেন ভক্তিময় দাশগুপ্ত।

২৬ বৈশাখ আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন মুনীর চৌধুরী, হাসান জামান, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর। এদিন সন্ধ্যায় প্রবল ঝড় হয়। তাই সন্ধ্যার অনুষ্ঠানটি ২৭ তারিখে করি। এই দিন ড্রামা সার্কেল রাজা ও রানী নাটকটি করে। নাট্যানুষ্ঠানের শিল্পীদের সবার নাম মনে নেই। তবে মনে পড়ে সৈয়দ হাসান ইমাম রাজা ও রাণী ও তাসের দেশ-এ অভিনয় করেছিলেন। শেষ দিনের অনুষ্ঠানে টিকেট বিক্রি করে যে অর্থ সংগৃহীত হয় তা ২৬ তারিখের ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দান করা হয়।

শ্রাবণ: এ উৎসবে সাড়া কেমন ছিলো? কারা বেশি সাড়া দেন? বুদ্ধিজীবীরা, শিক্ষার্থীরা, সাধারণ মানুষ ?

খা.সা.মু : সব স্তরের মানুষই সাড়া দিয়েছিলো। অনুষ্ঠানগুলোতে কি পরিমান জনসমাগম হয়েছিলো তা অবর্নণীয়। এঞ্জিনীয়ার্স ইন্সটিটিউট ভরে যেতো। বাইরে মাইক্রোফোন লাগিয়ে দিতে হতো। মানুষ ঝড়-বৃষ্টি মানেনি। মধ্যবিত্ত বাঙালি বন্যার মতো ওখানে গিয়ে আছাড় খেতো। এ এক অসাধারণ ঘটনা। একদিকে যেমন ছিলো প্রতিবাদ, অন্যদিকে একটা আকর্ষণ। এ অনুষ্ঠানগুলো প্রমাণ করেছে যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে মানুষ কতখানি তৃঞ্চার্ত ছিলো। অসংখ্য মানুষ ফিরে গেছে, আমরা জায়গা দিতে পারিনি। যতক্ষণ জায়গা ছিলো আমরা সবাইকে বসতে দিয়েছি, এমন কি যারা টিকেট করে আসেনি, তাদেরকেও। এ এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা।

শ্রাবণ: সংবাদ-মাধ্যম এ উৎসবের ক্ষেত্রে কি ভূমিকা পালন করে ?

খা.সা. মু: আজাদ ছাড়া সব পত্রিকার ভূমিকা ইতিবাচক ছিলভ শ্রোতারা আমাদের সমর্থন দিয়েছে। ইত্তেফাক এবং আজাদ-এর মধ্যে তো মল্লযুদ্ধ চলেছিলো অনেক দিন ধ'রে। আমাদের সেমিনারের কোনো-কোনো বক্তব্য হেড লাইন করে প্রকাশ করা হতো। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের উক্তি, ' রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের থাকে কি ?' হেড লাইন হয়েছিলো। আমরা জনসমর্থন প্রচুর পেয়েছি। এর পেছনে রবীন্দ্র-প্রীতিই কাজ করেছে তা নয়। একটা প্রবল আবেগ ছিলো বাংলা সংস্কৃতির, স্বকীয়তার পক্ষে এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে।

শ্রাবণ: উৎসবের জন্য অর্থ সংগৃহীত হয় কি ভাবে ? কত ব্যয় হয়েছিলো ? হিসাব নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিলো কি ?

খা. সা. শু : তখনকার দিনে এত অল্প টাকায় এত কাজ করা যেত যে অর্থ নিয়ে আমরা কখনো ভাবিনি। যে সমস্ত সংগঠনগুলো আমাদের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলো, যেমন বাফা, ড্রামা সার্কল, তারা তাদের অর্থে করেছিলো। কেন্দ্রীয় কমিটির আর্থিক দায় ছিলো না বললেই চলে। আমরা যে এঞ্জিনীয়ার্স ইন্সটিটিউট ভাড়া করেছিলাম তার জন্য ৫০ অথবা ৮০ টাকা দিতে হয়েছিলো। সেটা বিচারপতি মুর্শেদ জোগাড় করে দিয়েছিলেন। তাঁকে খরচ জুগিয়েছিলেন প্রয়াত হাফিজউদ্দীন সাহেব। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতের পুলিশ সার্ভিসের লোক। যখন কথা রটেছিলো যে আমরা ভারতীয় দুতাবাস থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছি তখন আমরা কারো কাছে গিযে চাঁদা তুলিনি। জনাব মুর্শেদের ভাষণ ছাপানোর জন্য যে অর্থ ব্যয় হয়েছিলো সেটা তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। অডিটের প্রশ্ন তখনই ওঠে যখন বিরাট রকমের খরচ হয় এবং যে টাকা নানা জনের কাছ থেকে আসে।

শ্রাবণ: জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলা একাডেমীর ভূমিকা কি ছিলো ?

খা.সা.মু : Zero-শূন্য। সৈয়দ আলী আহসান দায়িত্বে ছিলেন। আনিসুজ্জামান তাঁর কাছে গিয়েছিলো কিছু করা যায় কি না জানার জন্য। খুব ডিসকারেজিং কথাবার্তা হয়েছিলো। তিনি তো সেই ব্যক্তি যিনি বলেছিলেন, 'পাকিস্তানের সংহতির জন্য প্রয়োজন হলে আমি রবীন্দ্রনাথকে বিসর্জন দিতে রাজি আছি।' এ কথাটি আমাদের সামাজিক ইতিহাসের নানা গ্রন্থে দেখতে পাই। তাঁর ভূমিকা খুব পরিষ্কার ছিলো।

শ্রাবণ: আমাদের জাতীয় জীবনে এবং সংস্কৃতিতে এ উৎসবের কোনো অভিঘাত দেখা দিয়েছিলো কি ? যদি দিয়ে থাকে কি সেই অভিঘাত ?

খা.সা.মু : এর একটা বিরাট অভিঘাত ছিলো। প্রথমে নেতিবাচক কথাটাই বলি, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবাদ ছিলো কিন্তু এর ইতিবাচক দিকটা হলো এই যে আমরা খুব সৃজনশীল উপায়ে এই প্রতিবাদ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই উৎসবের অনেক মানুষকে একত্রিত ক'রে আমাদের জাতীয়তার এবং আমাদের জীবনের উৎসব কি হওয়া উচিত তার একটি বিশেষ উদাহরণ সবার সামনে তুলে ধরলাম। আমরা একটি জনগোষ্ঠীকে একটি মহৎ অভিজ্ঞতা দিলাম। বললাম দেখ পাকিস্তানী সংস্কৃতিতে আমরা যা দিতে চাই সেটা এই জিনিস। এটা কি তোমরা চাও না ? এই কথাটা বলতে পারাই একটা অভিঘাত।

শ্রাবণ: জন্মশতবার্ষিকী যদি কোনো মৌল বোধ জাগ্রত করে থাকতে পেরে থাকে, বর্তমান সময়েও কি সে বোধ কাজ করছে? কি ভাবে ও কতটুকু করছে ?

খা.সা.মু:
অবশ্যই জাগ্রত করেছে। একটু পেছন থেকে আমাদের ইতিহাসের একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করো। বাহান্নোর পর, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আমরা গণতন্ত্রের দিকে এগুবার চেষ্টা করলাম। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে, আমরা গণতন্ত্রের দিকে এগুবার চেষ্টা করলাম। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে যে ব্যাপক বোধ জাগ্রত হয়েছিলো, গনতান্ত্রিক জীবনের জন্য যে আকুলতা, ব্যগ্রতা প্রকাশ পেয়েছিলো, তার পেছনে ভাষা আন্দোলন এবং বাঙালির স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠার চেষ্টার একটা অবদান ছিলো, প্রত্যক্ষভাবে না হ'লেও পরোক্ষভাবে তো নিশ্চয়ই। তারপর জয়েন্ট ইলেকটরেটের পক্ষে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিলো, এর বিপক্ষে কিছু লোকের প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও এটাকে সেই ধারাবাহিকতার মধ্যে স্থান দিতে হবে। এভাবে অগ্রসর হওয়ার পথে যখন সমগ্র পাকিস্তানে সাধারন নির্বাচন আসন্ন, যখন বাঙালিরা পাকিস্তানের জাতীয়তার ভিত্তিকেই প্রশ্ন করছে, ধর্মীয় জাতীয়তার নামে যে অর্থনৈতিক শোষণ চলছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করছে, সে সময়ে ভোটে সংখ্যা-গরিষ্ঠ বাঙালির রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখলের আকাঙ্ক্ষা-তাড়িত পাকিস্তানী মিলিটারী-ব্যুরোক্রটিক ফিউডাল চক্রের প্রতিনিধি সামরিক শাসক আবির্ভূত হলেন। এসে আবার সবকিছু কেড়ে নিয়ে সমাজ জীবনে যে গতি সঞ্চারিত হয়েছিলো সে গতিকে দমন করে সব কিছু ঢেলে সাজাতে চাইলেন। আমরা সে প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কররাম। আমরা জানিয়ে দিলাম, আমরা পাকিস্তানী হতে রাজি আছি, কিন্তু আমাদের নিজস্ব সত্তা নিয়ে। এই রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উৎসব সে সত্তার একটি প্রকাশ। এই প্রতীকের মধ্য দিয়ে আমরা অনেক কথা বলতে চেয়েছি। বর্তমান সময়ে সে বোধ কাজ করছে কিনা জানতে চাও? বলতে হয় করছে, আবার করছে না। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে মাঝে-মধ্যে প্রশ্ন ওঠে। আজকে যারা আমাদেরকে বাঙালি থেকে বাংলাদেশীতে পরিণত করেছে, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তারা সন্দেহপ্রবণ। রাষ্টীয়ভাবে যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল সূত্রকে এখন লঘু করতে চাইছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের পেছনে যে অনুভূতি সবচেয়ে বেশি প্রবল ছিলো, সেটাকে দমন করতে চাইছে, তারা রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করে। কেননা রবীন্দ্রনাথ তাদের কাছে একটি প্রতীক। প্রতীক সে চেতনার যে চেতনার উপর বাঙালি জাতি অনেকখানি নির্ভরশীল। ভাষাগত সংস্কৃতির ওপরে যদি এ জাতীয়তার ভিত্তি হয, তাহলে রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ-কেউ রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করেন, কোনো-কোনো বামপন্থী রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত সীমাবদ্ধতার জন্যে তাঁকে আক্রমণ করেন। রবীন্দ্রনাথ সমালোচনার উর্ধে নন, তাঁকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই সমালোচনা করা যায় যেমন করা যায় সাহিত্যের দিক থেকেও। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোন থেকে যখন তাকে আক্রমণ করা হয়, তখন তা করা হয় যুক্তিবাদী রবীন্দ্রনাথ, ব্রাহ্ম সমাজ এবং হিন্দুত্বের, অরবিন্দ-বিবেকানন্দ-গান্ধীর, বিশেষ ক'রে, হিন্দু সমাজের সংকীর্ণতা ও পশ্চাৎমুখীতার, কত বড় সাহসী সমালোচক ছিলেন তা ভুলে গিয়ে। এর উদ্দেশ্য তাঁর ঐতিহাসিক মূল্যকে বিকৃত করা, তাঁকে অশ্রদ্ধেয় এবং অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা, এবং তা করতে পারলে বাঙালি জাতীয়তার মূল সূত্রকে ঘায়েল করা সম্ভব হয়। ইদানিং ধর্মীয় জাতীয়তাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। টেলিভিশনে খবর শুরু করা হয় 'সবকটি জানালা খুলে দাও না' গানটি দিয়ে, কিন্তু এ গানের পেছনের ইতিহাস ও মূল্যবোধকে ঐ একই জানালা দিয়ে বিদেয় করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এটাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কোনো-কোনো রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে এসব করছে। যারা সত্তুরের নির্বাচনে শতকরা ৪ থেকে ১০ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন, তারা তো এদেশে থেকে গিয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা যত বাঙালি হত্যা করেছিলো, রাজাকাররা তার চেয়ে কম করেনি। তাদের ঘাতক ও ফ্যাসীবাদী রাজনীতি পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সাহায্যে শক্তিশালী ও পুষ্ট হয়েছে। জিয়াউর রহমান যখন ১৯৭৫-এ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার হত্যার পর ক্ষমতায় এলেন, তখন তিনি তাদেরকে তাঁর স্বাভাবিক মিত্র ভাবলেন যারা আওয়ামী লীগের জাতীয়তার দর্শনে বিশ্বাস করতো না। জানতো, এখনো আছেন সেইসব নায়কেরা যাঁরা পশ্চাত্তরের পর থেকে প্রতিদিন প্রাতঃরাশে অন্তত একটা হাতী আহার করেন এবং তার জন্য সন্দেহাতীত প্রমাণ হাজির করেন, কিন্তু প্রমাণাভাবে মানতে পারেন না, মুক্তি সংগ্রামের নানা পর্বে অন্য সব দলের তুলনায় আওয়ামী লীগ অনেক বড়ো ভূমিকা রেখেছে অথবা কিছুতেই স্বীকার করেন না যে শেখ মুজিব নামক কোনো ব্যক্তি কোনো এক সাতই মার্চ বাংলার এক উত্তাল জনসমুদ্রে মুখপত্ররূপে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংবিধানে চার মূলনীতির অন্যতম ছিলো জাতীয়তাবাদ। যেহেতু জিযার আমলে আওয়ামী লীগ স্বাভাবতই তাঁর রাজনৈতিক সমর্থনের উৎস হতে পারে নি, সেহেতু তাঁকে দোসর খুঁজতে হয়েছিলো। তাদের মধ্য থেকে যারা আওয়ামী লীগ বিরোধী যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। এই প্রক্রিয়ায় তারাই পুনর্বাসিত হলো যারা ভাষাগত জাতীয়তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ চায় নি। সেই অসৎ ইসলামপন্থী, সেই সাম্প্রদায়িক বাঙালিরা তারা তো বাঙালি নয়, তারা মুসলমান, এই ভূখন্ড কিভাবে শাসিত হবে এটা তাদের কাছে বড়ো কথা নয়, শাসকরা ইসলামের হেফাজতকারী মুসলমান হ'লে হলো। তারা যখন পুনর্বাসিত হলো, বুঝতে হবে স্রোতটাকে প্রকৌশলগতভাবেই বদলে দেয়ার চেষ্টা হবে। আংশিকভাবে এ প্রচেষ্টা সফল হলো এবং এটাকে একটা প্রায় বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে স্থাপন করার জন্য জিয়াউর রহমান চেষ্টা করলেন। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হল নবসৃষ্ট বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমানার অধিবাসী আমরা, তাই আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশী, অন্য কথায়, এ দেশের মানুষের বাঙালিত্ব ১৯৭১ সালে হঠাৎ গজিয়ে উঠেছে, এর প্রাচীনতর কোনো ভূমিকা নেই, উৎস নেই, স্মৃতি নেই! কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার একই ব্যক্তি আবার ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে মুছে দিচ্ছেন। এটা মুসলমানদের দেশ বলে তিনি আমাদের বাংলাদেশী করেছেন? কিন্তু উপজাতিরা? ওদের কি ধর্ম নেই? ধর্মনিরপেক্ষতা কেনো বাদ দিলেন? সুতরাং আমরা বুঝবো এটা একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক সিদ্ধান্ত। তার নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য, আপাত সাফল্যের জন্যে, মুক্তিযোদ্ধা হয়েও এ কাজটি তিনি করে গেছেন। প্রসঙ্গত মনে পড়ে ১৯৭৯ সালের ১-৭ আগস্ট লুসাকার কমনওয়েলথ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের বৈঠকের সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আমার সঙ্গে এক ব্যক্তিগত আলোচনায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বাঙালির আসক্তিকে রূঢ়ভাবে দায়ী করেছিলেন তার আলস্য ও কর্মবিমুখতার জন্যে। আমার সোনার বাংলা'র কবির প্রতি আমাদের এক নম্বর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের আসল মনোভাবটা ছিলো এই। তিনি রাজাকারদের মন্ত্রী করলেন। মওলানা মান্নান, শাহ আজিজুর রহমান ক্ষমতায় এলেন। এখন মুক্তি যোদ্ধারা কোনঠাসা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সরকারের এক তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এগুলো সব একত্র করলে মূল কথাটা এই দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধ যদি আমাদের বাঙালি জাতীয়তার সুত্রটিকে প্রতিষ্ঠিত করে থাকে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে, সমাজে পুনর্বাসিত করে, সেই সুত্রটিকে দুর্বল করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ আক্রমণের লক্ষ বড় হয়েছেন। আক্রমণটা শুধু মুসলিম ডান থেকে আসে নি, প্রগতিশীল বাম থেকেও মাঝে মধ্যে আসে এবং কোনো কোনো সময় এ দুই এক হয়ে যায়। বুঝতেই পারো জন্মশতবার্ষিকী যে মৌল বোধ জাগ্রত করেছিলো। তার প্রয়োজন আছে আমাদের জন্য। এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সে কথাই প্রমাণ করে।

শ্রাবণ: রবীন্দ্রনাথের একশত পঁচিশতম জন্মবার্ষিকী বাংলাদেশে যেভাবে উদযাপিত হয়েছে তা কি (ক) জন্মশতবার্ষিকী উৎসবের সঙ্গে ও (খ) এ ক্ষেত্রে সঙ্গত প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ? যদি সঙ্গতিপূর্ণ না হয়ে থাকে তা হলে (ক) কি ভাবে এবং কোন ক্ষেত্রে তা অসম্পূর্ণ? এবং (খ) কেনো তা সঙগতিপূর্ণ হলো না? (গ) আমরা কি রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে যাচ্ছি?


খা. সা. মু : প্রশ্নের প্রধম অংশের উত্তর: রবীন্দ্রনাথের জন্মের শতবার্ষিকী উদযাপনের মাধ্যমে শিক্ষিত সমাজ কিছু কথা বলতে চেয়েছিলো, যে কথা তাদের বুকে জমা হয়েছিলো এবং প্রকাশের পথ খুজছিলো। সেই পর্বে কার্যকরভাবে কথা বলার কম পথই খোলা ছিলো। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মোৎসব একটা বড়ো রকমের সুযোগ এনে দিয়েছিলো, সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি তো আর হতে পারে না। স্বৈরাচারের হাতে জনগণ এখনও মার খাচ্ছে। কিন্তু তারা শক্তিও অর্জন করেছে, নানা জায়গা এবং প্রতিষ্ঠান থেকে নানাভাবে কথা বলার সুযোগ করে নিয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথ কিছু কিছু প্রতিকূলতা সত্বেও আজ একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। উনসত্তুর সত্তুর একাত্তুরে তিনি গুরোপুরি আমাদের কবি' হয়েছিলেন। তাকে অবলম্বন করে উৎসব বা প্রতিবাদে আজ সে রকম 'বিপ্লবকর' অভিঘাত থাকতে পারে না। এইসব উৎসব আজকাল সাধারণভাবে প্রাতিষ্ঠানিক, এমন কি যান্ত্রিক, কিন্তু নিয়মিত এবং নৈষ্ঠিক। বাংলা একাডেমীসহ দেশের নানা প্রতিষ্ঠান কবির জন্মের একশত পঁচিশ বৎসর পূর্তি উৎসব পালন করেছে। বাহ্যিক আয়োজন তো বেশ হয়েছে। তবে এ সবের সঙ্গে আমাদের অনুশীলন, মেধা এবং মেধার যোগ কতখানি গভীর এবং আন্তরিক হলে এসব অর্ধপূর্ণ হয় তা ভেবে দেখা উচিত। আসলে প্রত্যাশা কার কাছে? আমাদের নিজেদের যে বিরাট তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?

রবীন্দ্রনাথের বহু আয়তন, তার নিছক নৈষ্ঠিক পণ্ডিতি চর্চা একটা বিপুল প্রয়াস হয়ে উঠতে পারতো, যেমন হয়েছে ইয়েটসের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে ভাবনা চিন্তা এবং গবেষণা হচ্ছে এ বাংলার অবদান তাতে অকিঞ্চিৎকর। গত পঁচিশ বছরের মধ্যে এখানে ডিগ্রীর জন্যে লিখিত দু'একটা অভিসন্দর্ভ, এক আধটা সমালোচনা গ্রন্থ, ছিটেফোটা কয়েকটি প্রবন্ধ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে কি? আমাদের কোনও পন্ডিত রবীন্দ্রনাথকে তার জীবনের সাধনা করেন নি। কবি গাল্পিক রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা মাঝে মাঝে যাই। কিন্তু প্রতিবাদী সমাজ সমালোচক জিজ্ঞাসু অস্বস্তিকর রবীন্দ্রনাথ আমাদের বড়ো একটা কৌতুহলের ব্যাপার নয়। শিক্ষা সমাজ রাষ্ট্র সভ্যতার নানা মৌলিক প্রশ্ন ও সমস্যার নিরন্তর বিশ্লেষক, এসব বিষয়ের ভাবুক রবীন্দ্রনাথ আমাদের খুব কাছের ব্যক্তি নন। আসলে এ দূরে সরে যাওয়া নয়, মনন বা জিজ্ঞাসাজাত অবস্থান পরিবর্তন নয়, বিশ্বসাহিত্যের খোলা দিগন্তে অপর কোনো মহৎ অনুরাগ নয়, কোনো সচ্ছল উদার আপেক্ষিকতাবোধও নয়, এ অজ্ঞতা বা উদাসীন্য বা দুই-ই। এ আমাদের অগভীর বৌদ্ধিক জীবন, তরল সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে গিয়েছি কিনা এ জিজ্ঞাসার প্রসঙ্গে নতুন প্রজন্মের সৃজন কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গীর কথা এসে পড়ে। তিরিশের কবিদের রবীন্দ্রদ্রোহের মতো কোনো ব্যাপার এখানে চোখে পড়ে না। তারা রবীন্দ্রনাথ এবং নিজেদের মধ্যে এক স্বাভাবিক ভিন্নতা সৃষ্টি করে গেছেন, নতুনতার কালে রবীন্দ্রনাথ ও তিরিশোত্তরদের মধ্যে নতুনতর ভিন্নতা সৃষ্টি হবে সেটা প্রত্যাশিত। বাংলাদেশের কবিদের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ আছে, মনপুরা আছে, সপরিবারে মুজিব-নিধন আছে, ফ্যাসিজমের পচন ক্রিয়ার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা আছে, আর আছে আনবিক নরকে মানব প্রজাতির ভস্মীভূত হওয়ার অতি বাস্তব অতি নিকট আতঙ্ক যা তিরিশের কবিদের ছিলো না। এক কালের দ্রোহ আরেক কালের অর্থডক্সি, কষায় কটু তেতো নুন ঝাল যার শেষ হয়েছে। নানা রকম নেতি এবং বিশ্বাসহীনতা-তাড়িত, কুৎসিত, নষ্ট এবং হিংস্র কালের মানুষের কাছ রবীন্দ্রনাথের সুষমা ও কল্যাণবোধ তার নিকটবর্তী হওয়ার পথে অন্তরায়, এ আমরা জানি। আবার এও জানি রবীন্দ্রনাথের প্রশান্তি ও বিশ্বাস নিচ্ছিদ্র থাকেনি শেষ পর্যন্ত, তবুও এ দুয়ের যেটুকু তাঁর ছিলো সেটুকু তাদের থাকলে আধুনিকেরাও, খুশি হতেন, বেঁচে যেতেন। কেননা আধুনিক হৃদয়ের একটি গোপন হাহাকার বিশ্বাসের অভাব।
অল্ডাস হাক্সলি একবার বলেছিলেন, ক্ষুধার মতো বড়ো কিছুতে বিশ্বাসের এক ক্ষুধা আছে মানুষের মধ্যে, যা কোনো না কোনো ভাবে নিজেকে পূর্ণ করবেই। ইতির গভীর থেকে একটা প্রত্যয় মানুষের চাই। রবীন্দ্রনাথের সুমিতি এবং শুভচেতনা, একই সঙ্গে তার ক্ষুব্ধ সমসাময়িকতা, নানা স্ববিরোধের ভেতর নিজেকে ভেঙে গড়ার দায় মানার আধুনিকতা, অস্তিম বিশ্বাস, আপন-নির্ভরতা, আজ সহজ চোখে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের মানতে বাধা থাকে না। তিরিশের ভাষায় যেমন আজকের অনুভব ও মেজাজ ব্যক্ত করা যায় না তেমনি করা যায় না রবীন্দ্রনাথের ভাষায়। রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী প্রতিভাকে মানলেও তাকে চিরকালের মডেল ভাববার কোনও প্রয়োজন নেই। কাব্যিক ঐতিহ্যের সঙ্গে কবির সম্পর্কের ব্যাপারটি জটিল, এমন কি বাণিজ্যপূর্ণ গ্রহণে প্রত্যাখ্যানে তিনি স্বীকার করেন, তার মজ্জায় এবং শ্রুতিতে অতীতের মহৎ শিল্পকে ধারণ করে নিজগুণে বিশিষ্ট হতে পারেন। মহৎ শিল্পী, এ ক্ষেত্রে যেমন রবীন্দ্রনাথ, মানুষের জীবন ও শিল্প বিচারের এক নিঃসংশয় মানদন্ড হিসেবে পরবর্তীকালের কাজে লাগেন। বাংলাদেশের এক তরুণ কবিকে দেখি তার বেশে'র পণ্যতান্ত্রিকতা এবং ভিক্ষুকাচারকে বিচার করতে রবীন্দ্রনাথের ধারণাগত আকাশে'র আলোয়: আরেক কবি রবীন্দ্রনাথের বাড়ির প্রাঙ্গণের প্রস্তরময়ী সুজাতার গৌতমের জন্যে উদ্দিষ্ট পায়েসান্নের দিকে, রবীন্দ্র জীবননানন্দর অনুপস্থিতির সুযোগে, ফড়িঙের গর্বে তার প্রতিযোগী হাত বাড়িয়ে দেন: আরও একজন অকপট নাস্তিকের সুরক্ষিত হৃদয় চকিতে ভেসে যায় রবীন্দ্রের অমলিন গীতসুধারসে। দেশের রাজনৈতিক চেতনার জাগর রবীন্দ্রনাথ কাব্যিক ঐতিহ্য ও প্রভাব হিসেবে ও অনুকরণ দাবি না করেও বিচিত্রভাবে আমাদের কবিদের ধ্যানে হানা দেন বলেই তো মনে হয়। কিছুকাল আগে এদেশের একজন প্রধান পন্ডিত যখন এক প্রবন্ধে সুভেন্দ্র ঠাকুর আর নারায়ণ চৌধুরীর পথ ধ'রে, কিন্তু অশীলিত ভাষায় মানুষ ও সামন্ত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু তথ্য যুক্তিহীন উক্তি করেন যেমন রবীন্দ্রনাথ একজন সর্বতোভাবে উপনিষদ আক্রান্ত হিন্দু, মুসলিম সংস্কৃতিবিদ্বেষী, যার উদার 'মানবিকতা' অনুশীলনজাত নয়, নোবেল পুরস্কার লাভের পরবর্তী ঠাট, মহৎ বাণী যার মুখ থেকে ফাকে ফোকরে বেরিয়েছে মাত্র এবং এ কথাগুলোকে তিনি নুতন প্রজন্মের রবীন্দ্র মূল্যায়ণ বলে দাবি করেন, তখন সে প্রজন্মের অনেকে, যাদের মধ্যে ছিলো বেশ কটি জোরালো কবিকণ্ঠ, তার এ দাবি এবং অসংস্কৃত অস্ত্র আক্রোশকে প্রচুর তথ্য এবং যুক্তি দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে। এ পন্ডিতের রবীন্দ্রমূল্যায়ণের সবচেয়ে দুর্বল দিক ছিলো এই যে কবির বিশাল সৃষ্টির কোনো দিক দিয়ে কিছুমাত্র স্পৃষ্ট বা ঋদ্ধ হওয়ার ক্ষমতা তার আছে, এমন প্রমাণ তার প্রবন্ধটিতে ছিলো না। আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথের সীমাবদ্ধতার আলোচনায় আমি কোনও আপত্তি দেখি না, যে কোনও প্রতিভা-যতো বড়োই হোক না কেনো তার চরিত্র, স্তর এবং সীমানা নিয়ে সংবেদী, যুক্তিনির্ভর আলোচনা সৎ এবং বিদগ্ধ সমালোচক অবশ্যই করবেন। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ 'কবিগুরু' হলে হতে পারেন, কিন্তু নিশ্চিতই গুরুদেব নন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি ভক্তিবাদী নয়, সেকুলার।

রবীন্দ্রনাথের কাছে যাওয়া কিংবা তার কাছ থেকে সরে আসার অস্বস্তিকর সাহিত্যবহির্ভূত দিকটির কথা আমরা জানি। তিনি আমাদের রাজনৈতিক দর্শনের দ্বন্দ্ব এবং টানা-পোড়েনে জড়িয়ে গেছেন। তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। কিন্তু তার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য তিনি এক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্ম এবং পুষ্টিতে সাহায্য করেছেন। তিনি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকের দ্বারা নন্দিত, একই দৃষ্টিকোণ থেকে কারো কারো দ্বারা নিন্দিত। শেষোক্তরা সংখ্যালঘু হলেও দেশে তাঁরা বিন্যমান ও শক্তিশালী। তিনি কবি হিসেবে চর্চিত হোন আর নাই হোন, তিনি দুদিক থেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন, যেহেতু ভালোবাসা এবং আক্রোশ শিল্পীকে ঘিরে নয়, রাজনৈতিক প্রতীককে ঘিরে। তবু স্মরণ না করে পারি না, রাজনীতির রবীন্দ্রনাথ গানের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে এক হয়ে গিয়েছিলেন। আজও সংকটে তিনি আমাদের দারুণ আপন, একটি অস্থির জাতির বিক্ষুব্ধ ইতিহাসে আশ্রয়ের একটি উজ্জ্বল স্থির বিন্দু।

রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের চিত্তের অনেকখানি জুড়ে আছে যদিও এখনকার গায়ক গায়িকারা বিশুদ্ধতাবাদীদের সব সময় খুশি করতে পারেন না। তবু সাহিত্য ও ভাবুক শিল্পী রবীন্দ্রনাথ অচর্চিত থাকলে প্রতীক রবীন্দ্রনাথের জোর কমে যাবে। মানুষ ও শিল্পী রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ কালের সবচেয়ে পূর্ণ প্রকাশ ও রূপমন্ডিত প্রতিভূ, সে কারণে পরবর্তী কালের এক তীক্ষ্ণ বিচারক এবং কষ্টিপাথর। আর শিল্পী রবীন্দ্রনাথ নিরন্তর সৃষ্টি বিকাশ ও পরিণতিতে, নেতি ও ইতির মোকাবেলায়, নানা ঋতু ও গতি পরিবর্তনে, এক বিস্ময়কর কাব্যিক বিবেক ও অভিজ্ঞতা, যার পাঠ সহজে ফুরোবার নয়।